কলকাতার ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের পথে।। বইমেলার ছুটিতে একদিন।।
।।নমস্কার বন্ধুরা।।
নীলমের লেখামিতে আপনাদের স্বাগত
কেমন আছেন বন্ধুরা? আশাকরি পরম করুণাময়ের কৃপায় আপনারা ভালোই আছেন৷ আমিও বেশ ভালো আছি৷ ছুটি শেষ হয়ে আসছে৷ এবার প্রবাসে ফেরার পালা। আমি প্রায় পনের বছর বয়স থেকেই হোস্টেলে থাকি৷ তাও কেন জানি না বাড়ি এসে ফিরে যাবার সময় হলেই মনটা ভার হয়ে যায়৷ হয়তো এখনও অভ্যেস করে উঠতে পারিনি৷ এই অনভ্যাস যেমনই থাক, আজকাল অদ্ভুত কান্ড হয়ে মনের ভেতর৷ মানে, মনখারাপ করছে বলে এখানে যে থেকেই যাবো সেটা ভাবতে পারি না৷ একটু বেশিদিন থাকলেই নিজেকে সবার মাঝে কেমন একটা বেমানান লাগে। হয়তো সবার সাথে না থাকাটাই অভ্যেস হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবার সব কিছু দূর থেকে দেখাও যেন দীর্ঘ অভ্যেস৷
যাইহোক, মনের পাগলামি মনের ভেতরেই জোয়ারভাটা চালিয়ে যাক৷ আজ বরং আপনাদের কুমোরটুলির গল্প বলি৷ প্রথমে ভেবেছিলাম এবারের রবীন্দ্রজয়ন্তী নিয়ে বলব৷ কিন্তু সেসব গোছাতে গিয়ে মনটা ভারী হচ্ছিল। ওখানে ফিরে যাই তখন স্মৃতিচারণ করব৷ নিজেরও ভালো লাগবে৷
২০২৩ এর জানুয়ারী মাসে যখন বইমেলার জন্য এসেছিলাম, একটাদিন সকাল সকাল কুমোরটুলি ঢুকে পড়েছিলাম৷ ওই সময় সরস্বতীপূজা থাকে তো তাই মন হয়েছিল কুমোরটুলি থেকে সরস্বতী ঠাকুর কিনব৷ কিন্তু যা আগুন দাম সে তো আর হয়নি। তাই কলাবেচা ছেড়ে শুধু রথই দেখলাম।
শোভাবাজার মেট্রোস্টেশন থেকে হাঁটা পথে কুমোরটুলি প্রায় দশ থেকে পনের মিনিট৷ এ গলি, ও গলি পেরিয়ে কখন যে ঢুকে পড়েছি বুঝতেই পারিনি! হঠাৎ দেখছি স্টুডিওগুলো খোলা আর ভেতরে বিরাট বিরাট মাটির প্রতিমা। কী অপরূপ মৃৎশিল্প। আমার ছবি তোলা দেখে পটুয়াদের একজন বলেছিলেন দুর্গাপূজার সময় আসতে৷ ঠিকই তো টিভিতেই তো দেখেছি দূর্গাপূজার আগে কুমোরটুলির সে কী বাহার৷ রিপোর্টার থেকে শুরু করে ফিল্ম ডায়রেক্টর সহ ব্লগার কেউ বাদ পড়ে না৷ এমনকি বাংলা সিরিয়ালের দূর্গাপূজার ঠাকুরও আনার দৃশ্য দেখাতে শুটিংয়ের ভিড় জমায়৷ সত্যি বলতে কি শিল্পীরা অনেকেই বিরক্তও হন। শিল্পের ব্যঘাত কে পছন্দ করে বলুনতো৷ আবার অনেকে অদ্ভুত নির্বিকার৷ কাজ করেই চলেছে।
একটু একটু করে এগোচ্ছি আর শতাব্দী স্পষ্ট হয়ে উঠছিল মুখের সামনে৷ আচ্ছা, আপনারা জানেন কিভাবে কুমোরটুলি কুমোরটুলি হয়ে উঠেছিল? আমিও জানি না খুব একটা, তবুও কলকাতা হোস্টেলমেট ও পরবর্তীতে প্রিয়বন্ধুর থেকে যেটুকু শুনেছি সেটাই আপনাদের সাথে ভাগ করছি। আমাদের মাটির কাজ মানে মৃৎশিল্পের কাজ মূলত কৃষ্ণনগরেই হত। ১৬০৬ খ্রীস্টাব্দে মানে আমাদের ভাগবাটোয়ারার আগে নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র শুরু করেছিলেন দূর্গাপূজা। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র, মানে আমাদের প্রিয় গোপাল ভাঁড়ের রাজামশাই। খুব আড়ম্বর না হলেও মোটামুটি সেযুগের জমজমাট বলাই চলে। ধীরে ধীরে এই পূজার প্রচলন ছড়িয়ে পড়ে৷ সাথে মৃৎশিল্পীদের কদরও বাড়ে৷
১৭৫৭ খ্রীস্টাব্দে পলাশী যুদ্ধের পর নবাব সিরাজের ধনসম্পত্তি লুঠ হল, আরও অনেক অপ্রিয় ইতিহাস তৈরির সাথে সাথে ইংরেজরা জাঁকিয়ে বসল৷ এই বছরেই শোভাবাজার রাজবাড়ীর রাজা নবকৃষ্ণ দেব শুরু করলেন দূর্গাপূজা৷ শোনা যায় স্বয়ং লর্ড ক্লাইডও উপস্থিত ছিলেন। তারপর থেকে কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্পীরা ধীরে ধীরে কলকাতায় এসে বসবাস শুরু করল। যেখানে কাজ বেশি সেখানে আয়ও বেশি৷ কী সহজ সমীকরণ তাই না? কিন্তু যুদ্ধশেষে ইংরেজরা তাদের ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য বিস্তারের কথা ভেবে গোবিন্দপুরে ফোর্ট উইলিয়াম দূর্গ স্থাপন করে। ব্যস, পটুয়াদের বাসস্থানে পড়ল যমের থাবা৷ তারা এবার গৃহহীন হয়ে ঘরের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিল সুতানুটির দিকে৷ তারপর ইংরেজদেরই নির্দেশে নানান কর্ম সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য একএকটি নির্দিষ্ট জায়গা ঠিক হল বসবাসের ও কাজের৷ সেভাবেই আহেরীটোলা, শুঁড়িপাড়া, ছুঁতোরপাড়ার মতো জন্ম নিয়েছিল পটুয়াদের শিকড় কুমোরটুলি।
আজ এই কুমোরটুলি জগৎখ্যাত। জানেন যখন গোয়াতে দূর্গাপূজা দেখতে গিয়েছিলাম তখন ওখানকার ক্লাবের মেম্বারদের জিজ্ঞেস করেছিলাম প্রতিমা কীভাবে আনা হয়? ওনারা বলেছিলেন, প্রতিমা কলকাতা থেকে আসে না৷ ওনারা পটুয়াদের ভাড়া করে নিয়ে আসেন৷ আর ট্রেনের লাগেজ বগিতে আসে প্রতিমার সমস্ত সাজসরঞ্জাম৷ ভাস্কো-দা-গামা অঞ্চলে ওই পটুয়ারা প্রায় আশি নব্বুইটার বেশি প্রতিমা তৈরি করেন আর পশ্চিম ভারতের নানান জায়গায় সাপ্লাই দেন। আমি বেশ কিছু বছর দেশের বাইরে থেকেছি। তখন জানতাম জাহাজের কন্টেনারে করে প্রতিমা বিদেশ পাড়ি দেয়। এখানেও সেরমই ভাবতাম। জাহাজ না হলেও লরি বা ট্রেন৷ কিন্তু এ যে পুরো পটুয়া তুলে আনে এটাই বেশ লেগেছিল। এভাবেই হয়তো কলকাতার বাইরেও আরেকটি কুমোরটুলি কোথাও কোথাও গড়ে উঠবে৷
সেদিন কুমোরটুলিতে বেশকিছু বিদেশীরা এসেছিলেন৷ সাথে গাইড দেখে বুঝেছিলাম এরা একটা গ্রুপ। দাঁড়িয়ে ছবি তুলছে, গল্প শুনছ। বিদেশীদের মধ্যে কলকাতার এই ঐতিহাসিক পথে হাঁটাটা একটা বিখ্যাত ট্যুরিজম। একে কি বলে জানেন? কলকাতার হেরিটেজ ওয়াক।
আমি ওদের ভেতর দিয়ে কখনও পাশ কাটিয়ে বেশ কয়েকটি স্টুডিওতে ঢুকেছিলাম। কী সুন্দর সব কাজ। মাটির শাড়ি, মাটির মুকুট, মাটির চুল। এমনকি মালাটাও মাটির৷ প্রতিটা ভাঁজ প্রতিটা কোন এতো নিখুঁত। যেন স্বয়ং ঈশ্বর নিজের রূপ এভাবে দিয়ে চলেছেন। কত ভিডিওতে দেখেছি বিদেশীরা কায়দা করে মাটির শিল্পকলা বানিয়ে বিক্রি করে৷ আর আমাদের এই শিল্পীরা? এদের উন্নয়ন কি আদৌ আছে? পটুয়ারা বলে নাকি কাজ কমে গেছে। লেবারও নেই৷ এসব কাজে টাকা নেই বলে কেউ আসতে চায় না৷ সত্যিই তো বছরের ওই একটা দূর্গাপূজার সময় রমরমিয়ে বাতাস খেললেও কি আর সারাবছর চলে? সেই না চলায় তাদের চোখের জল দেখতে আমরা ক'জনেই বা যাই? এই যে স্টুডিওর সামনে কচিকাচারা দৌড়োচ্ছে, বাড়ির মেয়েবউরা বসে বসে গয়না বানাচ্ছে, আরও নানান সাজসরঞ্জাম বানাচ্ছে এতে কি তাদের দুবেলার ভরপেট খাবার জোটে? মেটে স্বাদকোরকের শখ আহ্লাদ? আমরা যারা ফ্ল্যাটবাড়িতে থাকি আর পূজোতে গিয়ে আনন্দ হইহুল্লোড় করি, কেউই হয়তো এসব ভাবি না৷
কুমোরটুলি থেকে বেরিয়ে আসার সময় মন এমনই ভারাক্রান্ত হয়ে গেছিল সেদিন। 'দিদি একটু সরো' বলে যে চার-ছ'টা বাচ্চা খালি গায়ে ঢলঢলে ছেঁড়া প্যান্টে দৌড়ে গেল তারা কি স্কুলে যায়? কি জানি হয়তো যায়৷ হয়তো বা না।
বাড়ি এসে ছবিগুলো দেখি, পরে ছোট ছোট ভিডিও দিয়ে রিল বানিয়েছিলাম৷ কিন্তু কখনও ভাবিনি এতো কথা লিখব। স্টিমিটে এসে অনেক কথা বলার সুযোগ হয়েছে। আপনাদেরও বলতে বেশ ভালো লাগে। স্টিমিটকে অনেক ভালোবাসা৷ আর আপনাদেরও। সকলে খুব ভালো থাকুন। আনন্দে থাকুন৷ আবার আসব অনেক গল্প নিয়ে। ততক্ষণ ভালো থাকুন। সুস্থ থাকুন।