মাজেদা বানুর দীর্ঘশ্বাস।

in আমার বাংলা ব্লগ3 years ago (edited)

রুনু বলে উঠলোঃ হুদা ভাত খাইতে ভালা লাগে না মা।
রুনুর পাতে রয়েছে সামান্য কিছু ভাত, একটা মরিচ, একটা পেঁয়াজ, আর একটু লবণ। এই তাদের রোজকার খাবার। মাঝেমধ্যে রুনুর মা মাঠ ঘাট থেকে খুঁজে খুঁজে কচু শাক বা পাট শাক এই জাতীয় খাবার নিয়ে আসে।সেই বেলা গুলো তাদের একটু ভালো খাওয়া হয়।
রুনুর মা মাজেদা বানু অসহায় কন্ঠে বলে ওঠেঃ যা আছে খায়া ল মা, জিদ করিস না। তোর লাইগা আমি মাছ,গোশ কই থিকা আনুম?
উত্তরে রুনু বলেঃআইজকা রবি গো বাড়িত গরুর গোশত রানছে। আমি গরুর গোশত খামু মা।
রুনুর মা বলেঃগরুর গোসের তো মেলা দাম। আমি কই থিকা আনুম? নিজের অসহায়ত্বের কথা চিন্তা করে মাজেদা বানুর দুচোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে নামে।



সাংসারে সর্বমোট ৭ জন মানুষ। মাজেদা বানু, তার অসুস্থ হয়ে ঘরে পড়ে থাকা পঙ্গু স্বামী, আর পাঁচটি সন্তান। এত বড় সংসার শুধু মাজেদা বানুর সামান্য আয়ে চলছে। মাজেদা বানু কাছের শহরে গিয়ে ময়লা আবর্জনা থেকে প্লাস্টিকের বোতল কুড়িয়ে ভাঙ্গারির দোকানে বিক্রি করে। তা থেকে দিনে ১০০ টাকা মতো আয় হয়। এই সামান্য কটা টাকা দিয়ে মাজেদা বানুকে তার এত বড়ো সংসার চালাতে হয়। এই টাকা দিয়ে এতগুলো লোকের তিন বেলা আহার ও জোটে না। কোনরকমে দুবেলা আধপেটা খেয়ে তারা বেঁচে আছে। এর ভিতর থেকে মাজেদা বানু কিভাবে তার সন্তানদের জন্য মাছ-মাংসের ব্যবস্থা করবে?

poverty-and-hunger-india2.jpg

ছবির সোর্স-লিংক

মাজেদা বানু রুনুকে খুশি করার জন্য বলেঃ আর একটু ধৈর্য্য ধর। কিছুদিন পর কুরবানীর ঈদ। তখন পেট ভইরা গরুর গোস্ত খাওয়ামুনে।

রুনু খুশি হয়ে ওর মাকে জিজ্ঞেস করেঃ কোরবানি ঈদ আইতে আর কতদিন বাকি মা?

মাজেদা বানু বলেঃএই তো আর মাত্র দুইডা মাস।
রুনু খুশি হয়ে খাওয়া শুরু করে।

মাজেদা বানুর তখন হঠাৎ করে পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে যায়। রুনুর বাপ তখন কর্মক্ষম ছিলো। সে রিকশা চালাতো। মাঝেমধ্যে যখন ভাল আয় হতো, তখন সে বাড়ি ফেরার সময় মুরগি বা কোন মাছ নিয়ে আসতো। তখন তাদের এত কষ্ট ছিলো না। সর্বনাশা সড়ক দুর্ঘটনা তাদের জীবনটাকে সম্পূর্ণ এলোমেলো করে দিয়েছে। পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে মাজেদা বানুর বুক চিরে এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। এত বড় সংসারের বোঝা টানতে টানতে সে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।

এসব কথা চিন্তা করতে করতে মাজেদা বানু তার খাওয়া শেষ করে। খাওয়া শেষ হলে সবগুলো বাচ্চাকে ঘুম পাড়িয়ে সে নিজেও ঘুমিয়ে পড়ে। তার যে আবার সকাল সকাল কাজে বের হতে হবে। নইলে যে কালকে সবাইকে অভুক্ত থাকতে হবে।

পরদিন সকালে মাজেদা বানু ঘুম থেকে উঠে তাড়াতাড়ি কাজে বের হয়ে যায়। যাওয়ার আগে সে তার সন্তানদেরকে বলে যায় পাতিলে ভাত রাখা আছে খায়া নিস। গত রাতে যে ভাত রান্না করেছিল মাজেদা বানু তার থেকে কিছু ভাত বাঁচিয়ে রেখেছিল আজ দুপুরে খাওয়ার জন্য। এই ভাত খেয়ে পরিবারের সদস্যদের আজকের দিন কাটাতে হবে। মাজেদা বানু নিজে অভুক্ত অবস্থায় কাজে যায়। সারাদিন প্রায় অনাহারে থাকে। শুধু দুপুরবেলায় ৫ টাকার এক কাপ চা আর একটা রুটি খেয়ে সারাটা দিন কাটিয়ে দেয়।

মাজেদা বানু যখন কোন খাবার হোটেলের পাশ দিয়ে যায় তখন ভালো খাবারের সুগন্ধে পেটের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। তখন তার সন্তান গুলোর কথা মনে পড়ে যায়। ইস সন্তানগুলোকে যদি একটু ভালোমন্দ খাওয়াতে পারতাম। এভাবেই তার দিন কেটে যাচ্ছিলো।

দেখতে দেখতে কোরবানির ঈদ চলে আসলো। ঈদের আর মাত্র দু দিন বাকি। রুনু প্রতিদিন তার মাকে জিজ্ঞেস করে মা আর কয়দিন বাকি? যখন তার মা বলল আর মাত্র ২ দিন বাকি আছে। তখন রুনুর খুশি আর ধরে না। অবশেষে চলে এলো সেই ঈদের দিন। সকালে উঠে রুনু ওর মার কাছে বায়না ধরল আমিও তোমার লগে যামু মা।ওর মা বলল তোরে নেওন যাইবো না। মাংস আনতে গেলে অনেকের লগে ধাক্কাধাক্কি করতে হয়। তুমি ব্যথা পাইবা মা। অগত্যা রুনু বাড়ি রয়ে গেলো। রুনুর মা একটা ব্যাগ হাতে পাশের গ্রামে রওনা দিলো। কারন তাদের গ্রামে কেউ কোরবানি দিচ্ছে না। তাদের গ্রামের বেশির ভাগ লোকজনই হতদরিদ্র। তাদেরই মতো।

এই জন্য পাশের গ্রামে চৌধুরী বাড়িতে গরু কুরবানী হবে। এই খবরে তাদের গ্রামের সবাই সকাল হতেই সেই বাড়ির আশেপাশে ঘুরঘুর করতে থাকলো। রুনুর মার একটু চিন্তা হতে লাগলো। এত লোকের ভিতর সে কি মাংস ভাগে পাবে? তাছাড়া বেশিরভাগ পুরুষ মানুষ এসেছে মাংস নিতে। এদের সাথে ধাক্কাধাক্কি করে শেষ পর্যন্ত সে কি মাংসের কাছে পৌঁছাতে পারবে। বাড়ির আশেপাশে অনেক লোকজনকে ঘোরাফেরা করতে দেখে চৌধুরী বাড়ির কাজের লোক সবাইকে বলল কোরবানির মাংস বিলি করতে দেরি হবে। সবাই পড়ে আসো। যার ফলে সবাই একটু আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো। অতঃপর গরু কুরবানী হয়ে গেলো। সবাই অপেক্ষা করছে কখন মাংস কাটা শেষ হবে? কখন মাংস বিলি শুরু হবে? মাংস বিলি করা যখন শুরু হলো তখন সবাই হুড়মুড় করে দৌড়ে গিয়ে মাংস বিলি করার ওইখানে গিয়ে ঘিরে দাঁড়ালো।রুনুর মা পুরুষ মানুষের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি করে মাংস আনার অনেক চেষ্টা করলো। কিন্তু সে মাংসের কাছে পৌঁছানোর আগেই মাংস বিলি করা শেষ হয়ে গেলো। চৌধুরী বাড়ির লোকজনের কাছে অনেক অনুনয় বিনয় করল একটু মাংসের জন্য। তারা সাফ জানিয়ে দিল দরিদ্র মানুষের জন্য যতটুকু মাংস ছিল ততটুকু বিলি করা হয়ে গিয়েছে। এখন আর এক টুকরো মাংসও দেয়া সম্ভব নয়। অথচ রুনুর মা দেখল বড় বড় হাড়ি ভরে মাংস বাড়ীর ভেতরে নিয়ে যাচ্ছে। অথচ তাদের পরিবারের লোক মাত্র ৬ জন।এতো মাংস তারা ছয় মাসেও খেয়ে শেষ করতে পারবেনা। রুনুর মা তখন নিরুপায় হয়ে তাদের বলল এত মাংস বাড়ির ভিতরে নিতাছেন আমারে একটু দিলে আপনাদের কি হইবো? একথা শুনে চৌধুরী বাড়ির কাজের লোক দূর দূর করে সেখান থেকে তাকে তাড়িয়ে দিলো।

রুনুর মা দুঃখে অপমানে কাঁদতে কাঁদতে সেখান থেকে বাড়ি চলে এলো। মাকে দেখে রুনু দূর থেকে দৌড়ে কাছে এসে মার হাত থেকে ব্যাগটা টান দিয়ে নিয়ে নিলো। ব্যাগটা খুলে ভিতরে তাকিয়ে রুনু ব্যাগটা ছুড়ে ফেলে দিলো। তারপর এক দৌড়ে বাড়ির ভেতরে চলে গিয়ে কান্না জুড়ে দিলো।

রুনুর মা বসে বসে ভাবতে লাগলো শুনেছি যে ঈদ মানে সবার সাথে আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয়া। কুরবানী দেয়ার প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে মনের পশুত্বকে কুরবানী দেয়া। বাহিরের পশুকে কোরবানি দেয়াতো প্রতীকী কুরবানী। গরিব মানুষকে না দিয়ে কোরবানির মাংস ফ্রিজে ভরে রাখা। এটা কেমন কুরবানী? আকাশের দিকে তাকিয়ে রুনুর মার বুক চিরে এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।(সমাপ্ত)


আজকের কত এখানেই শেষ করছি। আশাকরি গল্পটা আপনারা উপভোগ করবেন।

Cc- @rme

Sort:  
 3 years ago 

অনেক বাস্তবিক একটা গল্প তুলে ধরেছেন। যাইহোক শেষের দিকটাতে পড়ে অনেকটা হৃদয়ে আঘাত লেগেছিল । যাইহোক শুভেচ্ছা রইলো আপনার জন্য।

 3 years ago 

আপনার কমেন্ট এর জন্য অনেক ধন্যবাদ শুভ ভাই। আপনি যে ধৈর্য্য ধরে গল্পটা পড়েছেন তাতেই আমি খুশি।

খুব দামি কথা লিখেছে। ধন্যবাদ আপনাকে

 3 years ago 

আপনাকে ও অসংখ্য ধন্যবাদ।

Coin Marketplace

STEEM 0.20
TRX 0.12
JST 0.028
BTC 64310.07
ETH 3504.54
USDT 1.00
SBD 2.49