ফেলা আসা জীবনের বন্ধুত্বের স্মৃতি।।আমার বাংলা ব্লগ" প্রতিযোগিতা-২৪ || 10% beneficiary to @shy-fox
বন্ধু আমাদের জীবনের অনেক বড় একটি অধ্যায়। কেউ যদি চায় শুধু পরিবার নিয়ে সারা জীবন কাটিয়ে দিবে তা যেমন অসম্ভব আবার কেউ চাইলেই পরিবার বাদ দিয়ে শুধু বন্ধু নিয়ে সারা জীবন চলতে পারবে না। বন্ধু মানে জীবনের অনেক না বলা কথা বলার সংগী। বন্ধু মানে বিশ্বাস।
আমার প্রাইমারি স্কুল জীবন কাটে গ্রামে। আমি এস এস সি পরীক্ষা পর্যন্ত গ্রামেই কাটিয়েছি। আর আমার এই জীবনের যত বন্ধু হয়েছে কেন জানি স্কুল জীবনের বন্ধুদের কথা বেশি মনে পরে। যদিও তাদের সাথে এখন আর যোগাযোগ নেই বললেই চলে। আমার বাড়ির তিন দিকে হিন্দু পরিবারের বসবাস। তাই সেই ছোট বেলা থেকেই আমার প্রায় বন্ধুই হিন্দু ধর্মের ছিল। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যদের নাম সর্বজিত, অনুপম, জনি। তবে একদম শুরু থেকে যার সাথে বেশি চলাফেরা সে হচ্ছে অনুপম। আমার প্রাইমারি স্কুলের প্রথম ক্লাশ থেকে পঞ্চম ক্লাশ পর্যন্ত অনুপমের সাথেই চলাফেরা এবং আমার যতদুর মনে পরে আমি মনে হয় অল্প কিছুদিন ছাড়া সবসময় অনুপমের পাশেই বসেছি। অনুপম ছিল আমার স্কুলের সাথী, খেলার সাথী, আড্ডা দেয়ার সাথী। খেলা আড্ডা ঘুরাঘুরি তে আমরা একে অন্যের জান ছিলাম কিন্তু যেই পড়ার বেপার আসত আমরা দুজন দুজনের শত্রু হয়ে যেতাম। আমার বরাবরই রোল এক হত আর অনুপমের হত দুই। আমি আর অনুপম সবসময় কম্পিটিশন দিয়ে পড়াশোনা করতাম। আসলে আমাদের নিজের মধ্যেই বোধ কাজ করত যে কার রোল নম্বর এক হবে তবে কখনো ঝগড়া করিনি। কিন্তু যখন কারো সাথে ঝগড়া বাধত আমরা বাঘের মত ঝাপিয়ে পরতাম। একবার ক্লাশ ফাইভে এক ছেলে আমাকে স্কেল দিয়ে মেরেছিল। আমি ত হাউমাউ করে কাদতেছিলাম। হঠাৎ দেখি অনুপম সেই ছেলেকে একদম ধাক্কা দিয়ে মেঝেতে শুইয়ে অনেকগুলো কিল-ঘুষি মারা শুরু করে দিয়েছে। পরে আমার জন্য অনুপমকে ম্যাডাম মেরেছে। এভাবেই বন্ধুত্ব এবং পড়ার কম্পিটিশন করে আমাদের প্রাইমারি স্কুল জীবন শেষ করেছি।
তারপর অনুপম আর আমি একই হাই স্কুলে ভর্তি হয়েছি। আসলে আমাদের অত্র ইউনিয়নে একটাই ভাল হাই স্কুল ছিল। আমরা একই স্কুলে পড়তাম ঠিকই কিন্তু সেকশন ভাগ ছিল। তাই আমাদের বন্ধুত্বের মধ্যে দুরত্ব শুরু হয়েছিল। তখন আমাদের শুধু স্কুলে আসার সময় দেখা হত আর যাওয়ার সময় দেখা হত। তবে বিকেলে একসাথে খেলতাম, কখনো মাছ ধরতাম, কখনো গোমতী নদীর ধারে ঘুরতে যেতাম। একবার ত নদীতে গোসল করতে গিয়ে দুজনে চুব খেয়ে অনেক পানি খেয়েছিলাম। পরে ভয়ে অনেকদিন নদীতে গোসল করতে যাইনি। এত বন্ধুত্বের মধ্যে কিন্তু আমাদের দুজনের যে পড়ার কম্পিটিশন তা চলত। কারন সেকশন চেঞ্জ হলেও একজন আরেকজনের পড়ার আপডেট আমরা রাখতাম।
ক্লাশ নাইনে গিয়ে আমি সায়েন্স নিলাম আর অনুপম নিয়েছে কমার্স। তাতে কি হয়েছে পড়ার কম্পিটিশন চলছিল। অনুপমের মধ্যে কমপিটিশনের আগ্রহটা বেশি দেখা যেত। আমি একদিন জিজ্ঞেস করাতে সে বলেছিল আমি অনেক ভাল রেজাল্ট করতে চাই। আমার ইচ্ছা আমার কাকার মত (অনুপমেত কাকা তখন ঢাকায় বড় একটি কোম্পানিতে প্রায় ১ লাখ টাকা বেতনের চাকরি করত) বড় অফিসার হব। আমার মনে পরে আমার যখন টেস্ট পরীক্ষা শেষ তখন আমাদের বাড়িতে চারটি ঘরের মধ্যে একটি আলাদা ঘরে আমি পড়ার বন্দোবস্ত করেছিলাম। কিন্তু রাতে একা পড়ত ভয় লাগবে তাই অনুপমকে বলেছিলাম আমার এখানে চলে আসতে। সে বলেছিল তার পরিবার আসতে দিবে না। কারন মুসলিম পরিবারের সাথে রাতে থাকতে দিবেনা, আর বাড়ির বাহিরে গিয়ে অন্য বাড়িতে রাতে থাকবে এটা সমাজের লোক ভাল চোখে দেখবে না। আমার ত মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল কারন আমি এই ঘরে সন্ধ্যার পর পড়তে পারব না। কিন্তু অনুপমকে বলার পরদিনই সে দেখি বই খাতা বুকশেলফ নিয়ে আমার বাড়ি হাজির। সে বলল সকাল থেকে রাত ১০ঃ০০ টা পর্যন্ত তোর সাথেই আমি পড়াশোনা করব। খাওয়ার সময় বাড়ি গিয়ে খেয়ে আসব। আর ১০ঃ০০ টার দিকে এসে আমার বাবা বা বড় ভাই নিয়ে যাবে। তখন টেস্টের পর আমার আর অনুপমের পড়া দেখে আমার বাবা মা এবং অনুপমের বাবা মা অনেক খুশি হয়েছিল। পরে তখনকার আস্পেক্টে আমাদের রেজাল্ট অনেক ভাল হয়েছিল। এভাবেই আমার আর অনুপমের বন্ধুত্ব চলছিল। কলেজে উঠার পর আমি শহরে একটি কলেজে ভর্তি হয়েছি কিন্তু অনুপম আমাদের ইউনিয়নের একটি কলেজে ভর্তি হয়েছিল। তারপর অনুপমের সাথে আমার আর তেমন দেখা হত না। শুধু শহর থেকে বাড়ি আসলে মাঝে মাঝে দেখা হত। একটা সময় পর অনুপমের সাথে দেখা হলেও অনুপম কেন জানি খুব একটা কথা বলত না। এর মধ্যে কলেজ জীবন শেষ করে ঢাকা এসে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হলাম।
ঢাকা থেকে বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশ্যে একদিন বাজারে এক দোকান থেকে বিস্কুট কিনতে গেলাম। গিয়ে দেখি অনুপম আমাকে বিস্কুট দিচ্ছে। আমি বললাম তুই এখানে কি করিস? সে বলল এইচ এস সি পরীক্ষা দেয়নি। ব্যবসা তে মন দিয়েছে। এইচ এস সি তে পড়া অবস্থায় তার বাবা অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী। তাকেই এখন সংসার চালাতে হচ্ছে। তাই ব্যবসা করছে। শুনে আমার খারাপ লাগল এই ভেবে, যে ছেলেটা আমার সাথে কমপিটিশন দিয়ে পড়ার জন্য বুকশেলফ বই খাতা নিয়ে চলে আসল সে আজ এইচ এস সি পরীক্ষা না দিয়ে মুদি দোকান দিয়ে বসেছে। আমার খারাপ লেগেছে কারন আমি তার জন্য কিছু করতে পারিনি। আজও সে আমাদের বাজারে সেই মুদি ব্যবসা করেই সংসার চালাচ্ছে। মাঝে একদিন গিয়ে কথা বললাম। বলল তার বাবা মারা গিয়েছে। অনেক কষ্ট করে সংসার চালাচ্ছে। আজ লেখতে গিয়ে মনে হল যে বাড়িতে প্রতিদিন অন্তত একবার যাওয়া হত এত পাশে থেকেও সে বাড়িতে মনে হয় আমি প্রায় ১২-১৩ বছর যাই না।
আজ এই পর্যন্ত। পরবর্তীতে আবার আসব নতুন কোন পোস্ট নিয়ে। ধন্যবাদ সবাইকে।
সর্বজিত, অনুপম, জনি আপনার তিন জন বন্ধু থেকে অনুপম আপনার বেষ্ট ছিল ।আপানার ইউনিভার্সিটি লাইফে এসে বন্ধুত হয় নি কারো সাথে? আসলে স্কুল লাইফের কিছু কিছু বন্ধু মাঝ পথে ঝরে যায় ।নানা কারণে তাদের জন্য খুব খারাপ লাগে সব নিয়তি খেলা ।আপনার জন্য শুভ কামনা রইল ।
ইউনিভার্সিটিতে অনেক বন্ধুই হয়েছিল। তবে ইউনিভার্সিটির এক বন্ধুর বেপারে লিখতে চেয়েছিলাম। এই বন্ধু টি খুব খারাপ দিকে চলে যাচ্ছিল। আমার কিছুটা মানসিক সাপোর্ট আর তার নিজের ইচ্ছাশক্তির জোরে ট্রিমেনডাস চেঞ্জ হওয়ার বেপারটা আমার সারাজীবন মনে থাকবে। কিন্তু এমনিতেই জেনারেল রাইটিং পোস্ট কেউ পড়েনা। তার উপর যদি সেই বন্ধুর টা লেখা শুরু করি অনেক বড় হয়ে যাবে। আমার স্কুল লাইফটা আমি সহজে ভুলতে পারি না। আমি মাঝে মাঝে এতটা ইমোশনাল হয়ে যাই ওদের কথা মনে পরে কোথায় যেন হারিয়ে যাই। ধন্যবাদ আপু।
হুম স্কুল জীবনের বন্ধুদের কি কখন ও ভুল যায়।
ভাইয়া আপনার ফেলা আসা জীবনের বন্ধুত্বের স্মৃতি পড়ে অনেক ভাল লাগলো। তবে অনুপম ভাইয়ার জন্য খুব খারাপ লাগলো। অভাবের কারনে অকালে একজন ভাল স্টুডেন্ট জড়ে গেল। যায়হোক আপনি আপনার জব নিয়ে আর অনুপম ভাইয়া তার ব্যবসা নিয়ে নিজ নিজ অবস্থানে ভাল থাকুক, সেই কামনা করি। ধন্যবাদ।
অনুপমের সাথে আমার এখন দেখা ত দুরের বেপার কথাও হয় না। কিন্তু যখনই ফেলে আসা জীবনের বন্ধুত্বের স্মৃতির বেপারে লিখতে বলা হল আমার সবার প্রথমে অনুপমের কথাই মনে পরল। আমার ইউনিভার্সিটির এক বন্ধুর কথাও লিখতে ইচ্ছে করেছিল কিন্তু এত বড় লেখা দেখলে অনেকেই পড়তে চাইবে না। আমিও আশা করি অনুপম ভাল থাকুক। ধন্যবাদ ভাইয়া।
ভাইয়া স্কুল জীবনের বন্ধুই প্রকৃতি। আসলে আমাদের ইউনিভার্সিটি লাইফে এসে বন্ধুত অনেক হলে ও সেই বন্ধুত্ব স্হায়ী হয় না। অনুপম আর আপনি ভালো বন্ধু হলে ও পড়ার কম্পিটিশন থাকবে এটা স্বাভাবিক। তবে বিপদে আপদে ঝাপিয়ে পড়া এটাই প্রকৃতি বন্ধু। যাইহোক যার যার কর্ম স্হান থেকে সবাই ভালো থাকুন। ধন্যবাদ
আমিও আপনার সাথে সহমত, স্কুল জীবনের বন্ধুদেরকে প্রকৃত বন্ধু বলে মনে হয়। কারণ তাদের যে আন্তরিকতা ছিল সেটা অন্যদের মধ্যে পাইনি। অনুপমের জন্য আমার এখনো খুব খারাপ লাগে। সে আসলেই আমার একটা প্রকৃত বন্ধু ছিল। ধন্যবাদ আপু।
প্রথম দিক থেকে আপনার আর অনুপমের বন্ধুত্বের কথা পরে ভীষণ ভালোই লাগছিল। আপনারা দুইজন কম্পিটিশনের মাধ্যমে পড়ালেখা করতেন। আবার টেস্ট পরীক্ষার জন্য আপনার বাড়িতে সে রাত দশটা পর্যন্ত একসাথে পড়ালেখা করতেন। এমনকি ভালো রেজাল্ট করলেন। অনুপমের স্বপ্ন ছিল অনেক বড় একটা অফিসার হবে। কিন্তু সে স্বপ্নটা পূরণ হলো না শেষ পর্যন্ত মুদি দোকান করে সংসার চালাতে হলো। অনুপমের এই পরিস্থিতি সত্যি খারাপ লাগলো। আসলে ই ফেলে আসা বন্ধুত্ব এখন যেন স্মৃতির পাতায়। আপনার জন্য অনেক অনেক শুভকামনা রইল।
আপনি আমার পুরো গল্পটি পড়েছেন বলে আপনাকে ধন্যবাদ। প্রত্যেক মানুষের জীবনে ট্র্যাজেডি থাকে। অনুপমের জীবনের এই বাস্তবতাটা তার জন্য একটি ট্র্যাজেডি ছিল।
হঠাৎ করে ই জীবন কোন দিকে ঘুরে যায় কোন কিছু বোঝা যায় না। ঠিক তেমনি ভাই আপনার বন্ধুর যে সময় লেখাপড়ার বয়স সে সময় তার পরিবারের হাল ধরতে হয়েছিল এটা পড়ে অনেক খারাপ লাগলো। তবু এটাই সত্য । একজন ছেলে হয়ে যেকোনো সময় পরিবারে হাল ধরতে হয় যেটা হোক কিংবা বড় হোক কিংবা ছোট।
আপনার ও আপনার বন্ধুর জন্য শুভকামনা রইল ভাইয়া
আপনি ঠিকই বলেছেন, মানুষের সময় কখন কোন দিকে ঘুরে যায় বলা যায় না। অনুপম এত মেধা থাকা সত্ত্বেও সে পড়াশোনা কন্টিনিউ করতে পারেনি শুধু মাত্র সংসারের হাল ধরার জন্য। ধন্যবাদ ভাইয়া সুন্দর মন্তব্য দিয়ে পাশে থাকার জন্য।
এবারের প্রতিযোগিতা- আমার বাংলা ব্লগের “ফেলে আসা জীবনের বন্ধুত্বের স্মৃতি” শেয়ার করার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।আপনার জীবনের ফেলে আসা বন্ধুত্বের স্মৃতি নিয়ে লেখাগুলো আমার খুবই ভালো লেগেছে।আসলে বন্ধু বন্ধুদের জন্য অনেক কিছু করতে পারে।সবার জীবনেই এরকম ভালো-মন্দ অনেক বন্ধু আছে নিশ্চয়ই।আপনার “ফেলে আসা বন্ধুত্বের স্মৃতির কথা” পড়ে প্রথমে খুবই ভালো লাগলেও পরবর্তীতে মনটা একদম খারাপ হয়ে গেল।কারণ অনুপম আপনার জন্য অনেক কিছু করেছে। উনি যখন এইচ এস সি পরীক্ষা দিতে না পেরে একটা মুদির দোকান নিয়ে বসে আছে, বিষয়টা আমার মনের ভিতর নাড়া দিয়েছে।আপনার বন্ধু অনুপমের জন্য শুভকামনা রইল যেন ভবিষ্যৎ জীবনে ভালো কিছু করতে পারে।
আপু আপনি অনেক গঠনমূলক মন্তব্য দিয়েছেন। আপনার সাথে আমি সহমত প্রতিটি মানুষের জীবনে ভাল-মন্দ অনেক ধরনের বন্ধু থাকে। অনুপম অনেকাংশেই আমাকে অনেক উপকার করেছে বিশেষ করে ও যদি কম্পিটিশন দিয়ে না পড়ত হয়ত আমিও পড়াটা ততটা সিরিয়াসলি নিতাম না। যাই হোক আপনার শুভ কামনার জন্য অনেক ধন্যবাদ।