ফেরিওয়ালা ইরফান এর সংগ্রামী জীবন এবং সন্তানের অকাল মৃত্যু।১০% প্রিয় লাজুক খ্যাঁক এর জন্য।
ইরফান মিয়া অনেক সকালে কটা পান্তা ভাত খেয়ে মালপত্র নিয়ে কাজে বেরিয়ে পড়লো। বেরোনোর সময় চিন্তা করতে থাকে। আজ কোন দিকে যাওয়া যায়। প্রতিদিন একই দিকে গেলে বেচাকেনা ভাল হয়না। এজন্য সে চিন্তা করছিলো আজ শহরের দিকে যাবে। যদিও শহরের ধনীদের এলাকায় তার মতো ফেরিওয়ালাদের কাছ থেকে কেউ জিনিসপত্র কেনে না। এজন্য সে ঠিক করেছে বস্তির দিকে যাবে।
ছবির সোর্স-লিংক
ইরফান মিয়ার বয়স পঞ্চাশ পার হয়েছে। তিন সন্তান আর স্ত্রীকে নিয়ে সংসার। গ্রামের বাড়িতেই থাকেন সবাইকে নিয়ে।একটা সময় ইরফান মিয়া প্রচন্ড অভাবে দিন কাটিয়েছে। পেটে ভাত ছিলো না, গায়ে কাপড় ছিলোনা। কোন ভবিষ্যৎ ছিলো না। কিন্তু আজ সে ফেরি করে করে জিনিসপত্র বিক্রি করে তার অবস্থার উন্নতি ঘটিয়েছে। এমন না যে সে অনেক ধনী হয়ে গিয়েছে। কিন্তু সে মোটামুটি সচ্ছল জীবনযাপন করে এখন। কারণ ফেরি করে যে জিনিসপত্রগুলি সে বিক্রি করে। বেচাকেনা ভালো হলে লাভ ভালই থাকে।
সন্তানরা সবাই পড়ালেখা করছে। ইরফান মিয়ার যতই কষ্ট হোক সে ঠিক করেছে সন্তানদের যতদূর পারে সে লেখাপড়া করাবে। তিন সন্তানের ভেতর ছোটটি পড়ালেখায় খুব ভালো। বড় দুটো পড়ালেখা খুব একটা করতে চায়না।
ইরফান নিয়া তার মালপত্র নিয়ে যখন শহরের দিকে হেঁটে যাচ্ছিল। তখন তার পুরনো কথা মনে পড়ছিলো। কিভাবে সে প্রচণ্ড অভাবে দিনাতিপাত করেছে। একদিন স্থানীয় হাই স্কুলের হেডমাস্টার সাহেব তাকে কিছু পরামর্শ দিয়েছিলেন সঙ্গে অল্প কিছু টাকা দিয়েছিলেন পুঁজি হিসেবে। তারপর থেকে ইরফান মিয়ার অন্যরকম জীবন শুরু। হেডমাষ্টার সাহেব এর কিছু কথা তাকে চরম উজ্জীবিত করেছিলো। মাস্টার সাহেব ইরফান মিয়াকে বলেছিলো পরিশ্রমের সাথে বুদ্ধির ব্যবহার করতে হয়। তাহলে জীবনে উন্নতি হবে।
এই কথাটি ইরফান মিয়া এখনো ভুলেনি। এইজন্য ইরফান মিয়া কখনো একই ব্যবসায় লেগে থাকে না। কখনো মালামাল ফেরি করে বিক্রি করছে। তো কখনো শহরে গিয়ে বাড়ি বাড়িতে ফল বিক্রি করছে। আবার কখনো সে মাছ বিক্রি করে। যখন যে পণ্যের বাজার ভালো হয়। ইরফান মিয়া তখন সে পণ্যটি বিক্রি করে। ইরফান মিয়া কখনো বেশি লাভ করার চেষ্টা করে না। অনেক ফেরিওয়ালা আছে একই জিনিস তার থেকে অনেক বেশি দামে বিক্রি করে। কিন্তু কম লাভে জিনিসপত্র বিক্রি করায় ইরফান মিয়ার কাস্টমাররা তাকে খুব পছন্দ করে। এই কারনে তার বিক্রিও বেশিরভাগ সময় ভালো হয়। এই ফেরি করে জিনিসপত্র বিক্রি করে করে ইরফান মিয়া বেশ কিছু জমি কিনেছে। বাড়িতে টিনের চৌচালা ঘর দিয়েছে। সন্তানদের লেখাপড়া করাচ্ছে। বউকে গয়না কিনে দিয়েছে। অথচ একটা সময় তার এক মুঠো ভাতের অভাবে দিন কেটে যেতো। জীবন থেকে ইরফানিয়া আরো একটা জিনিস শিখেছে। সেটা হচ্ছে মিতব্যায়ী হওয়া। ইরফান মিয়া কখনোই অকারনে টাকা খরচ করে না। কারণ সে জানে ছেলে মেয়েরা বড় হলে তাদের পিছনে তার খরচ বাড়বে। ছোট ছেলেটাকে নিয়ে তার অনেক স্বপ্ন। এই ছেলের স্কুলের মাস্টাররা সবাই তার ছোট ছেলের প্রশংসা করে। ক্লাসে সব সময় সে ফার্স্ট না হলে সেকেন্ড হয়। সে অশিক্ষিত মানুষ এত কিছু বোঝো না। কিন্তু এটুকু বুঝে। তার ছেলে পড়ালেখায় অনেক ভালো। যদি লেখাপড়া ঠিক মত চালিয়ে যায়। তাহলে সে বড় হয়ে বড় কিছু হবে।
ইরফান মিয়া মনে মনে স্বপ্ন দেখে। ছেলে বড় হয়ে অনেক বড় অফিসার হবে। তার সমাজে অনেক সম্মান হবে। এসব চিন্তা করতে করতে ইরফান মিয়া শহরে পৌঁছে যায়। তারপর সে হাঁটতে-হাঁটতে বস্তি এলাকার দিকে রওনা দেয়। সেখানে সারাদিন ফেরি করে তার ভালোই বেচাকেনা হয়। দুপুরে সে বাড়ি থেকে আনা ভাত খেয়ে নেয়। ইরফান মিয়া কখনো হোটেল থেকে খাবার খায় না। কারণ হোটেলে খাবারের অনেক দাম। সে চেষ্টা করে প্রতিটি টাকা বাঁচানোর। যাতে তার পূর্ববর্তী জীবনের মতো পরিস্থিতিতে আর কখনো ফিরে যেতে না হয়। ইরফান মিয়া খুবই বিনয়ী এবং হাসিখুশি মানুষ। এলাকার সবাই তাকে পছন্দ করে। কারো সাথে কখনো ঝগড়া করেনা সে। তার জীবন নিয়ে খুবই সন্তুষ্ট।
সারাদিন বেচাকেনা করে যখন ইরফান মিয়া বসে হিসাব করছিলো। হিসাব করে দেখলো আজকের দিনে তার ভালই লাভ হয়েছে। খুশিমনে সে বাড়ির দিকে রওনা দিলো। ফেরার পথে হঠাৎ করে একটি ফলের দোকানের দিকে তার চোখ গেল।তার মনে পড়ে গেলো যে আসার সময় ছোট ছেলে বলেছিলো। বাজান আমার জন্য আপেল আইনো। সেখানে থরে থরে সাজানো রয়েছে হরেক রকমের বিদেশি ফল। তার ছোট ছেলেটা আপেল খুব পছন্দ করে। কিন্তু দামের ভয়ে ইরফান মিয়া সহজে বিদেশি ফল কেনেনা। আজকে তার মনে হলো ছেলেমেয়েদের জন্য কিছু আপেল নিয়ে যাই। তার ছেলে মেয়েরা আপেল খুব পছন্দ করে। তাই সে ফলের দোকান থেকে এক কেজি আপেল কিনলো। এতগুলো টাকা খরচ করতে তার মনের ভেতরে কিছুটা খচখচ করছিলো। তার পরেও সন্তানদের হাসিমুখের কথা চিন্তা করে সে আপেলের ঠোঙা নিয়ে বাড়ির দিকে খুশিমনে ফিরছিল। আর চিন্তা করছিল তার ছেলে মেয়েরা কি রকম খুশি হবে। এমন নানা জিনিস চিন্তা করতে করতে ইরফান মিয়া বাড়ির কাছাকাছি চলে এলো।
সে আজ বেশ ফুরফুরে মেজাজে আছে। দূর থেকে সে খেয়াল করল তার বাড়ির উপরে অনেক লোকের জটলা। হঠাৎ করে তার বুকের ভিতর ধক্ করে উঠলো। কোনো বিপদ হয়নি তো? সে জোরে পা চালিয়ে বাড়ির দিকে যেতে লাগলো। বাড়ির কাছে পৌঁছে তার স্ত্রীর উচ্চস্বরে কান্নার আওয়াজ পাচ্ছিলো। ইরফান মিয়ার দৌড়ে বাড়ির ভিতর প্রবেশ করল। প্রবেশ করে যা দেখল তাতে ইরফান মিয়া বরফের মতো জমে গেলো। বাড়ির উঠোনে তার ছোট সন্তান এর মৃতদেহ পড়ে আছে। ইরফান মিয়ার হাত থেকে আপেলের প্যাকেটটি পড়ে গেল। ইরফান মিয়া জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ পরে যখন তার জ্ঞান ফিরলো। তখন তার আত্মীয়স্বজন এবং প্রতিবেশিরা তার চারপাশ ঘিরে রয়েছে। সে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। বললো আমার বাবুলের কি হয়েছে? তখন তার প্রতিবেশীরা তাকে বলল। বাবুল তার বন্ধুদের সঙ্গে নদীতে গোসল করতে গিয়েছিল। গোসল করতে গিয়ে বন্ধুদের সাথে বাজি ধরেছিলো নদী পার হওয়া নিয়ে। আগেও বাবুল এই নদী অনেকবার পাড়ি দিয়েছে। কিন্তু তখন ছিল শুষ্ক মৌসুম। নদীতে পানি ছিল খুবই কম। কিন্তু এখন এই ভরা বর্ষায় নদীর আকার অনেক বড় হয়ে গিয়েছে। দুপারের মধ্যে ব্যবধান অনেক বেড়েছে। কিন্তু ছোট্ট বাবুলের মনে এত হিসাব আসেনি। তাই সে নদী পাড়ি দিতে গিয়ে নদীতে ডুবে মারা গিয়েছে। এলাকার লোকজন খবর পেয়ে যখন তাকে উদ্ধার করতে গিয়েছে। তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। বাবুলের লাশ অনেক দূর থেকে উদ্ধার করা হয়েছে।
ইরফান মিয়া ফ্যালফ্যাল করে ছেলের লাশের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
আর চিন্তা করছে কিভাবে এক মুহুর্তে তার সমস্ত স্বপ্ন ধুলিস্যাৎ হয়ে গেলো।(সমাপ্ত)
Support @amarbanglablog by delegating STEEM POWER.
100 SP | 250 SP | 500 SP | 1000 SP | 2000 SP |
🇧🇩🇧🇩ধন্যবাদ🇧🇩🇧🇩
আমি রূপক। আমি একজন বাংলাদেশী। আমি বাঙালি। আমি বাংলায় মনের ভাব প্রকাশ করতে ভালোবাসি। আমি আমার বাংলা ব্লগ কমিউনিটিকেও ভালোবাসি।
You have been upvoted by @rex-sumon A Country Representative, we are voting with the Steemit Community Curator @steemcurator07 account to support the newcomers coming into steemit.
অনেক সাধারণ গরীব পরিবারের কাহিনী ফুটিয়ে তুলেছেন আপনার লেখা গল্পে।কিন্তু গল্পের শেষে খুবই বেদনাদায়ক।যা হামেশাই বাস্তবে ঘটছে।ধন্যবাদ ভাইয়া।
আপনাকে ও অসংখ্য ধন্যবাদ দিদি।
ইরফানের জীবনে সবে সুখের একটু হাতছানি এসেছিল। সুখ এসে পৌঁছানোর আগেই দুঃখের সাগরে ডুবে যেতে হলো। নিয়তি খুবই পাষাণ।
এরম পরিণতি হবে ভাবিনি। হঠকারিতায় অকালেই প্রাণ হারাতে হলো। বাজি লেগে এসব করতে যাওয়া বোকামি ছাড়া আর কিছুই না।
ধন্যবাদ দাদা আপনাকে।
নিয়তি বড় কঠিন জিনিস এটাকে কেউ কখনও পাল্টাতে পারে না। এই একই ঘটনা, আমাদের গ্রামেও আজ থেকে ৫/৬ বছর আগে ঘটেছিল। আমাদের বাড়ীর পাশের একটা ছেলে, আমার বয়সেরই ছিল তখন। ভরা নদীতে নোকার থেকে বন্ধুদের সাথে নদীতে ঝাপ দিয়েছিল। সকল বন্ধু নদী থেকে উঠতে পারলেও সে উঠতে পারলো না। চির তরে পিতা মাতার কোল।থেকে চলে গেলেন। একমাত্র সন্তান ছিলেন। কয়েক দিন খোজার পরই এখন পর্যন্ত তার লাশটাও পাওয়া যায় নাই।
আপনার গল্পটা পড়ে মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেল। আমরা বারবার নিয়তির কাছে হেরে যায়।সুন্দর ভাবে উপস্থাওন করেছেন। শুভ কামনা রইল।
অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে।
কি অসাধারণ ভাবে লিখার মধ্য দিয়েই আপনি একটা গরীব পরিবারের কাহিনী ফুটিয়ে তুলেছেন ভাইয়া!পুরোটা পড়লাম আমি, খুব বেদনাদায়ক মনে হলো।অবশ্য এসব ই বাস্তবতা যে সুখ এসে ছুঁয়ে দেয় তবে ধরা দেয়না। তাই মেনে নিতেই হয়।
অসংখ্য ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্য।
গল্পটা আমাকে অনেক ইমোশনাল করে দিলো। বাবুলের মতো রোজ এ হয়তো কেউ না কেউ হারিয়ে যাচ্ছে৷ খুবই বাস্তবিক ছিলো এবং আপনার লিখার ধরন আমার খুব পছন্দ হয়েছে ভাইয়া। অনেক শুভ কামনা রইলো।
আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ আপু।
প্রথমদিকে গল্পটি পড়ে ভালই লাগছিল কিন্তু পরে ইরফান মিয়া বাসায় আসার পরের কাহিনীটি অত্যন্ত হৃদয়বিদারক ছিল। হঠাৎ করে তার সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গেল। খুব কষ্ট লাগল এবং মনটা নরম হয়ে গিয়েছে আপনার গল্পটি পড়ে। বাজি ধরা খুব খারাপ বাচ্চাদের জন্য।
ধন্যবাদ ভাই আপনাকে।
সত্যি ভাই গরিবের কোপালে সুখ সয় না। আমাদের আসে পাশে এমন অনেক আছে। আপনার গল্প টা জিবন্ত রুপ পেয়েছে। গরিবের সন্তান অবহেলা আর অনাদরেই বেড়ে ওঠে। খুব সুন্দর একটা গল্প উপহার দিয়েছেন। ধন্যবাদ ভাইয়া।