মাহেশের মন্দির

💮মাহেশের রথ💮

বঙ্কিমচন্দ্রের রাধারানী উপন্যাসে রাধারানীর রথের মেলায় হারিয়ে যাওয়ার ঘটনাটা মনে আছে? সেই জায়গা কোথায় বলুন তো? আর কোথাও নয় সেটি হল হুগলি জেলার বিখ্যাত মাহেশের রথে। হাওড়া স্টেশনের পূর্ব রেলের শাখায় যেকোনো মেন লাইনের লোকাল ট্রেনে চেপে শ্রীরামপুর স্টেশনে নেমে অটো বা টোটোয় মাত্র মিনিট পনেরোর পথ। রাস্তার ওপরেই দাঁড় করানো থাকে কয়েক শতাব্দী প্রাচীন রথটি৷ আর তার পাশেই লাগোয়া মাঠ ও মন্দির। সেখানে জগন্নাথের স্নানযাত্রার বেদী। যে রথযাত্রার কথা বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসে উঠে আসে, যে রথযাত্রা প্রায় দীর্ঘ ৬০০ বছর ধরে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে নিরবচ্ছিন্ন ধারায়, সেই রথের কথা আজ রথযাত্রার দিন আপনাদের সামনে না আনলেই নয়। রথযাত্রা এমন এক তিথি, যেদিন উড়িষ্যার নীলাচলে বা পুরীতে জগন্নাথদেব তার দাদা বলরাম ও ভগিনী সুভদ্রাকে নিয়ে রথে চড়ে মাসির বাড়ি যান। আর সেইসঙ্গে সারা পৃথিবী জুড়ে পালিত হয় রথযাত্রা মহোৎসব। আজ সেই রথযাত্রা। সারা ভারতবর্ষে ধর্ম বর্ণ ভুলে মানুষ মেতে ওঠে এই উৎসবে। কলকাতার রাস্তাতেও নামে রথ।

মাহেশের মন্দির

মাহেশের রথযাত্রা পুরীর পরেই পৃথিবীর প্রাচীনতম রথযাত্রা। আজও প্রতিবছর নিয়ম করে এই দিনে রথ বেরোয় মাহেশের মন্দির থেকে। সেখানে ধুমধাম করে চড়ে বসেন জগন্নাথ বলরাম ও সুভদ্র। কলকাতার শ্যামবাজারের বসু পরিবার এই রথের যাবতীয় দায়িত্বভার কাঁধে নিয়ে সম্পন্ন করেন সবকিছু। বংশপরম্পরায় তারাই এই মন্দিরের প্রধান সেবায়েত। মাহেশের রথের সঙ্গে জুড়ে আছে ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারীর নাম। শোনা যায় তিনি জগন্নাথ দর্শনে পুরীধাম গেলে, সেখানে বিগ্রহদর্শনে বাধাপ্রাপ্ত হন এবং স্বপ্নাদেশ পান হুগলি জেলায় গঙ্গার পশ্চিম কূলে ভেসে আসা কাঠ থেকে নির্মাণ করতে হবে ত্রিদেব। জগন্নাথ বলরাম ও সুভদ্রা। এরপর তিনি তাই করেন এবং জগন্নাথের বাড়িতেই নিজে আশ্রয় নিয়ে সেবা করতে থাকেন তিন বিগ্রহকে। এই হল মাহেশের জগন্নাথের প্রাচীন ইতিহাস। এরপর শ্রীচৈতন্যদেবের পদধূলি পড়ে মাহেশে৷ তিনি স্বয়ং মাহেশের জগন্নাথ দর্শন করতে আসেন পদব্রজে নীলাচল যাবার সময়। তারপর থেকে তাঁরই ভক্ত কমলাকর পিপলাই সেই মন্দিরের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। পরে শেওড়াফুলির রাজা মনোহর রায় এই মন্দিরের সংস্কার কার্য সম্পন্ন করেন। মাহেশের প্রাচীনত্ব বাংলার সংস্কৃতিতে উল্লেখযোগ্য একটি বিষয়। বর্তমানে মন্দিরের সংস্কার কার্য হয়ে ঝাঁ চকচকে মন্দির প্রাঙ্গণ এবং রথ সারা বছর ভক্তদের আকর্ষণ করে। মহা আড়ম্বরে পালিত হয় জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা উৎসব। লাখো লাখো ভক্তগণ এসে মিলিত হয় মাহেশে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন -

রথযাত্রা, লোকারণ্য, মহা ধুমধাম,
ভক্তেরা লুটায়ে পথে করিছে প্রণাম।
পথ ভাবে আমি দেব রথ ভাবে আমি,
মূর্তি ভাবে আমি দেব, হাসে অন্তর্যামী।

💮রথযাত্রার তাৎপর্য💮

মাহেশের রথ

রথযাত্রা ভারতবর্ষের একটি প্রধান উৎসব। উড়িষ্যার পুরীতে এই উৎসব সারা পৃথিবীর মধ্যে এক অন্যতম প্রধান উৎসব হিসেবে পরিচিত। সেখানে তিন ঠাকুরের জন্য তিনটি ভিন্ন রথ নির্মাণ করা হয়। জগন্নাথের রথের নাম নন্দীঘোষ, বলরামের রথ তালধ্বজ, এবং সুভদ্রার রথের নাম দেবীদলন বা দর্পদলন। আজ রথযাত্রার দিন সেই তিনটি রথ জগন্নাথ মন্দির থেকে রওনা হয় মাসির বাড়ি অর্থাৎ গুন্ডিচা মন্দিরের উদ্দেশ্যে। জগন্নাথের মাসির বাড়ি যাওয়া আসলে এক লোককথা৷ আসলে বৈষ্ণবরা বিশ্বাস করেন এই উৎসব হল শ্রীকৃষ্ণের মথুরায় ফিরে আসার এক মহড়া বা পালা উদযাপন। সেই কারণে ঠিক নয়দিন পরে উল্টোরথ উৎসবের মধ্যে দিয়ে জগন্নাথ দেব আবার ফিরে আসেন নিজ গৃহে। এই নয়দিন পুরীতে জগন্নাথ দর্শন হয় গুন্ডিচা মন্দিরে। এই নয় দিন মূল মন্দিরের বদলে সেখানেই ছাপ্পান্ন রকম ভোগের মাধ্যমে সেবিত হন প্রভু জগন্নাথ। পুরীর মন্দির আজও সারা পৃথিবীর কাছে এক মূল্যবান স্থাপত্য। আর সেখানকার সব থেকে বড় উৎসব হল রথযাত্রা। আজ এই তিথিতে তাই আপনাদের সকলের সামনে সংক্ষেপে নিয়ে এলাম রথযাত্রা নিয়ে বিভিন্ন ইতিহাস ও ঘটনাবলী।

💮জগন্নাথ বলরাম সুভদ্রা💮

রত্নবেদীতে বিগ্রহ, মাহেশ

আপনারা জানেন জগন্নাথের হাত পা নেই। এর পেছনেও জুড়ে আছে দীর্ঘ লোককথা। একসময় নীলাচলের মহারাজা ইন্দ্রদূম্ন স্বপ্নাদেশে সমুদ্রে ভেসে আসা নিমকাঠ থেকে জগন্নাথ বলরাম সুভদ্রা মূর্তি বানাতে প্রস্তুত হন। মূর্তি নির্মাণের জন্য বাসুদেব মহারানা নামে একজন শিল্পী দায়িত্বভার গ্রহণ করেন৷ তিনি আর কেউ নন, স্বয়ং দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা। কিন্তু তিনি রাজাকে শর্ত দেন মূর্তি নির্মাণকালে একুশ দিন যাবৎ রাজা কোন কৌতুহলবশত মূর্তি দর্শন করতে পারবেন না। কিন্তু সেই শর্ত রাজা মেনে চলতে পারেননি। তাই কিছুদিন পরে মূর্তি নির্মাণের ঘরে কৌতুহলবশত দরজা খুললে বিশ্বকর্মা অপ্রকট হয়ে যান এবং মূর্তি পড়ে থাকে অসম্পূর্ণ অবস্থায়। এই হল অসম্পূর্ণ জগন্নাথ মূর্তির লোককথা ও পুরাণ।

💮আরও কিছু কথা💮

উড়িষ্যার সাথে সাথে হুগলির মাহেশেও আজ উৎসবের পরিবেশ। বহুবার এই দিনে পৌঁছে গেছি মাহেশের রথ দেখতে। কিন্তু তুমুল ভিড় আমি কোনদিনই পছন্দ করি না। তাই ভিড়ের মধ্যে যেতে বরাবরই বড় ভয় করে। তাছাড়া আজ এই উৎসবের জন্য বন্ধ থাকে রাস্তায় গাড়ি চলাচলও৷ এই বিষয়গুলো কোনোদিনই আমার পছন্দ নয়। কোনো কারণে সাধারণ মানুষের হয়রানি কোনোদিনই মেনে নিতে পারিনি মন থেকে। কোন উন্মাদনাই যেন মানুষের হয়রানির কারণ না হয় তা আমাদেরই দেখা উচিত। কিন্তু কতটা দেখি আমরা? বাঙালি উৎসবপ্রেমী জাতি। আনন্দ মুখর জাতি৷ তাই উৎসবে মেতে ওঠে বরাবরই। কিন্তু সেই কারণে অন্যের অসুবিধা হলে সেই উৎসবের আবহ নষ্ট হয় বলে মনে করি। তাই সবদিনই মনে করি, উন্মাদনা থাক, কিন্তু অন্যের অসুবিধা না করে। আজও দুর্গাপুজোর বিসর্জন শোভাযাত্রায় কোন অ্যাম্বুলেন্স আটকে গেলে মনের মধ্যে যন্ত্রণা হয় নিজের অজান্তেই। আনন্দ উৎসব থাক, কিন্তু তা হওয়া উচিৎ অন্যের দিক লক্ষ্য করেই।

💮রথের মেলা💮

রথের সাথে জুড়ে আছে মেলার ঐতিহ্য। রথ আর রথের মেলা যেন পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। রথ দেখতে গিয়ে রথের মেলা কে না ঘুরেছে। কলকাতা শহরে ও আশেপাশে বহু জায়গায় বসে রথকে কেন্দ্র করে মেলা৷ রথযাত্রায় মনে পড়ে বাবা মায়ের হাত ধরে শিয়ালদার নিকটে মৌলালিতে রথের মেলায় যাওয়ার স্মৃতি। রথের মেলা মানেই পাঁপড়ভাজা, জিলিপি আর পাখি ও গাছের দোকান। বাঙালির জীবনের সাথে রথযাত্রা যেন আষ্টেপৃষ্ঠে মিশে আছে দীর্ঘদিন ধরে।

এমন ভাবেই টিকে থাক বাঙালির ঐতিহ্য এবং নিজস্বতা। সকলের রথের মেলার সাথে যুক্ত সকল স্মৃতি উজ্জ্বল থাক আজীবন। সর্বোপরি আজ ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি সকলে ভালো থাকুন এবং জীবন মঙ্গলময় হয়ে উঠুক। এই কঠিন সময়ে ঈশ্বর সকলকে লড়াই করবার শক্তি দান করুন।

---

চিত্রগ্রহণ	রেডমি প্রো ৯
ক্যামেরা	২০ মেগাপিক্সেল
চিত্রগ্রাহক	কৌশিক চক্রবর্ত্তী