কুঞ্জবিহারীর নিকুঞ্জ - পর্ব ০১

in আমার বাংলা ব্লগ3 years ago (edited)


copyright free image source pixabay


এক


গ্রামের নাম বাতাসপুর । এই গ্রামের সব চাইতে চমকপ্রদ ব্যক্তিত্ব হলেন কুঞ্জবিহারী বাবু । তিনি এই গ্রামের বিখ্যাত সায়েন্টিস্ট । গ্রামের মানুষ তাঁর কান্ডকারখানায় প্রায়শই অবাক হয়ে যায় । অবশ্য আগে যেমন গ্রামের মানুষ ঘন ঘন অবাক হতো এখন আর তেমন একটা হয় না । আরে বাপু অবাক হওয়ার একটা লিমিট আছে তো, নাকি ? প্রায় প্রত্যেক রবিবার কুঞ্জবিহারী বাবুর বৈঠকখানা গম গম করে মানুষে । আর তিনি তাঁর লেটেস্ট এক্সপেরিমেন্ট সবার কাছে জাহির করেন । সেই সাথে চলে চা জলখাবারের ঢালাও ব্যবস্থা । নিন্দুকেরা অবশ্য রটায় কুঞ্জবিহারী বাবুর রবিবারের বৈকালিক ও সান্ধ্য মজলিশ এতো জমজমাট হওয়ার মুলে রয়েছে তাঁর বাড়িতে ভাজা ডালপুরি, সিঙ্গাড়া, আলুর চপ, মাছের ডিমের চপ আর মোচা-চিংড়ির বিখ্যাত চপ; সাথে চা চলে এন্তার ।

কুঞ্জবিহারী বাবুরা সাত পুরুষের জমিদার ছিলেন । কুঞ্জবিহারীর দাদু অগাধ সম্পত্তি রেখে গেছেন, ছেলেরা সুপ্রতিষ্ঠিত । কুঞ্জবিহারী বাবু জীবনে কোনো কাজ-কর্ম কিছুই করেননি । শুধু এন্তার কল্পবিজ্ঞানের বই পড়ে গেছেন, আর অজস্র আবিষ্কার করে গেছেন ।স্ত্রী, ছেলে-বৌমা, নাতি-পুতি নিয়ে সে এক বিরাট চাঁদের হাট । নিন্দুকেরা বলে কুঞ্জবাবুর বিজ্ঞান সম্পর্কে জ্ঞান অতি সামান্য । সেই সামান্য জ্ঞান কাজে লাগিয়ে তিনি অসাধারণ সব আবিষ্কার করে গেছেন ।

এই যেমন তাঁর বড় নাতি ক্লাস টু'য়ে উঠলে একদিন তার দাদুকে বললো যে, "জানো, দাদু আমরা যে জল খাই তা আসলে হাইড্রোজেন আর অক্সিজেন নামক দুটো গ্যাস মিলিয়ে তৈরী হয়েছে ।" শুনেই কুঞ্জবিহারী বাবুর ভাবান্তর । অনেক ভেবেচিন্তে তিনি একটা কল তৈরী করলেন । কলটার কাজ হলো জলকে বিশ্লেষণ করে অক্সিজেন আর হাইড্রোজেনে পরিণত করা ।তিনি ভেবে দেখলেন, অনেক রোগী অক্সিজেনের সংকটে কষ্ট পায়, হাসপাতালে নিয়ে তাঁদের অক্সিজেন দেয়া লাগে । অনেক ঝকমারি । তাই তিনি তার সরল যন্ত্রে সকল সমস্যার সমাধান করে দেবেন ।

রাত ন'টায় তাঁর দক্ষিণের ঘরে ডাক পড়লো বড় ছেলে অর্চিষ্মানের । অর্চিষ্মান হলেন একটা নামকরা কলেজের কেমিস্ট্রির অধ্যাপক । বাপকে যমের মতো ভয় পান । তিনি ঘরে ঢোকার পরে কিছুক্ষন বাঘের দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলেন কুঞ্জবিহারী বাবু । তারপরে বাঘাটে গলায় বললেন, "অপদার্থ ।"

"আজ্ঞে !", ভয়ে থতমত খেয়ে বললেন অর্চিষ্মান ।

"সারাদিন কি করো তুমি ? তুমি না একজন কেমিস্ট্রির প্রোফেসর ? কত মানুষ বিনা অক্সিজেনে মারা যাচ্ছে আর তুমি একটা অক্সিজেন তৈরির কল বানাতে পারলে না ?", আবার হুঙ্কার কুঞ্জবিহারী বাবুর ।

"আজ্ঞে এটা তৈরী করতে হলে অনেক হ্যাপা আছে, অনেক সুক্ষ যন্ত্র কি না । অনেক খরচের ব্যাপারও আছে ।"

"কচু !! অপদার্থ । কিছুই জানো না তুমি । ওই দেখো আমি তৈরী করেছি । অতি সরল যন্ত্র । অক্সিজেন জলে থাকে । আমি জল থেকে ছেঁকে বের করেছি ।"

যন্ত্রটা টেবিলের উপরেই ছিলো । সেদিকে বিস্ফারিত চোখে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে শিউরে উঠলেন অর্চিষ্মান ।

"কেমন দেখছো ?"

"আজ্ঞে, খুবই ভালো ।"

"শুধুই ভালো ?"

"আজ্ঞে, অতি প্রয়োজনীয় কাজের জিনিস ।"

"হুম , আচ্ছা যাও ।"

হাত নেড়ে তিনি তাঁর বড়ছেলেকে যাওয়ায় অনুমতি দিলেন । বেশ একটা আত্মতৃপ্তি অনুভব করলেন কুঞ্জবাবু । বরাবরের মতো এবারও তাঁর প্রজেক্ট চারিদিকে সাড়া ফেলে দেবে । তিনি বেশ বুঝতে পারছেন সেটা ।

পরের দিন রবিবারের বিকাল বেলা । যথারীতি চারিদিকে হুলুস্থূল । কুঞ্জবাবু গম্ভীর ভাবে তাঁর বৈঠকখানায় বসে আছেন । অক্সিজেন বিশ্লেষণের যন্ত্রটা তাঁর সামনের টেবিলের পরে রাখা । সবাই আশ্চর্য হয়ে গেছে একেবারে ।

বাতাসপুরের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের হেডমাস্টার পরেশনাথবাবু যথারীতি এসে যন্ত্রটা দেখার পরে ফিট । তাঁর মাথায় জল ঢালা হচ্ছে । স্কুলের পদার্থ বিজ্ঞানের ছোকরা শিক্ষক এসে যন্ত্রটা দেখার পরে সমানে হিক্কা উঠছে তাঁর, কিছুতেই থামছে না । কেমিস্ট্রির শিক্ষক গৌরগোপালবাবু যন্ত্রটার দিকে একবার তাকাচ্ছেন পরক্ষনেই শিউরে শিউরে উঠছেন । গ্রামের একমাত্র হোমিওপ্যাথ ডাক্তার বিমলবাবু বাহ্যজ্ঞান শূন্য হয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাচ্ছেন যন্ত্রটার দিকে । রক্তাম্বর পরিহিত কাপালিক ব্যোমকালী যন্ত্রটা একবার দেখছে, আর পরমুহূর্তেই "ব্যোম কালী....ব্যোম কালী" বলে হুঙ্কার ছাড়ছে ।

শুধু গাঁয়ের বোষ্টুম গয়েশ্বর গোসাঁই ফিক ফিক করে হাসছে । কুঞ্জবাবুর ছোটবেলাকার বন্ধু সে । হঠাৎ গয়েশ্বর জিজ্ঞেস করে বসলো, "কুঞ্জ, তোমার যন্ত্র টা কাজ করে কি করে ?"

"তুমি তো বোষ্টুম, কি বুঝবে এ সবের ? হুঁ হুঁ বাবা এর নাম সায়েন্স ।"

"একটু বুঝিয়ে দাও না !"

"ঠিক আছে, যত্ত সব গোমুখ্যু । ওই যে বড় জার্ টা দেখছো ওতে আছে খাবার জল । আর ওই দ্যাখো দুটো নল চোবানো আছে জারে । জলের নিচে দেখো একটা হাওয়া পাম্প করার নল ঢোকানো আছে । মুকুন্দ আমার বড় নাতির সাইকেলের পাম্প দিয়ে জলে অক্সিজেন পাম্প করছে । জলের অক্সিজেন ফুরোবে না তাহলে । আর এই ছোট্ট মোটর দিয়ে জলের বাস্প ছিটিয়ে দিচ্ছি নলের মধ্যে । একটা নল দিয়ে অক্সিজেন বেরোচ্ছে, আর অন্যটা দিয়ে হাইড্রোজেন । হুঁ হুঁ বাবা এর নাম সায়েন্স । বুঝলে ?"

বোকা হারান মাস্টার জিজ্ঞেস করলো, "কুঞ্জবাবু, যে অক্সিজেন তৈরী করলেন, সেটা কোথায় ?"

"আরে বোকা, অক্সিজেন কি চোখে দেখা যায় ? ওটা তো বাতাস । আমি যে অক্সিজেন তৈরী করছি সেটা ওই নল দিয়ে বেরিয়ে এসে আবার আমার ওই জারের জলে মিশছে । আবার জল থেকে অক্সিজেন তৈরী হচ্ছে । তাই তো দেখছো জল কমছে না ? একই আছে ।"

কুঞ্জবাবুর ব্যাখ্যা শুনে হেডমাস্টার পরেশনাথ আবার ফিট, এই মাত্র তার জ্ঞান হয়েছিল । সঙ্গে সঙ্গে এসে পড়লো পুরি, চপ, সিঙ্গাড়া ঝুড়ি ভর্তি, সঙ্গে গরমাগরম চা । লোকজন সব হৈ হৈ করে উঠলো । আসর নিমেষে জমে গেলো ।


[ক্রমশ:]

Sort:  

Good!

 3 years ago 

সত্যি তো আমার স্বামীর তো লিখার হাত আছে এটা মানতেই হবে। অনেক সুন্দর একটি গল্প লিখেছো।

 3 years ago 

বাহ ভাবি বেস্ট কমেন্ট ছিল। দাদার সত্যি খুব পছন্দ হবার মতন একটা কমেন্ট আমার মনে হয়। নিজের কাছের মানুষের একটা প্রশংসা সত্যি খুব ভালো লাগে।

 3 years ago 

বেশ মজা পাচ্ছি দাদা গল্পটা পড়ে। পরবর্তী পর্বের জন্য অপেক্ষায় রইলাম। লেখক হিসেবে আপনি খুবই বৈচিত্র্যপূর্ণ। দারুন দাদা।

 3 years ago 

বেশ ভালো লিখেছো।

 3 years ago 

কুঞ্জবাবু বিজ্ঞান না বুঝলেও প্রযুক্তিটা বেশ ভালোই বোঝেন। কুঞ্জবাবুর কাজগুলো বেশ ভালোই মনে হচ্ছে। কিন্তু পরে কোনদিকে গড়াবে কুঞ্জবাবুর চিন্তা ভাবনা সেটাই দেখার বিষয়। পরবর্তী পর্বের জন্য অপেক্ষায় থাকলাম।

Vai amar id ta verify kore dan. Plz

 3 years ago 

রোমান হরফে বাংলা লেখা নিষিদ্ধ ।

 3 years ago 

বেশ মজার গল্প দাদা।
শেষে এসে বিরাট একটা ধাক্কা খেলাম মনে হলো,কি থেকে কি লিখে ফেললেন!!আপনার লিখার লেভেল দিন দিন বাড়ছে আর বাড়ছে।
জাস্ট অসাধারণ হয়েছে।

অনেক সুন্দর একটা গল্প লিখছেন দাদা।পড়ে আমার অনেক ভালো লাগলে।পরের গল্পের জন্য অপেক্ষায় রইলাম দাদ।

 3 years ago 

অনেক অনেক সুন্দর হয়েছে দাদা, খুবই উপভোগ করেছি। আজ থেকে একটি ব্যতিক্রমী মজার গল্প শুরু হলো, সত্যি খুবই চমৎকার লিখেছেন, অনেক ভালো লেগেছে।

Coin Marketplace

STEEM 0.20
TRX 0.13
JST 0.029
BTC 67475.08
ETH 3475.54
USDT 1.00
SBD 2.65