একটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ও দুটি স্বপ্নের মৃত্যু।১০% প্রিয় লাজুক খ্যাক এর জন্য।

in আমার বাংলা ব্লগ3 years ago (edited)

কেমন আছেন আমার বাংলা ব্লগের বন্ধুরা? আমি ভালো আছি। আশাকরি আপনারা ও ভালো আছেন।


অনিশ্চয়তা ভরা এই জীবনটা আমরা কত নির্ভাবনায় কাটিয়ে দিই। যেকোনো মুহূর্তে আমাদের জীবন প্রদীপ নিভে যেতে পারে। জীবনের মোড় যে কোন দিকে ঘুরে যেতে পারে। তারপরও আমরা এই গুলি নিয়ে কতটা সময় আর চিন্তা করি? মাঝে মাঝে চিন্তাটা মাথায় আসলেও পরক্ষনেই অন্য গল্পে মশগুল হয়ে যাই।

সাজানো-গোছানো মানুষের জীবন এক মুহূর্তে ওলট-পালট হয়ে যায়। এই ধরনের পরিস্থিতির জন্য আমরা কেউই প্রস্তুত থাকি না। তারপরও প্রতিনিয়ত কারো না কারো সাথে এমন ঘটনা ঘটেই যাচ্ছে। মানুষের জীবনটা এমনই। মানুষ ভাবে এক আর হয় আরেক। তেমনই একটি ঘটনা আজকে আপনাদের সাথে শেয়ার করব। দুর্ঘটনাটি অতি সম্প্রতি ঘটে যাওয়া আমার এলাকার একটি ঘটনা।

IMG_20210828_180433.jpg

স্থান- লিংক

আমার পরিচিত এক বড় ভাই যিনি পেশায় শিক্ষক। তিনি আবার বিভিন্ন রকম সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত। শিক্ষক মহলে তিনি বেশ জনপ্রিয়। খুবই বন্ধুবৎসল মানুষ তিনি। বন্ধুদের নিয়ে ঘুরে বেড়াতে, হুল্লোড় করতে, বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে তিনি অগ্রগামী। তিনি আবার খন্ডকালীন সাংবাদিকতা ও করেন দেশের স্বনামধন্য একটি ইংরেজী পত্রিকায়।

কিছুদিন আগে হঠাৎ করে শুনি ফরিদপুরে একটি নৌকা দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে। সেই নৌকায় হাই স্কুলের কয়েকজন শিক্ষক নৌকা ভ্রমণ করতে বেরিয়ে ছিলেন। দুর্ঘটনায় দু'জন শিক্ষক নিখোঁজ হয়েছেন। ধারণা করা হচ্ছে তারা হয়তো মারা গিয়েছে। পরে ভালোভাবে খোঁজখবর নিতে গিয়ে জানতে পারলাম আমার সেই বড় ভাই ও ওই নৌকাতে ছিলেন দুর্ঘটনার সময়। দুর্ঘটনায় তিনি আহত হলেও বেঁচে গিয়েছেন। দুর্ঘটনার পরের কিছু ভিডিও ক্লিপ ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখতে পেলাম। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার নিখোঁজ হয়ে যাওয়া শিক্ষক দুজনকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না।

ঘটনাটি আমাদের শহরে ব্যাপক চাঞ্চল্য তৈরি করে। সাধারণত নৌকাডুবিতে কোন মানুষ মারা গেলে কিছুটা দূরে তাদের লাশ পাওয়া যায়। কিন্তু যে দুজন নিখোঁজ হয়েছিল তাদের কোথাও পাওয়া যাচ্ছিল না। সমস্ত শহর জুড়ে শুধু একই আলোচনা যে তারা গেল কোথায়? আর তাদের পরিবারের লোকজন আশায় বুক বেধেছিলো যে হয়তো তারা জীবিত আছেন। যদি মারা যেতেন তাহলে তো তাদের লাশ পাওয়া যাওয়ার কথা। এর ভিতরে আমার ওই বড় ভাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিছুদিন অনুপস্থিত থাকার পরে আবারো উপস্থিত হলেন।

তখন তার কাছে জানতে পারলাম যে তিনি এবং তাঁর কিছু বন্ধু মিলে নৌকা ভ্রমণের পরিকল্পনা করছিলেন। তাদের পরিকল্পনা ছিল বিকালে কিছুক্ষণ নৌকায় করে পদ্মা নদীতে ঘোরাফেরা করবেন। কিন্তু এই সময়ে পদ্মা নদী থাকে খুবই অশান্ত। প্রচন্ড স্রোত থাকে আর বাতাস হলে অনেক বড় বড় ঢেউ সৃষ্টি হয়। তারা অল্প কিছু লোক হওয়ায় ছোট একটি ট্রলার ভাড়া করেছিলো। ট্রলারে করে তারা যথারীতি ঘুরতে বেরিয়ে ছিলো। বেশ অনেকটা সময় তারা পদ্মা নদীতে ঘোরাফেরা করে। বিকেলের স্নিগ্ধ হাওয়ায় নৌকায় করে নদীতে ঘুরতে খুবই ভালো লাগে। সে এবং তার বন্ধু-বান্ধবেরা নৌকাভ্রমণ খুবই উপভোগ করছিলো। ঘুরতে ঘুরতে একটা সময় প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এলো। তখন তারা সিদ্ধান্ত নিলো এখন ঘাটের দিকে ফিরে যাবে। তাদের বহনকারী ট্রলারটি তীরের দিকে আসছিল আস্তে আস্তে। তীরের কাছে লঞ্চ বা জাহাজ ভেড়ার জন্য একটি পন্টুন আছে। ওই জায়গাটা ছোট নৌকার জন্য খুবই বিপদজনক। কারণ সেখানে প্রবল স্রোত। এই স্রোতের ভিতরে পড়ে একাধিক নৌকা পানির নিচে তলিয়ে গিয়েছে। কিন্তু তারা ঘুনাক্ষরেও বুঝতে পারেনি তাদের সাথেও এই ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। দুর্ঘটনা ঘটার কিছুক্ষণ আগেও সবাই ছবি তোলা সেলফি নিয়ে ব্যস্ত ছিল। হঠাৎ করে নৌকাটি সেই পন্টুনের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় প্রবল স্রোতের টানে পন্টুনের সাথে বাড়ি খায়। ওই সংঘর্ষের ফলে নৌকায় থাকা শিক্ষকেরা ছিটকে নদীতে পড়ে যান।

ঘটনাটি ঘটেছিলো তীরের অনেকটা কাছাকাছি। এই দুর্ঘটনা দেখে আশেপাশের কয়েকটি নৌকা দ্রুত তাদের কাছে এগিয়ে যায় তাদেরকে উদ্ধার করার জন্য। নৌকা গুলিতে একে একে সবাই উঠে আসে। কিন্তু দুজনকে পাওয়া যায় না। এর ভেতরে বিভিন্ন জায়গায় এই দুর্ঘটনার খবর পৌঁছে গিয়েছে। ঘটনাস্থলে পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস, নৌবাহিনী ডুবুরি দল পৌঁছে উদ্ধার অভিযান শুরু করেছে। কিন্তু অনেক খোঁজাখুঁজির পরেও ওই দুজনকে পাওয়া যায়নি।

এভাবে একে একে কয়েকদিন পার হয়ে গেলো। সময় গড়িয়ে যায় আর তাদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা কমে আসে। এভাবে একসময় যখন সবাই তাদের পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছে। তখন হঠাৎ খবর আসে প্রায় ৫০-৬০ কিলোমিটার দূরে পদ্মা সেতুর একটি পিলারের কাছে একটি লাশ পাওয়া গিয়েছে। পুলিশ লাশ উদ্ধার করে মর্গে রেখে দিয়েছে।

সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে আমাদের শহরের লোকজন তার খোঁজ পায়। পরে পরিবারের লোকজন গিয়ে চিহ্নিত করতে পারে যে এই লাশটি নিখোঁজ হওয়া দুই শিক্ষকের একজনের। লাশ পাওয়ার আগ পর্যন্ত তার স্ত্রীর সন্তানেরা এই আশায় বুক বেঁধেছিলো হয়তো সে কথাও অসুস্থ অবস্থায় জীবিত আছে। কিন্তু লাশ পাওয়ার পরে দুঃখে তাদের বুক ভেঙে যায়। পরে সেই শিক্ষকের লাশ শহরে আনা হলে তার দাফনে প্রচুর মানুষের সমাগম হয়।

এরপর সিদ্ধান্ত নেয়া হয় অপর শিক্ষক এর গায়েবানা জানাযা পড়া হবে। গায়েবানা জানাযা পড়ার দু একদিন পরে সেই শিক্ষকের লাশ পাওয়া যায় ওই একই জায়গায়। যথারীতি তার স্ত্রী এবং পরিবারের লোকজন গিয়ে শরীরে জন্মদাগ দেখে তার লাশ সনাক্ত করেন। কারণ এতদিন পানিতে থাকার ফলে লাশ আর চেনার মত অবস্থায় ছিল না। তার লাশ ও যখন বাড়িতে নিয়ে আসা হয় সেখানে প্রচুর মানুষের সমাগম হয়।

এভাবে দুজন সম্ভাবনাময় শিক্ষকের দুর্ঘটনায় মৃত্যুতে শহরের মানুষজন শোকে মুহ্যমান হয়েছিলো। এমন অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু কারো কাম্য নয়। আমার এখনো তাদের তোলা সেই শেষ ছবিটার কথা মনে পড়ছে। মৃত্যুর মাত্র কয়েক মুহূর্ত আগে তারা হাসিমুখে ছবি তুলেছিলো। সবচাইতে অবাক করা ব্যাপার ওই ছবিতে এই দুজন শিক্ষক একে অপরের ঘাড়ে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন এবং এই দুজনেই একসাথে মারা গেলেন।

তাই সবার প্রতি আমার অনুরোধ ঘুরাফেরা করা ভালো। কিন্তু বিপদজনক জায়গা এড়িয়ে চলা বুদ্ধিমানের কাজ। এই বর্ষা মৌসুমে বাংলাদেশে প্রচুর নৌকাডুবির ঘটনা ঘটে। তাতে অনেক মানুষের প্রাণহানি হয়। যদিও এ নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। যদি এমন আইন করা হোতো যে যাত্রীবাহী সমস্ত নৌকা, লঞ্চ, ফেরি প্রত্যেকটা যাত্রীর জন্য লাইক জ্যাকেট বাধ্যতামূলক। তাহলে আশা করা যায় মৃত্যুর সংখ্যা অনেক কমে আসবে।

আজকের মতো এখানেই শেষ করছি।

আশা করি পোস্টটি আপনাদের ভালো লেগেছে।
পরবর্তীতে আপনাদের সাথে দেখা হবে অন্য কোন নতুন লেখা নিয়ে। সে পর্যন্ত সবাই ভাল থাকুন, সুস্থ থাকুন।


logo.png

Support @amarbanglablog by delegating STEEM POWER.
100 SP250 SP500 SP1000 SP2000 SP

🇧🇩🇧🇩ধন্যবাদ🇧🇩🇧🇩


@rupok


আমি রূপক। আমি একজন বাংলাদেশী। আমি বাঙালি। আমি বাংলায় মনের ভাব প্রকাশ করতে ভালোবাসি। আমি আমার বাংলা ব্লগ কমিউনিটিকেও ভালোবাসি।

Sort:  
 3 years ago 

ভাইয়া আপনার পোস্টটি পড়ে খুব খারাপ লাগলো।জীবন কত বিচিত্রময় আসলে, যে দুই মিনিট আগেও হেসে ছবি তুললো তার কি ধারণা ছিলো যে এটাই তার শেষ সময়!
আমাদের দেশে অনেক নৌকা ডুবি হয়। লাইফ জ্যাকেট আসলেই খুব বেশি দরকার। সুন্দর লিখেছেন ভাইয়া

 3 years ago 

ধন্যবাদ আপু আপনাকে।

 3 years ago 

খুবই মর্মান্তিক ঘটনা এটি।বাস্তব ঘটনাটি জেনে খারাপ লাগলো।মানুষের জীবন কত সল্প একদম দেশলাইয়ের জলন্ত কাঠির মতো।ধন্যবাদ ভাইয়া।

 3 years ago 

ধন্যবাদ আপনাকে দিদি।

 3 years ago 

খুব মর্মান্তিক একটি ঘটনা আমাদের মাঝে শেয়ার করেছেন ভাইয়া। আমি সেই নৌকাডুবিতে নিহত শিক্ষক-শিক্ষিকার আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। আমাদের দেশে প্রতিনিয়ত নৌকাডুবির ঘটনা ঘটছে। আপনি আমাদের প্রত্যেককে সচেতন করে দিয়েছেন যাতে আমরা বর্ষার মৌসুমে বিপদজনক এলাকায় নৌকা ভ্রমন না করি। আমাদের মধ্যে অনেকেই আছেন ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ার জন্য চলন্ত নৌকার ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় গিয়ে সেলফি উঠে। এটা ঠিক নয়। কারণ পৃথিবীতে সবচেয়ে দামি জিনিস হচ্ছে নিজের জীবন। আপনার জন্য অনেক অনেক শুভকামনা রইলো ভাইয়া।

 3 years ago 

আপনাকে ধন্যবাদ ভাই।

 3 years ago 

ভাইয়া আপনার পোস্টটি পড়ে খুবই খারাপ লাগলো খুবই মর্মান্তিক একটি ঘটনা। আসলে মানুষের জীবনটা খুবই বিচিত্র কখন যে কি হয় সেটা কেউ বলতে পারেনা। আপনার জন্য শুভকামনা রইল ভাইয়া।

 3 years ago 

ধন্যবাদ আপনাকে আপু।

 3 years ago 

অকালে এইভাবে মৃত্যু খুবই দুর্ভাগ্যজনক। এসব ঘটনা দেখলে বোঝা যায় আমরা কতটা ক্ষণস্থায়ী। অসাবধানতায় যেকোনো মুহূর্তে মর্মান্তিক কিছু ঘটে যেতে পারে। তবে একজন শিক্ষক হয়ে ভরা নদীতে ঘুরতে গেলেন কেন সেটাতেই আমি বেশি অবাক।

 3 years ago 

দাদা ওই শিক্ষক পদ্মা পাড়ের ছেলে। কিন্তু যখন দুর্ঘটনা ঘটে যায় তখন আর কিছুই করার থাকে না। ধন্যবাদ দাদা।

খুবই দুঃখজনক ঘটনা। এর জন্য বিকল্প কোনো উপায় বের করা উচিত। খুব সুন্দর ভাবে লিখেছেন। ধন্যবাদ আপনাকে।

 3 years ago 

ভাইয়া আপনার পোস্টটি পড়ে অনেক খারাপ লাগলো। বিপদ কখন এসে যায় সেটা কখনো বোঝা যায় না। এভাবে দুর্ঘটনায় হারিয়ে যায় হাজারো জীবন। নিভে যায় জ্বলন্ত জীবন প্রদীপ।

Coin Marketplace

STEEM 0.18
TRX 0.14
JST 0.029
BTC 57305.83
ETH 3076.79
USDT 1.00
SBD 2.40