আপনার শিশুর কথা বলা শেখানোর উপায়
শিশুর জন্মের পর থেকে বাবা-মা সহ সবার একটা গভীর আগ্রহ তৈরি হয় বাচ্চার মুখ থেকে বিভিন্ন আওয়াজ শোনা।বাচ্চাটি হয়ে ওঠে পরিবারের মধ্যমণি।
তবে সব বাচ্চা এক সময়ে কথা বলা শেখেনা।কেউ একটু ধীরে আবার কোন কোন বাচ্চা বেশ অল্প সময়ের মধ্যে কথা বলা শিখে যায়।যদি কোন শিশুর বাবা মা এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয় তাহলে বাচ্চাকে কথা শেখানোর এই প্রাথমিক করনীয় গুলো মেনে চলতে পারেন। যেমন-
১)শিশুকে বিভিন্ন ধ্বনি শোনানঃ
আমরা সকলে জানি,শিশুরা জন্মের কিছু দিন থেকে চারিদিকে তাকিয়ে দেখতে থাকে।এই দেখার সাথে সাথে তারা শোনার দক্ষতাটিও শুরু হয়ে যায়। তাই প্রথম কাজটি হলো শিশুকে সুন্দর সুন্দর ধ্বনি শোনানো,গান শোনানো, গল্প ছড়া কবিতা শোনানো।
২) শিশুর সাথে প্রচুর কথা বলাঃ
শিশুরা খুবই অনুকরণপ্রিয়। বাচ্চারা সব সময় বড়দের অনুকরণ করতে চায়। বিশেষ করে পরিবারের মানুষদের সাথে শিশুরা সব সময় হাসি ঠাট্টা আর খেলায় মেতে থাকে। বাচ্চাদের সাথে সময় কাটানোর সময় বাবা মাকে অবশ্যই শিশুর সাথে কথা বলার চেষ্টা করতে হবে। শিশুর সাথে প্রচুর কথা বলা শিশুকে কথা শেখানোর উৎকৃষ্ট পন্থা। পরিবারের সদস্যদেরও শিশুর সাথে শুদ্ধ উচ্চারণে প্রচুর কথা বলতে হবে। শিশুকে এমন প্রশ্ন করতে হবে যার উত্তর সে ছোট ছোট শব্দ বা বাক্যে অথবা অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে দিতে পারে। অনেকেই শিশুকে টিভি বা মোবাইল দেখতে বসিয়ে দেন। তা না করে তাকে গল্প শোনান। শিশুকে গল্পের ফাঁকে বিভিন্ন রকম আওয়াজ করানোর চেষ্টা করতে হবে।
৩) শিশুর বেড়ে ওঠার পরিবেশ অনুকূল রাখুনঃ
শিশুকে সুস্থ ও স্বাভাবিক পরিবেশে বেড়ে উঠতে দিন। শিশুর সামনে তর্ক বা ঝগড়া করবেন না। শিশুকে যতটুকু সম্ভব হাসি খুশির মধ্যে রাখতে হবে। শিশু কান্না কাটি করলে অস্থির হলে চলবে না। শিশুকে কোলে তুলে নিয়ে হালকাভাবে চেষ্টা করতে হবে যাতে সে আস্তে আস্তে শান্ত হয়ে আসে। পরিবারের ঝগড়া শিশুর কোমল মনে আঘাত হানতে পারে। এতে করে শিশু অবস্থায় বাচ্চারা এক ধরণের মানসিক চাপ বা আঘাত প্রাপ্ত হতে পারে যা বাচ্চার কথা বলায় বা অন্যান্য স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডে ব্যঘাত করতে পারে।
৪) প্রশ্ন করুনঃ
শিশুদের অনেক প্রশ্ন করুণ এবং উত্তরটাও নিজেই দিয়ে দিন।এটা কি,ওটা কি,কি করছো,কেন করছো ইত্যাদি প্রশ্ন বেশি বেশি করে করুন।এতে করে আপনার শিশু কৌতুহলী হয়ে উঠবে এবং প্রশ্ন করা শিখবে।
৫)বাচ্চাকে সময় দিনঃ
বাবা-মাকে শিশুর প্রতি যথেষ্ট সময় দিতে হবে। বর্তমান সময় হলো শুধুই ছুটে চলার। কর্মজীবী মহিলাদের সন্তানের প্রতি যত্ন নেয়া বা পর্যাপ্ত সময় ব্যয় করার অবকাশ খুবই অল্প। এরই মাঝে বাবা-মার শিশুর প্রতি সময় বের করে নিতে হবে। শিশুর সাথে খেলা ধুলা করতে হবে। শিশু বুঝুক আর নাই বুঝুক শিশুর সাথে প্রতিনিয়ত কথা বলতে হবে। শিশুর মা-বাবা যতটা সম্ভব শিশুর সাথে সুন্দর সময় কাটানোর চেষ্টা করুন, বাচ্চা যেন হীনমন্যতায় না ভোগে বা নিজেকে অসহায় না ভাবে সেদিকে খেয়াল রাখুন।
৬)স্পিচ থেরাপি
বাচ্চা ঠিক বয়সে কথা বলা না শিখলে সেটা বাবা মায়ের জন্য একটা দুশ্চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। যেসব শিশু কথা বলা শিখছে না বা দেরিতে বলছে বা ভালো করে বলতে পারছে না, তাদের জন্য বাবা মায়ের আরও বেশি সচেষ্ট হতে হবে।স্পিচ থেরাপির ব্যাপারটি অনেকের কাছেই অজানা। স্পিচ থেরাপির সহায়তা নিলে শিশু অনেক দ্রুত কথা বলা শিখতে পারে। যথাসময়ে কথা বলা না শিখলে স্কুল থেকে শুরু করে সামাজিক কর্মকাণ্ডে শিশুটি অনগ্রসর হয়ে পড়বে যা তাকে সারা জীবনের প্রতি পদে বাধার সম্মুখীন করবে।
৭)নির্দিষ্ট শব্দের ওপর জোরঃ
অনেক সময় যেসব শিশু কথা বলতে পারে না বা দেরিতে কথা বলে সেসব ক্ষেত্রে প্রতিটি কাজে একটি নির্দিষ্ট শব্দের ওপর গুরুত্ব দিয়ে কথা বলতে হবে। যেমন- শিশুকে স্নান করানোর সময় 'স্নান' শব্দটির ওপর অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। আবার বাইরে যাওয়ার সময় 'যাব' শব্দটি, খাওয়ার সময় খাবো শব্দটি বারবার বলে শিশুকে বোঝাতে হবে।
৮)ইশারায় কথা বললেঃ
শিশু যদি ইশারার সাহায্যে কথা বলতে চায়, তবে সেই ইশারার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ এবং অর্থবোধক শব্দ যোগ করে তাকে কথা বলতে উৎসাহিত করুন। যেমন- শিশু বিদায় জানাতে হাত বাড়ালে আপনি বলুন 'বাই বাই' অথবা 'টা টা'। শিশুকে প্রতিটি মুহূর্তে ইশারার সাথে সাথে মুখে আওয়াজ করে সেই ইশারার সঙ্গতিপূর্ণ আওয়াজ করতে হবে।
৯)খেলার ছলে কথা শেখানোঃ
শিশুকে অনেক সময় খেলার ছলেও কথা শেখানো যায়। যেমন শিশুর সবচেয়ে পছন্দের জিনিসটি একটি নির্দিষ্ট উচ্চতায় রেখে (শিশুর নাগালের বাইরে) তাকে জিনিসটি দেখান। যখন সে ওটা নিতে চাইবে বা আপনার হাত ধরে টানবে, তখন আপনি জিনিসটির নাম একটু স্পষ্টভাবে বলুন। যেমন- যদি 'গাড়ি' হয় তবে বলুন 'ও, তুমি গাড়ি খেলতে চাও?' অথবা 'এই যে তোমার গাড়ি।'
শিশুর অনুকরণের দক্ষতা বৃদ্ধির ওপর বেশি গুরুত্ব দিন। যেমন- শিশুর হাসি বা মুখভঙ্গির অনুকরণ করে দেখান। তারপর আপনার সঙ্গে শিশুকে অন্যান্য শারীরিক অঙ্গভঙ্গি যেমন- হাততালি দেওয়া, হাতের উল্টো পিঠে চুমু খাওয়া ইত্যাদি করান।
১০)প্রতিকী শব্দের ব্যবহারঃ
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, শিশু মূল শব্দের আগে প্রতীকী শব্দ ব্যবহার শুরু করে। তাই এ ক্ষেত্রে আপনিও প্রাথমিকভাবে প্রতীকী শব্দ ব্যবহারে বেশি গুরুত্ব দিতে পারেন। যেমন- গাড়ি বোঝাতে পিপ পিপ। বেড়াল বোঝাতে মিঁউ মিঁউ ইত্যাদি।
যেসব শিশু মাঝেমধ্যে দু-একটি শব্দ বলছে, তাদের শব্দভাণ্ডার বৃদ্ধির ওপর জোর দিন। যেমন- শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ (মাথা, হাত, পা), বিভিন্ন জিনিসের নাম (বল, গাড়ি, চিরুনি), বিভিন্ন ক্রিয়াবাচক শব্দ (খাব, যাব, ঘুম) ইত্যাদি শেখান।
১১)ছবির মাধ্যমে কথা শেখানোঃ
দুই বছরের বড় শিশুদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে পরিচিত এবং অতি পছন্দের ৮-১০টি ছবি নিয়ে একটি বই তৈরি করুন। প্রতিদিন একটু একটু করে বই দেখিয়ে শিশুকে ছবির মাধ্যমে নাম শেখাতে পারেন।
১২)মনোযোগ বৃদ্ধির চেষ্টাঃ
যেসব শিশু চোখে চোখে তাকায় না এবং মনোযোগ কম, আবার কথাও বলছে না, তাদের ক্ষেত্রে আগে চোখে চোখে তাকানো ও মনোযোগ বৃদ্ধির বিভিন্ন কৌশলের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। যেমন- লুকোচুরি খেলা, কাতুকুতু দেওয়া, চোখে চোখে তাকিয়ে শিশুর পছন্দের ছড়াগান অঙ্গভঙ্গি করে গাওয়া।
১৩)প্রকৃতির মাঝে ছেড়ে দিনঃ
প্রকৃতি শিশুর একটা উত্তম শেখার জায়গা। বিভিন্ন বিষয় বস্তুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিন।খোলা মাঠে দৌড়ে কিছু খুঁজতে সাহায্য করুন।
শিশুর কথা বলা শেখাতে যা করা যাবে না
১। শিশুকে কথা বলার জন্য অত্যধিক চাপ যেমন- 'বল, বল' ইত্যাদি একেবারেই করা যাবে না।
২। বাবা মায়ের এক ধরণের প্রবণতা বেশী দেখা যায় সেটা হল শিশুকে একসঙ্গে অনেক শব্দ শেখানোর চেষ্টা করা। এতে শিশু কথা বলার আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারে। স্পিচ অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপি কিছুটা দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসাব্যবস্থা। সঠিক সময়ে এই পদ্ধতির কৌশলগত প্রয়োগ হলে শিশু কথা এবং যোগাযোগের অন্যান্য মাধ্যমে উন্নতি করবেই।
৩।শিশুকে অযথা অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
৪।অনেক মা-বাবাই ভাবেন, অন্যান্য স্বাভাবিক শিশুর সঙ্গে তাদের পিছিয়ে পড়া শিশুর খেলার পরিবেশ করে দিলেই আপনা আপনিই কথা শিখে যাবে। কিন্তু মনে রাখবেন, এমনটা না-ও হতে পারে। তাই নিজেরা বাড়িতে চেষ্টা করুন, প্রয়োজনে স্পিচ থেরাপির সহায়তা নিতে হবে।
সর্বোপরি একজন মাকে হয়ে উঠতে হবে আদর্শ মা।মা-ই সন্তানের প্রকৃত বন্ধু, শিক্ষক।সন্তানের প্রতি যত্নশীল হতে হবে।তাছাড়া পরিবারের সকলের দায়িত্ব শিশুকে সময় দেওয়া, সঠিক সময়ে সঠিক শিক্ষা টা দিয়ে সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ে তোলা।
খুবই সুন্দর তথ্য দিয়েছেন । বিশেষ করে এই লেখাটা আমার কাছে বেশি পছন্দ হয়েছে আর পছন্দ হওয়ার পেছনে কিছু কারণ আছে । ধন্যবাদ আপনাকে।
ধন্যবাদ
দিদি আপনার লেখাটা আমার জন্য অনেকটা উপকারী হয়েছে কারন আমি কিছুদিন পরেই মা হতে যাচ্ছি। আর আমি মনে করি এটা আমার জানা অনেক জরুরী কারন কথাগুলো অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিল ধন্যবাদ আপনাকে।
নিজের খেয়াল রাখেন।আপনি সুস্থ মানেই নতুন অতিথি ভালো থাকা।শুভকামনা রইল।চেষ্টা করবো,১দিন থেকে শুরু করে ৬বছর অব্দি শিশুর যত্ন নিয়ে কিছু তথ্য তুলে ধরতে।
একদম শিক্ষণীয় এবং সচেতনমুলক পোস্ট। যত্নশীল হওয়া শিশুদের প্রতি ।তাদের ভাষা আবেগ বুঝার চেষ্টা করা। সব মিলিয়ে আপনার কন্টেন্ট টা খুবই অসাধারণ হয়েছে।
ধন্যবাদ আপনাকে এইরকম শিক্ষামূলক বিষয় সম্পর্কে তুলে ধরার জন্য।যা আমাদের ভবিষ্যৎ জীবনে কাজে লাগবে।