হুগলি জেলার গর্ব দীনবন্ধু ন্যায়রত্ন। একটি সার্বিক আলোচনা।
হুগলি জেলার গর্ব দীনবন্ধু ন্যায়রত্ন
হুগলী জেলায় একটি বর্ধিষ্ণু শহরতলি কোন্নগর। এই শহর দেখেছে অনেক উত্থানপতন। দেখেছে ডিরোজিয়ান শিবচন্দ্র দেবের হাত ধরে পাশ্চাত্য শিক্ষার জোয়ার। দেখেছে নবজাগরণের কলকাতায় কোন্নগরের ভূমিপুত্র রাজা দিগম্বর মিত্রের ব্যবসায়িক উত্থান। এছাড়াও এ শহর দেখেছে অরবিন্দ ঘোষের বাবা কৃষ্ণধন ঘোষকে লিবারাল হিন্দুর ভূমিকায়। কিন্তু এই স্মৃতির সরণিপথে এই শহরেরই একজন বিস্মৃতপ্রায় মানুষ হলেন পণ্ডিত দীনবন্ধু ন্যায়রত্ন। নবদ্বীপের সংস্কৃত শিক্ষার উত্তরসূরী এই পণ্ডিতের পাণ্ডিত্যের কথা একসময় সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে। ছোট্ট শহর কোন্নগর হয়ে ওঠে ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় নবদ্বীপ। বাংলায় কেরী, মার্শম্যান, ডেভিড হেয়ারদের হাত ধরে ইংরাজি শিক্ষার ঝড় ওঠবার আগে বাংলায় শিক্ষাব্যবস্থা ছিল টোলনির্ভর। কোন্নগরে গঙ্গার ধারে দীনবন্ধু ন্যায়রত্নের টোলে বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষ আসতেন শিক্ষা নিতে। তাঁর শিক্ষা পদ্ধতি তখন বাংলার শিক্ষামানচিত্রে এক তুফান এনেছিল।
শোনা যায় এখনকার মতো একজন একজন করে ছাত্রদের ডেকে আলাদা করে গ্রুমিং করবার পদ্ধতিকে সেযুগে তিনি নিয়ে এসেছিলেন তাঁর টোলে। তখন পাণ্ডিত্যের স্বীকৃতিতে মহামহোপাধ্যায় উপাধি দেওয়া হত। যে উপাধি পরে পান আর এক বাংলার সাহিত্য সাধক হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। আর কোন্নগরের গর্ব দীনবন্ধু পণ্ডিতও তাঁর পাণ্ডিত্যের আলোয় এর অনেক আগে পেয়েছিলেন এই উপাধি। তাঁর টোলটি ছিল এক অদ্ভুত মায়ামন্দিরের মতো। সামনে কাঁচা উঠোন। পূর্বদিকদ সাত আটখানা কাঁচা ঘর। প্রত্যেক ঘরের পূর্বদিকে একটি করে জানলা ও তার বিপরীতে দরজা। আবার পশ্চিমেও সাত আটটি ঘর ও পশ্চিমে একটি করে জানলা এবং বিপরীতে দরজা। যেন এক সাজানো পরিপূর্ণ শিক্ষালয়। মাঝখানে ছিল একটি চণ্ডীমন্ডপ। সেখানেই তিনি ছাত্রদের ডেকে শিক্ষাদান করতেন। কিন্তু এরপরপরই শ্রীরামপুরে কেরী, মার্শম্যান, ওয়ার্ড সাহেবদের হাত ধরে কোন্নগরে শুরু হয় ইংরাজি শিক্ষার প্রচলন। সেই সময় কোন্নগর ছিল ড্যানিশ শ্রীরামপুরের বৃহত্তর অংশ। তখন কোন্নগর হাতির কুলে (বলা হয় নবাবী আমলে হাতি রাখবার জায়গা ছিল বলে এমন নাম) একটি ছোট্ট ঘর তৈরি করে সেখানে পড়াতে আসতেন স্বয়ং কেরী সাহেব, এমনকি সেখানে আসতেন জোশুয়া মার্শম্যানের স্ত্রী ও শ্রীরামপুরের মানবিক মুখ ও জাতির জননী হানা মার্শম্যান৷
কিন্তু মহামহোপাধ্যায় দীনবন্ধু বাংলায় এই ইংরাজি তথা ম্লেচ্ছভাষার প্রচার মোটেই ভালোভাবে নেন নি৷ কিন্তু সময় কবেই বা কার দাবী মেনেছে। দেশে ইংরাজি শিক্ষার জোয়ার সারা বাংলার সাথে ভাসিয়েছিল কোন্নগরকেও। ডিরোজিওর নব্য ভাবধারার প্লাবন ছড়িয়ে পড়ে এই শহরেরও ঘরে ঘরে। মহাত্মা শিবচন্দ্র দেব দেবদূতের মতো নিজের ডেপুটি কালেক্টরের চাকরিতে অবসরের পরে ব্রতী হন কোন্নগরে শিক্ষার উন্নতিকল্পে। ধীরে ধীরে পাল্টাতে শুরু করে কোন্নগর। কিন্তু সময়ের সরণি বেয়ে হেঁটে গেলে উজ্জ্বল আলোকবিন্দু হিসাবে আজও দৃষ্টি আকর্ষণ করেন পণ্ডিত দীনবন্ধু ন্যায়রত্ন ও তাঁর কোন্নগরস্থিত টোল৷
🙏 ধন্যবাদ 🙏
(১০% বেনিফিশিয়ারি প্রিয় লাজুক খ্যাঁককে)
--লেখক পরিচিতি--
কৌশিক চক্রবর্ত্তী। নিবাস পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলায়। পেশায় কারিগরি বিভাগের প্রশিক্ষক। নেশায় অক্ষরকর্মী। কলকাতায় লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের সাথে দীর্ঘদিন যুক্ত৷ কলকাতা থেকে প্রকাশিত কবিতার আলো পত্রিকার প্রধান সম্পাদক। দুই বাংলার বিভিন্ন প্রথম সারির পত্রিকা ও দৈনিকে নিয়মিত প্রকাশ হয় কবিতা ও প্রবন্ধ। প্রকাশিত বই সাতটি৷ তার মধ্যে গবেষণামূলক বই 'ফ্রেডরিক্স নগরের অলিতে গলিতে', 'সাহেবি কলকাতা ও তৎকালীন ছড়া' জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। সাহিত্যকর্মের জন্য আছে একাধিক পুরস্কার ও স্বীকৃতি। তার মধ্যে সুরজিত ও কবিতা ক্লাব সেরা কলমকার সম্মান,(২০১৮), কাব্যলোক ঋতুভিত্তিক কবিতায় প্রথম পুরস্কার (বাংলাদেশ), যুগসাগ্নিক সেরা কবি ১৪২৬, স্রোত তরুণ বঙ্গ প্রতিভা সম্মান (২০১৯), স্টোরিমিরর অথর অব দ্যা ইয়ার, ২০২১, কচিপাতা সাহিত্য সম্মান, ২০২১ তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
কমিউনিটি : আমার বাংলা ব্লগ
ধন্যবাদ জানাই আমার বাংলা ব্লগের সকল সদস্যবন্ধুদের৷ ভালো থাকুন, ভালো রাখুন।
সমৃদ্ধ হলাম বরাবরের মতোই৷ তোমার এই সমস্ত লেখাগুলোর জন্যই তোমার প্রতি শ্রদ্ধা বেড়ে যায়। এতো নিপুন ঐতিহাসিক আলোচনা করো। আমি মাঝে মধ্যে অবাক হয়ে যাই৷ অবশ্য কোন্নগর সম্পর্কে তোমার জ্ঞান থাকাই স্বাভাবিক।
ভীষণ ভালো লাগলো তুই লেখাটি পড়ে এত সুন্দর মন্তব্য করলি বলে।