কেউ কি ইচ্ছে করে ভুল করে?
আজ - ২০ ই জ্যৈষ্ঠ |১৪৩২ বঙ্গাব্দ, | বর্ষাকাল |
আসসালামু-আলাইকুম। আদাব - নমস্কার। মাতৃভাষা বাংলা ব্লগিং এর একমাত্র কমিউনিটি আমার বাংলা ব্লগ এর ভারতীয় এবং বাংলাদেশী সদস্যগণ, আশা করি সবাই ভাল আছেন।
কেউ কি ইচ্ছে করে ভুল করে—এই প্রশ্নটি আমাদের হৃদয়ের গভীরে এক অনিশ্চিত কৌতূহল জাগায়। আমরা প্রত্যেকেই জীবনে কমবেশি ভুল করি, কিন্তু সেই ভুলগুলো কি আমরা সচেতনভাবে করি? মানুষের চরিত্র, পরিবেশ, আবেগ এবং উপলব্ধি সবকিছুই তার আচরণের ওপর প্রভাব ফেলে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, মানুষ ভুল করে ফেলে অনিচ্ছাকৃতভাবে, কারণ সে হয়ত জানত না যে তার সিদ্ধান্তটি ভুল, বা হয়ত তখনকার পরিস্থিতি তাকে এমন কিছু করতে বাধ্য করেছে যা পরে ভুল প্রমাণিত হয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ, একজন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় ভুল উত্তর দেয়, সে কি ইচ্ছা করে ভুলটা করেছে? নাকি সে পড়া ঠিকমতো মুখস্থ করতে পারেনি বা ভুলভাবে প্রশ্নটি বুঝেছে? আবার একটি ছোট শিশু যখন খেলার সময় পড়ে যায় বা গরম চুলার কাছে গিয়ে হাত পুড়িয়ে ফেলে, সেটি কি ইচ্ছাকৃতভাবে করে? নিশ্চয়ই না, কারণ তার মধ্যে জ্ঞান বা অভিজ্ঞতার অভাব রয়েছে। তেমনি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বহু ভুল এমন হয় যা ঘটে যায় জানার অভাবে, বোঝার অভাবে বা কখনো আবেগের বশবর্তী হয়ে।
যেমন ধরা যাক, একজন মায়ের গল্প, যিনি নিজের সন্তানকে খুব বেশি শাসন করেন, কারণ তিনি বিশ্বাস করেন কঠোরতা সন্তানকে সঠিক পথে রাখতে সাহায্য করে। সন্তান বড় হয়ে বলে—“তুমি কখনো আমার বন্ধু হতে চাওনি, সবসময় রাগারাগি করেছো।” মা তখন অনুধাবন করেন, হয়তো তিনি ভুল করেছিলেন। কিন্তু তিনি কি ইচ্ছে করে সন্তানকে কষ্ট দিতে চেয়েছিলেন? না, তিনি চেয়েছিলেন সন্তানের মঙ্গল। এইরকম হাজারো পরিস্থিতি জীবনে ঘটে যেখানে মানুষ ভুল করে কিন্তু তার পেছনে থাকে ভালোবাসা, মঙ্গলচিন্তা, অথবা পরিস্থিতির চাপে নিঃসঙ্গ এক সিদ্ধান্ত।
আবার আবেগ মানুষের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে। রাগ, হতাশা, ভয়, ভালোবাসা—এইসব অনুভূতি অনেক সময় যুক্তিবোধকে অন্ধ করে ফেলে। তখন আমরা এমন কিছু করে ফেলি যা পরে ভুল প্রমাণিত হয়। যেমন প্রেমে ব্যর্থ হয়ে অনেকে আত্মহত্যার মতো চরম সিদ্ধান্ত নেয়, পরে সেই পরিবারের অন্য সদস্যরা বছরের পর বছর ভুগে যান। কিন্তু সেই সিদ্ধান্তটি কি সে ইচ্ছে করে ভুল হিসেবে নিয়েছিল? না, সে নিজের ব্যথায় এতটাই ডুবে গিয়েছিল যে সে পথ খুঁজে পায়নি। তেমনি অনেক মানুষ হতাশায় পড়ে প্রতারণার পথ বেছে নেয়, কেউ হয়তো অর্থনৈতিক চাপে পড়ে ছোটখাটো চুরি করে বসে। সমাজ তখন তাকে “চোর” বলে অবজ্ঞা করে, কিন্তু কেউ ভাবে না—সে কি পরিস্থিতির শিকার ছিল? আমাদের সমাজে অনেক ভুল মানুষ করে ফেলে শুধুমাত্র সমাজের সীমাবদ্ধতার কারণে। একজন দরিদ্র ছেলেমেয়ে ভালো স্কুলে পড়তে পারে না, কারণ তার পরিবার তাকে কাজে পাঠায়। বড় হয়ে সেই ছেলেটি হয়তো সুযোগ পায়নি পড়ালেখার, জীবনের কোনো এক পর্যায়ে সে ভুল পথে যায়। তখন আমরা বলি, সে খারাপ ছেলে —কিন্তু কেউ ভাবে না সে কি আদৌ সুযোগ পেয়েছিল ভালো হওয়ার? আবার কিছু মানুষ ভুল করে ইচ্ছাকৃতভাবে—হ্যাঁ, স্বীকার করতেই হবে, কিছু মানুষ জেনে-বুঝে খারাপ কাজ করে, অন্যকে কষ্ট দেয়, প্রতারণা করে।
কিন্তু সেই মানুষগুলোও কি ছোটবেলা থেকে এমনই ছিল? না, তাদের ভেতরে কোনো না কোনো অভাব, বঞ্চনা বা মানসিক আঘাত ছিল যা তাকে এই পথে নিয়ে গেছে। মনোবিজ্ঞান বলে, কেউ দীর্ঘদিন ভালোবাসাহীন থেকে গেলে তার ভিতরে নেতিবাচকতা জন্ম নেয়, এবং একসময় তা অন্যের ক্ষতির মাধ্যমে প্রকাশ পায়। কাজেই এমন মানুষরাও ইচ্ছাকৃত ভুল করলেও, তার পেছনে থাকে গভীর কারণ। আমাদের উচিত এই ভুলগুলো বিশ্লেষণ করা, কারণ শুধুমাত্র শাস্তি দিয়ে নয়, বরং বুঝিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে সংশোধনের সুযোগ দিলে অনেক ভুল মানুষ সঠিক পথে ফিরে আসতে পারে। বাস্তব জীবনে আমরা দেখতে পাই—একটি ছোট ভুল মানুষের জীবন বদলে দিতে পারে। একজন চিকিৎসক যদি ভুলভাবে ওষুধ প্রেস্ক্রিপশন দেন, রোগীর বড় ক্ষতি হতে পারে। কিন্তু তিনি কি ইচ্ছা করে রোগীকে কষ্ট দিতে চান? না, হয়তো তার সেই মুহূর্তে মনোযোগ ছিল না, হয়তো রিপোর্ট ভুল ছিল। একজন ড্রাইভার রাস্তা পার হওয়ার সময় এক সেকেন্ডের জন্য দৃষ্টি সরালেন, আর ঘটে গেল দুর্ঘটনা। অথচ সে তো চায়নি কারও ক্ষতি হোক। আবার একজন অফিস কর্মী রিপোর্টে ভুল টাইপ করলেন, তার চাকরি চলে গেল। অথচ সে হয়তো রাত জেগে কাজ করেছে, ভুলটা কেবল ক্লান্তির কারণে হয়েছিল। এসব উদাহরণ আমাদের মনে করিয়ে দেয়—ভুল হচ্ছে জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ, এবং তা সবসময় ইচ্ছাকৃত নয়। জীবনের পথে চলতে গেলে আমরা হোঁচট খাব, ভুল করব, কিন্তু সেই ভুলই আমাদের শেখায়, গড়তে সাহায্য করে।
একজন মানুষ যদি অনুতপ্ত হয়, ভুল বুঝতে পারে, তাহলে আমাদের উচিত তাকে ক্ষমা করে, সুযোগ দিয়ে, তাকে নতুন করে শুরু করতে সাহায্য করা। যিনি জীবনে ভুল করেননি, তিনি কিছু করার চেষ্টাও করেননি—এমন কথাও প্রচলিত। কাজেই ভুলকে ভয় না পেয়ে, তা থেকে শিক্ষা নিয়ে এগিয়ে যাওয়া মানবিক গুণ। আমাদের সমাজ যদি এভাবে ভাবতে শিখে, তাহলে ভুল শুধুই “অপরাধ” হয়ে থাকবে না—বরং তা হবে উন্নতির এক ধাপ। তাই বলা যায়, “কেউ কি ইচ্ছে করে ভুল করে?”—এই প্রশ্নের উত্তর সহজ নয়, তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে উত্তর হবে না। ভুল হয়, ভুল করিয়ে নেয় পরিস্থিতি, অজ্ঞতা, আবেগ এবং অভিজ্ঞতার অভাব। আমাদের উচিত নিজেদের মতো অন্যের ভুলও বুঝতে শেখা, সহানুভূতির চোখে দেখা, এবং পরস্পরের জন্য শিক্ষা ও অনুশোচনার জায়গা তৈরি করা।
এই লেখাটি যেন এক গভীর আত্মজিজ্ঞাসার দরজা খুলে দিল।ভুল যা আমরা প্রায়শই শুধুই দোষ হিসেবে দেখি, সেটিকে আপনি অসাধারণ দক্ষতায় বিশ্লেষণ করেছেন একটি মানবিক ও বাস্তবচিত্র হিসেবে। লেখার প্রতিটি অনুচ্ছেদ যেন একেকটি অনুভবের আয়না, যেখানে আমরা নিজেদের মুখোমুখি হই। কখনো মা, কখনো সেই ক্লান্ত কর্মী, কখনো হতাশ প্রেমিক সব চরিত্রই যেন আমাদের একাংশ।
একদম ঠিক বলেছেন ভাই,কারণ মানুষ মাত্রই তো ভুল। কিন্তু একই ভুলের পুনরাবৃত্তি ঘটলে,সেটা মেনে নেওয়া যায় না। তাই এই ব্যাপারে সবার সচেতন থাকা উচিত। যাইহোক এতো চমৎকার একটি পোস্ট আমাদের সাথে শেয়ার করার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে।