দরিদ্রের অসহায়ত্ব। ১০% প্রিয় লাজুক খ্যাঁক এর জন্য।
শাহিদ মিয়া উদাস চোখে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে শুধুই তাকিয়ে আছে। কোন কিছুই সে খেয়াল করে দেখছে না। এখন পড়ন্ত বিকেল। এই সময়ে শীতের পিঠা খেতে সবারই ভালো লাগে। আমি মাঝে মাঝেই বিকালে পিঠা খেতে যাই। কিন্তু পিঠার দোকানে মূলত কাস্টমার আসে সন্ধ্যার পর থেকে। শহরাঞ্চলে এখন পিঠার বেশ ভালো বাজার তৈরি হয়েছে। এই জন্য প্রতিটি এলাকার মোড়ে মোড়ে দেখা যায় রাস্তার পাশে ছোট্ট পিঠার দোকান। আসলে দোকান বললে ভুল হবে। পিঠা বানানোর একটি চুলা, পিঠা রাখার একটি বাক্স, আর অল্প কিছু প্লেট এই নিয়েই রাস্তার পাশে বসে থাকে পিঠা তৈরীর এই কারিগরেরা। আর কাস্টমারদের জন্য থাকে একটি বেঞ্চ। অনেক পিঠার দোকানে এই বেঞ্চের ব্যবস্থাও নেই।
লোকেশন- লিংক
কিন্তু শাহিদ মিয়া তার কাস্টমারদের বসার জন্য একটি বেঞ্চের ব্যবস্থা করেছে। আমি তার দোকানের বেঞ্চে গিয়ে বসলাম। মাঝে মাঝেই তার কাছ থেকে পিঠা কেনার কারণে তার সাথে বেশ ভালো একটি সম্পর্ক হয়েছে। বেঞ্চে বসে তাকে অন্য মনস্ক দেখে জিজ্ঞেস করলাম চাচা মিয়া কি হয়েছে? মন খারাপ নাকি? তিনি আসলে এতক্ষণ খেয়াল করেনি আমাকে।আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললো হ্যা বাবাজি মনটা একটু খারাপ। দুদিন ধরে আমার নাতিটা খুব অসুস্থ। আমি জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে আপনার নাতির? তিনি বললেন দুই দিন ধরে জ্বর আর পেট ব্যথা। এলাকার দোকান থেকে ওষুধ কিনে খাওয়ালাম। তাও এখনও ভালো হয়নি।
আমি তখন বললাম ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান। তিনি বললেন ডাক্তারের কাছে গেলেই তো অনেক টাকা লাগে। আমি তখন তাকে পরামর্শ দিলাম সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যান। তিনি বললেন সরকারি হাসপাতালে নিলেও সেখানে নানা রকম টেস্ট করার জন্য লিখে দেয়। সাথে অনেক টাকার ওষুধ লেখে। আমরা গরীব মানুষ এত টাকা কই পাবো? তার কথা শুনে খুব খারাপ লাগলো। এই লোকটিকে এলাকার সবাই খুব পছন্দ করে। সব সময় সবার সাথে হাসিমুখে কথা বলে। এই পিঠার দোকান দিয়ে তার সংসারটা কোন রকমে চলে যাচ্ছিল।
তার সংসারে লোকজন কম না। ঘরে আছে তার অসুস্থ স্ত্রী, ছোট ছোট তিনটি ছেলে মেয়ে। আরো আছে তার বড় মেয়ের দুটি সন্তান। তার মেয়েটা বছর দুয়েক আগে মারা গিয়েছে। তারপর থেকে সন্তান দুটি তাদের কাছেই আছে। এত বড় সংসার নিয়ে চলতে তার খুবই কষ্ট হয়। তার ইনকাম বলতে শুধু এই পিঠার দোকান থেকে যে টাকা আসে সেটাই। একসময় পিঠার দোকান থেকেও তার ভালো আয় হতো। কিন্তু এখন এলাকার ভিতরে আরও কয়েকটি দোকান হওয়ায় তার বেচাকেনা অনেক কমে গিয়েছে। এই জন্য প্রায়ই তাকে মন মরা হয়ে বসে থাকতে দেখা যায়। আমি কিছুক্ষণ বসে তার কাছে কিছু পিঠার অর্ডার দিলাম বাসায় নেয়ার জন্য। তিনি অল্প সময়ের ভেতর আমাকে পিঠা গরম গরম পিঠা তৈরি করে দিলেন। আমি পিঠা নিয়ে দাম মিটিয়ে নিয়ে বাড়ি চলে আসলাম।
দু'দিন পর আবার বিকেল বেলায় পিঠা খেতে ইচ্ছা হলো। চলে গেলাম শাহীদ মিয়ার দোকানে। গিয়ে দেখি যে স্থানটিতে উনি বসে সে জায়গাটি খালি পড়ে আছে। পাশের এক মুদি দোকানদার কে জিজ্ঞেস করলাম শাহিদ মিয়া আজকে আসেনি? উনি বলল দুদিন ধরে উনি দোকান করছে না। উনার নাতি খুব অসুস্থ। তাকে নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি। আমার হঠাৎ মনে পড়ে গেল দু'দিন আগেই তো সে আমাকে তার নাতির অসুস্থতার কথা বলেছিল। আমি এরই ভেতরে নানারকম ব্যস্ততায় সেটা ভুলে গিয়েছিলাম। কোন হাসপাতলে আছে সেটা না জানার কারণে আর কোনো খোঁজখবর নিতে পারলাম না। তারপরও মনের ভেতরে এক ধরনের অপরাধবোধ কাজ করতে থাকলো। চিন্তা করছিলাম আমার আসলে উচিত ছিল তার নাতির ব্যাপারে খোঁজখবর নেয়া। মন খারাপ করে বাসায় চলে গেলাম। আবার যথারীতি নানা রকম কাজ কর্মে ব্যস্ত হয়ে রইলাম।
কয়েকদিন হঠাৎ করে একদিন মনে পড়ে গেল যে শাহীদ মিয়ার নাতির কি অবস্থা সেটা একবার খোঁজ নেয়া দরকার। বিকেল বেলায় চলে গেলাম তিনি যেখানে পিঠা বিক্রি করেন যে জায়গাটাতে। গিয়ে দেখি তিনি একমনে পিঠা তৈরি করছেন। আমি গিয়ে তার দোকানের পাশের বেঞ্চটাতে বসলাম। পিঠা বানানোর এক ফাঁকে তিনি আমার দিকে তাকালেন। তারপর আনমনে বললেন বাবাজি আমার নাতিটা মারা গিয়েছে। অনেক চেষ্টা করছিলাম কিন্তু বাঁচাইতে পারলাম না। এই কথা বলেই তিনি নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলেন। আমার বুকের ভিতর একটা ধাক্কা লাগলো। আমি কিছুক্ষণ সেখানে নির্বাক ভাবে বসে থেকে ক্লান্ত পদক্ষেপে বাড়ির দিকে ফিরে আসলাম। শাহিদ মিয়াদের এই অসহায় অবস্থা আমাকে ভীষণ অস্থির করে দিচ্ছিলো। নিজের মনের ভেতর এক ধরনের প্রবাল অপরাধবোধ কাজ করছিল। বারবার মনে হচ্ছিল আমার যা করা উচিত ছিল আমি কি সেটা করেছি? তার এই অসহায় অবস্থার ভেতর আমার উচিত ছিল তার পাশে দাঁড়ানো। যতটুকু পারা যায় তাকে সাহায্য করা। কিন্তু আজ আমরা এই শহুরে জীবনে শুধুই নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত। অন্যকে নিয়ে ভাববার সময় কোথায় আমাদের? এইজন্যই শাহিদ মিয়াদের অসহায়ত্বের কোন শেষ নেই।(সমাপ্ত)
Support @heroism Initiative by Delegating your Steem Power
250 SP | 500 SP | 1000 SP | 2000 SP | 5000 SP |
🇧🇩🇧🇩ধন্যবাদ🇧🇩🇧🇩
আমি রূপক। আমি একজন বাংলাদেশী। আমি বাঙালি। আমি বাংলায় মনের ভাব প্রকাশ করতে ভালোবাসি। আমি আমার বাংলা ব্লগ কমিউনিটিকেও ভালোবাসি।
সত্যি ভাইয়া দরিদ্র মানুষ খুবই কষ্টে জীবন যাপন করতে হয় আর সরকারি হসপিটালে কোন মানুষ আর মানুষ নাই অতিরিক্ত গরীবের উপর অমানুষিক নির্যাতন করে। অনেক ওষুধ লিখে দেয়। তাদের সামর্থ্য নাই তারা ভয়ই ডাক্তারের কাছে যায় না। সত্যি আপনি যখন শুনলেন উনার নাতি টা মারা গেছে। আপনার একটা ধাক্কা লাগার ই কথা।আপনি তার কাছে সবসময় পিঠা খেতে যান। তার সাথে একটি ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। আল্লাহ তা'আলা যেন জান্নাত বাসি যেন দান করে এবং ঘটনাটি খুবই মর্মান্তিক ভাইয়া। আপনি খুব সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। শুনে খুবই কষ্ট পেলাম।
এরকম অসংখ্য শহীদ মিয়া আমাদের দেশের আনাচে কানাচে রয়েছে আর দারিদ্রতার কড়াল গ্রাসের শিকার। এরা না পায় ভালো চিকিৎসা আর না পায় অন্যান্য সুযোগ সুবিধা। তবে সমাজের মানুষেরা যদি কিছুটা এগিয়ে আসে এদের দিকে তাহলে আর এতো সমস্যা থাকে না। এই শহীদ মিয়ারা কিছুটা খেয়ে পরে বাঁচতে পারে। ধন্যবাদ ভাই পোস্টটি আমাদের মাঝে উপস্থাপন করার জন্য।
ভাই আপনি অনেক সুন্দর ভাবে বিষয় টিকে আমাদের মাঝে তুলে ধরেছেন। আসলেই আমার এখন নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। আশেপাশের লোক কি করছে তা দেখার একটু সময় নিয়েই আমাদের। কিন্তু আমাদের দায়িত্ব আশেপাশের লোকদের খোঁজখবর নেওয়া।
দাদা শহিদ মিয়ার অসহায়ত্বের কাহিনী টি আমাদের মাঝে অনেক সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করেছেন পড়ে অনেক ভালো লাগলো কিন্তু আবার খারাপ লাগলো শহীদ মিনার এই অসহায় এর কথাটা শুনে আসলে আমাদের সবারই একটু খেয়াল রাখা উচিত আশেপাশের অনেক অসহায় লোক পড়ে রয়েছে তাদেরকে যেন আমরা একটু সাহায্য সহযোগিতা করতে পারি সেজন্য সব সময় খেয়াল রাখব।
সত্যি ভাই আপনার আজকের এই পোস্টটি পড়ে আমার খুবই কষ্ট হচ্ছে। আসলে অসহায় মানুষের জীবন খুবই কষ্টকর। তারা না পারে কারো কাছে কিছু চাইতে না পারে কিছু বলতে। আর বর্তমানে সরকারি হসপিটালে অনেক রকমের ছলচাতুরি হয়। বিনামূল্যে চিকিৎসার নামে চলে কসাইখানার মত ব্যবহার। আপনার এই কাহিনীটা পড়ে আমার খুবই কষ্ট হচ্ছে শেষ পর্যন্ত মারা গেল এটা আরো বেশি বেদনাদায়ক। আপনার সাথে তার খুবই সুন্দর একটি সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছে। তবে দোয়া করি তার নাতিকে যেন আল্লাহ জান্নাতবাসী করে। আমাদের প্রত্যেকেরই উচিত অসহায় ব্যক্তিদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে, তাদের পাশে দাঁড়ানো।
গরিব-দুঃখীদের পাশে আমাদের সবারই দাঁড়াতে হবে। আমাদের বর্তমানে প্রতিটিমানুষের সময়ের অভাব।তাই আমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী তাদের পাশে দাঁড়ানো উচিত।
ভাইয়া আমি আপনার গল্পটি পড়ে সত্যি চোখের জল ধরে রাখতে পারলাম না। আমি অমানুষের কষ্ট সহ্য করতে পারিনা। আপনার এই কথা গুলো আমাকে অনেক অনেক শিক্ষা দিলো। আর আপনি ভাইয়া এতটা সুন্দর ভাবে গুছিয়ে লিখেছেন পড়তে পড়তে কখন শেষ করে ফেললাম বলতে পারিনি। তবে ভাইয়া আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ এই গল্পটি আমাদের সামনে তুলে ধরার জন্যে।
ভাইয়া আপনার এই আর্টিকেলটি পড়ে সত্যিই খুব নিঃশব্দ হয়ে পড়লাম। আসলে আমাদের সকলের উচিত অসহায়দের পাশে গিয়ে একটু দাড়ানো কিন্তু আমরা এই কাজটি করি না। আপনার এই আর্টিকেল পড়ে ভাইয়া অনেক কিছু শিক্ষা নিলাম। অসংখ্য ধন্যবাদ ভাই আপনাকে কিছু শেখানোর জন্য।
আসোলেই ভাই আমাদের আশে পাশে গরীব মানুষদের বিপদে আমরা থাকতে পারিনা ।ব্যস্ততাই আমাদের আটকে দেয় ।সুধু নিজেদের নিয়েই পরে থাকি ।অসোহায়দের পাশে দাড়িয়ে সাহায্য সহোযোগি করার মন মানষিকতা হারিয়ে ফেলেছি ।এমন জীবনটাই বৃথা যে জীবনে অন্যের জন্য কিছু করতে পারিনা ।ধন্যবাদ ভাই খুব সুন্দর বিষয় সামনে তুলেধরে সজাগ করে দেওয়ার জন্য ।
আপনার প্রত্যেকটি গল্প খুবই শিক্ষনীয় ও বাস্তবধর্মী।তাছাড়া দরিদ্রদের কর্মজীবনে শুধুই ব্যস্ততা,চাইলে ও সাহায্য দেওয়া হয়ে ওঠে না অসহায়ত্বের কারনে।এভাবেই অলিতে গলিতে হাজারো দরিদ্র মানুষ রয়েছে।সুন্দর লিখেছেন ভাইয়া।ধন্যবাদ আপনাকে।