সুন্দরী সুন্দরবন(পর্ব-২) (১০% @shy-fox এবং ৫% @abb-school এর জন্য)

in আমার বাংলা ব্লগ2 years ago (edited)

তারিখ-১০.০৯.২০২২

নমস্কার সকলকে!

আশা করি সবাই ভালো আছেন। ঈশ্বরের আশীর্বাদে আমিও ভালো আছি।আজ নিয়ে চলে এলাম 'সুন্দরী সুন্দরবনের' দ্বিতীয় পর্ব নিয়ে।

7ba42fbf-111d-422b-8edb-4d9c5c20abd7.jfif

আগের দিন তো খাওয়া দাওয়া করে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বিছানায় পড়ার সাথে সাথেই। পরের দিন ঘুম ভাঙলো ভোর ৫.৩০ টায়। জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি চরম বৃষ্টি হচ্ছে সাথে খুব হাওয়া।মাথায় হাত সবার! এই বৃষ্টি আর হাওয়া চলতে থাকলে নদীতে কোন ভাবেই লঞ্চ যাবে না হয় তো।আমরাও ভাবলাম যা হওয়ার হবে অন্ততঃ ব্রাশ করে রেডি তো হয়ে নি। এবার আমরা চারজন ব্রাশ করে,হাত মুখ ধুয়ে, রেডি হয়ে গেলাম।আমাদের ক্যাপ্টেন তন্ময় চলে এলো তার মধ্যেই চা বিস্কুট নিয়ে।আমায় দেখেই প্রথম মন্তব্য, "আরে ম্যাডাম আর পাউডার মাখতে হবে না!" কটমট করে তাকালাম ওর দিকে। হেঁহেঁহেঁ করে একটা ক্যাবলাকান্ত হাসি দিয়ে পালিয়ে গেলো।যাওয়ার আগে বলে গেলো ৮টার মধ্যে নীচে নেমে আসবেন ম্যাডামরা।

80093e22-be81-4f45-9e97-4df49088697f.jfif

আমরাও তাড়াতাড়ি নীচে গিয়ে অপেক্ষা করতে থাকলাম আমাদের বাকি সহযাত্রীদের। কিছুক্ষণ পর হেলতে দুলতে বাকিরা এলো। এবার কিছুক্ষণ পর আমাদের লঞ্চ 'আফিয়ান'কে নিয়ে রওনা দিলো মিঠু মাঝি।আজ আমরা ঢুকব কোর জঙ্গলে।প্রবল আশা মনে যদি এই অফ সিজনেও কোন বাঘ মামার দেখা পাওয়া যায়।এবার চলতে চলতেই আমাদের টিফিন দেওয়া হল রাধাবল্লভ,চানা মশলা আর কড়া পাকের সন্দেশ।খাওয়া দাওয়া করে কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা পৌঁছলাম সজনেখালী স্যাংচুয়ারিতে।

d0b0b6f5-2152-4ab5-8842-526059798cdb.jfif
b151248d-b8bb-4a63-a029-3dd4100f9db1.jfif

সজনেখালী ঢোকার আগেই তন্ময় আমাদের বলল, "ম্যাডাম ব্যাগ রেখে যাবেন।বাঁদরের বড় উৎপাত ছিনিয়ে নিলে আমাকে বলবেন না। " আমরা ভাবলাম বড় ব্যাগ রেখে গেলেও টাকা পয়সা, আই কার্ড, রুমাল, লিপস্টিক, মোবাইল নেওয়ার ব্যাগটা রেখে গেলে তো চলে না।তাই ওটাকে বুকে আঁকড়েই সাহস করে ঢুকলাম সজনেখালী তে। ঢুকেই আমাদের জন্য গাইড অ্যালট করা হল যে আমাদের সারাদিন সব দেখাবে, বলবে।ছেলেটির নাম সুকান্ত। লোকাল ছেলে। বিগত ১০ বছর ধরে সে এই গাইডের কাজ করছে।সুন্দরবনের গাইড হতে গেলে মিনিমাম গ্রাজুয়েট হতে হয়, সাথে লোকাল বাসিন্দা।একটা টিম কে ঘুরিয়ে ওরা ৬০০ টাকা পায়। আর সেই টাকাও সব গাইডের মাঝে ডিস্ট্রিবিউট হয়।

d2f3035e-b5d9-4898-9b74-d1c235941986.jfif

এবার সজনেখালীতে আমাদের ঘোরাফেরা শুরু হল।সেখানে ওয়াচটাওয়ারে উঠে ঘন জঙ্গল দেখলাম। যেদিকেই চোখ ফেলছি সেদিকেই কালচে সবুজ জঙ্গল। বার বার মন ভাবছিল যে প্রকৃতি মায়ের কি অপার খেলা! কোলকাতার সেই গ্যাঞ্জাম, কোলাহলের বাইরে এখানকার বন্য প্রাণী হোক বা মানুষ কতটা আদরের সাথে প্রকৃতি মায়ের কোলে লালিত পালিত হচ্ছে অবুঝ শিশুর ন্যায়।এইসব ভাবছি হঠাৎ করেই এক কাকু দেখলাম তিড়িং করে লাফ মারল। কিছুক্ষণ পর বুঝলাম এক বাঁদর ওনার ব্যাগ ছিনতাই করার চেষ্টা করেছিলো🤣

82035170-fdc2-416b-93c4-770c6bbac0b0.jfif

ওয়াচটাওয়ারে থেকে নামার সময় এক বিশাল মৌচাকের দর্শন।মানে বদমায়েশি করে কেউ যদি ওতে ঢিল একটা ছোড়ে, তাহলে আমাদের বাঁচা অসম্ভব।বাঘের পেটে যাই বা না যাই মৌমাছি মেরে ফেলবে।তো আর সেখানে অপেক্ষা না করে তাড়াতাড়ি নামলাম ওয়াচ টাওয়ার থেকে। নেমে পুকুরে দুটো বাচ্চা কুমীরের দর্শন হল। তাদেরও সে কি অ্যাটিটিউড! খালি চোখটুকু বার করে আছে। যেন আমরা ছেলেপক্ষ পাত্রী দেখতে এসেছি বিয়ের জন্য আর পাত্রী লজ্জায় ঘোমটার আড়ালে আছে।

f75c683d-19e9-49b5-8921-15f3f648a1fb.jfif
3d9c3d43-584c-41cb-845c-7a61cdf21a1b.jfif

এবার এই লজ্জাবতী কুমির দেখে গোলপাতা গাছ আর সুন্দরীগাছ দেখলাম। আমাদের গাইড জানালো সুন্দরী গাছের কাঠ থেকে ভালো আসবাবপত্র তৈরী হয় নাকি। এসব দেখে টেখে আমরা বোটে উঠলাম।

34f0ba6a-44a9-4eaa-903e-73e742238cd1.jfif
b5c9aa20-d8af-4f2b-93d5-7cbafd684359.jfif

এবারের ডেস্টিনেশন হল দোঁবাকী স্যাঙচুয়ারি।আসার পথে গাইড কিছু গাছ দেখালো সবুজ আর হলুদ রঙের যার পাতাগুলো নারকেল পাতার মত সরু সরু, জানালো বাঘ সাধারণত ওই সব গাছের আড়ালে থেকেই আক্রমণ করে। সারা বিশ্বে একমাত্র রয়াল বেঙ্গল টাইগারই হল 'ম্যান ইটার', আরো জানালো বাংলাদেশ ও ভারত মিলিয়ে মোট ১৫০-২০০ কাছাকাছি বাঘ আছে সুন্দরবনে, বছরে একই সময়ে দুই দেশ গননা কাজ শুরু করে আর তখনই বোঝা যায় মোট বাঘ সংখ্যা কত বা কত বাড়লো। আর খুশির খবর এটাই যে বর্তমানে বাঘের সংখ্যা বাড়ছে।আমি জিজ্ঞাসা করলাম যে গননার সময় একটা বাঘকে দুবার গুনে ফেলে না ভুল করে? ও জানালো যে না, ওই ভাবে হয় না কারণ প্রতিটা বাঘের গায়ে যে দাগ থাকে তা আলাদা আলাদা।তাতেই তাদের আলাদা করা যায়।

1d75c58f-5980-4146-a3ca-c51104e5f01d.jfif

ওদের সভাবও ভীষণ রয়্যাল হয়। ওরা একগুচ্ছ মানুষের মধ্যে টার্গেট করে নিতে পারে যে কে অন্যমনস্ক আছে এবং দুর্বল আছে, তার উপরেই অ্যাটাক করবে। আর যদি কোন কারণে যাকে অ্যাটাক করল সে পার পেয়ে যায় তবুও পাশের লোক কে ধরবে না।ঠিক রাজার মতই।কিন্তু ওর টার্গেট কখনওই মিস্ হয় না। ৯৯% ও যাকে টার্গেট করবে তাকে ধরবেই। মোটামুটি ৭ ফুট লম্বা হয় আর ২০ ফুট পর্যন্ত লাফ দিতে পারে। এসব মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম।তারপরই ঢোঁকগিলে পারের দিকে তাকিয়ে দেখলাম যে ২০ ফুট দুরত্বে আছি নাকি কম দূরত্বে! বাইরে থেকে নাকি যখন কেউ ঘুরতে আসে অনেকেই ওদের নামকরণ করে যায়। যেমন একটা পপুলার বাঘ হল, "নান্টু"! এবার ছন্দপতন হল! তুই কোথায় একটা রয়াল বেঙ্গল টাইগার আর তোর নাম দেবে কি না 'নান্টু'? শুনেই তো কেমন কলের মিস্ত্রি মনে হচ্ছে! 🙄

amazing-bengal-tiger-nature_475641-1205.jpg
Image Source

প্রায় ৪ঘন্টা লঞ্চ চলারপর আমরা দোঁবাকী তে পৌঁছলাম।শক্ত লোহার নেট দিয়ে ঘেরা পথ। অর্থাৎ আমরা নেটবন্দী আর পশু পাখিরা খোলা জায়গায় রয়েছে।ঠিক রিভার্স চিড়িয়াখানা।এখানে এসে ওয়াচ টাওয়ারে উঠে বিশেষ লাভ হল না। বাঘ মামা অফ সিজনে নেই।কয়েকটা হরিনের দর্শন হল।যদিও মনটা একটু খারাপ লাগছিলো, তবুও প্রাকৃতিক পরিবেশ আর নদীতে যাত্রা মন ভালো করে দিলো।

a31f4b8b-b579-431d-a3fe-9395c4db1a8f.jfif
367163fa-d78f-492d-9d10-b4d345ec3fbd.jfif
dc2c7714-3296-4cf4-b04a-b402df1fde8d.jfif

এবার লঞ্চে চাপলাম।দুপুরের খাবার সময় গড়িয়ে এলো। খাওয়া দাওয়া হল ভাত, ডাল, আলুভাজা,ইলিশ পাতুরি, ইলিশের টক, চাটনী পাঁপড়। আর ব্রাঞ্চে দেওয়া হয়েছিলো চিংড়ির পকোড়া আর চা।লাঞ্চ যখন করছি তখনই লঞ্চ পৌঁছালো পঞ্চমুখীতে। অর্থাৎ এই জায়গায় পাঁচটা নদী একসাথে হয়ে ৬৫ কিলোমিটার দূরে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। আর একটা কথা আমরা যে নদীতে চলাফেরা করছিলাম তার নাম শুরুতে মাতলা ও পরে বিদ্যাধরী নিয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে।

এবার বলি আসল কথা পঞ্চমুখীতে যেই লঞ্চ পৌঁছেছে তা রীতিমতো ঘুরপাক খেতে শুরু করেছে। আমরা তখন লাঞ্চ করছি।মনে হচ্ছিল যা খাচ্ছি তা ই বার হয়ে যাবে পেট দিয়ে।

bde1386e-79dd-4c33-8f16-bffd95e29bd9.jfif
c4511187-2984-46c4-a0c9-2cfdabe5f421.jfif

প্রায় ১ ঘন্টা পর যখন আবার বিদ্যাধরী তে প্রবেশ করলাম, তখন নদী শান্ত হল। প্রতিজ্ঞা করলাম, আর যাব না। নমস্কার। প্রায় বিকেল দিকে ফিরলাম পাখিরালয়ে।ফিরে লোকাল কিছু জিনিস কেনাকাটা করে, নিজেদের হোটেলে ফিরলাম। ফিরে স্নান সেরে সবে বসলাম আবার তন্ময় হাজির চিকেন পকোড়া আর কফি নিয়ে। বলল, "ম্যাডাম খেয়ে নিচে চলে আসুন, বাউলগান হবে।"

a3fcb517-da8b-4e9d-92c4-4a3d04cfe33f.jfif

সত্যি বলতে আর শরীর দিচ্ছিলো না। ভেবেছিলাম উপর থেকেই শুনব।কিন্তু উপর থেকে যখন শুনলাম বাউলদের মধ্যে একজন বলছেন যে, "আমরা লোকাল লোক, যা শিখেছি শুনে শুনে, আমাদের একটু উপরী অর্থ অর্জন হয় এতে, আর চর্চাটাও থাকে।" এটা বলে যখন সে গান ধরল, তার কন্ঠ শুনে আমি একরকম চমকে উঠলাম! এত সুন্দর! এবার তাড়াতাড়ি নীচে গেলাম।একেরপর এক গান বাঁধলো তারা মোট ১.৫ ঘন্টা গান বাঁধলো।তারপর বলল, "এবার আসি, অনেকটা ফিরতে হবে, রাত হলে ভয় আছে। আর গলাও ব্যথা হয়ে গেছে।" আমরাও ওনাদের যৎসামান্য উপঢৌকন দিয়ে বিদায় দিলাম এবং সোজা ডিনারের থালায়। সেদিন ডিনারে ছিলো মিক্সড ফ্রায়েডরাইস এবং চিলি চিকেন।এই খেয়ে সেদিনের মত নিদ্রা দেবীর কোলে ঢলে পড়লাম চারজনই।

13162585-e517-4dfd-b99a-dc626ac2495d.jfif
109bfece-2d77-46cb-950d-83f3389965e5.jfif

(চলবে)

c5002ceb-1b72-4a07-9584-69846ef1762d.jfif

4HFqJv9qRjVeVQzX3gvDHytNF793bg88B7fESPieLQ8dxHasrbANgiURdsJZbqzojRuxTqrn8BwVMhvjW2bszpJVcHcPW7rxPZLtrPVi9FWSiNoAnyKt4P3qfRidjbh5nr88gtri9qE2ohuC3tavoQ5nX9ihXXuBCWz.jfif

Sort:  
 2 years ago 

সুন্দরী সুন্দরবন পর্ব দুই ৷যদিও আমি প্রথম পর্ব টি দেখি নি বা পরি নি ৷তবে পর্ব দুই পরে যতটুকু বুঝলাম আপনারা কয়েকজন বন্ধু মিলে সুন্দরী সুন্দরবন ভ্রমন করতে গেছেন ৷আর আপনার সুকান্ত নামে লোকটি গাইড হিসেব আপনাদের সমস্ত কিছু ইনফরমেশন দিচ্ছে ৷কারন সে গত ১০ বছর ধরে আছেো৷আপনারা সারা দিন অনেক জায়গায় ঘুরছেন ৷আর শেষে আরও ভালো লাগলো বাউল গানের আসর দেখে ৷ভালো লাগলো আপনাদের সারা দিন আনন্দের গুলো ৷

 2 years ago 

আসলে গেছিলাম খুড়তুতো বোন ও এক মাসির সাথে। ধন্যবাদ আপনাকে

 2 years ago 

দারুণ সময় কাটিয়েছেন সুন্দরবন ভ্রমণে দিদি।আমি অবশ্য দর্শনীয় স্থানে যায়নি,দাদুবাড়ি গিয়েছিলাম তাই সুন্দরবনের জঙ্গলটা উপভোগ করেছি শুধু।বাদর ও লজ্জাবতী কুমিরের কান্ড পড়ে ভালো লাগলো।ধন্যবাদ দিদি।

 2 years ago 

ধন্যবাদ আপনাকে। মূল্যবান মন্তব্য করার জন্য। ☺

 2 years ago 

উপভোগ্য ভ্রমণ কাহিনী। ধন্যবাদ আপনাকে।

 2 years ago 

অসংখ্য ধন্যবাদ। 😊

Coin Marketplace

STEEM 0.17
TRX 0.14
JST 0.028
BTC 59404.52
ETH 2610.92
USDT 1.00
SBD 2.41