যেভাবে আমি উত্তরাধিকারসূত্রে ভারত এবং বাংলাদেশের।।

আমার ঠাকুরদা অথবা আমরা বলি 'দাদা' বাড়ি ভারতের বারাসাতে। উনি তৎকালীন ভারতবর্ষে পুলিশে কর্মরত ছিলেন, ট্রানস্ফারড ছিলেন বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গে। সেই সূত্রেই ওনার বাংলাদেশে থাকা।

না, আমাদের কখনও আমার ঠাকুরদার বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। আসলে আমাদের ওই বাড়ির সাথে সম্পর্কই হয়ে ওঠেনি। ঠাকুরদাকে আমরা কখনো চোখেও দেখি নি। উনি অনেক অল্প বয়সে পরপারে চলে গেছেন। আমাদের ভারতের বাড়ির সাথে অথবা আমাদের ভারতে বসবাসরত আত্মীয়-স্বজনের সাথে কোন যোগাযোগ নেই / হয় না। সে এক বিশাল ইতিহাস।

আজ আমি আপনাদের সেই গল্পটাই বলবো।

laurentiu-morariu-PclODHezt-0-unsplash.jpg
source

আমার ঠাকুরদার যেহেতু চাকরি সূত্রে বসবাস বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের রংপুর জেলায় ছিল, সেই সূত্রেই উনিই বিয়ে করেন বাংলাদেশি এক মেয়েকে। স্বাভাবিকভাবেই উনার ভারতে বসবাসরত পরিবার এই বিষয়টিকে সহজভাবে নিতে পারেননি। এই নিয়ে মনোমালিন্যে কারণে ভারত এবং বাংলাদেশে থাকা পরিবার ধীরে ধীরে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করে। কিন্তু তারপরও সম্পর্কটা টিকে ছিল।

ভারতের সাথে সম্পর্কটা পুরোপুরি শেষ হয়ে যায় যখন আমার দাদাকে/ঠাকুরদাকে দ্বিতীয় বিয়েতে বসতে হয়। আমার প্রথম ঠাকুরমা/দাদী নিঃসন্তান ছিলেন, উনিই আমার ঠাকুরদা কে দ্বিতীয় বিয়ে করিয়েছিলেন। যাতে তার পুরো জীবন নিঃসন্তান না কাটে। যেহেতু প্রথম থেকেই ভারতে বসবাসরত ঠাকুরদার পরিবার বাংলাদেশে ওনার স্থায়ীভাবে থাকাটাকে পছন্দ করছিলেন না, তার উপরে আবার বাংলাদেশি আরেক মেয়েকে দ্বিতীয় বিয়ে। এই বিষয়টাকে ওনারা পুরোপুরি নারাজ হয়ে। সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে দেন।

তার উপরে আমার ঠাকুরদার বাবা-মা দুজনেই পরপারে চলে গিয়েছিলেন। সে কারণে ঠাকুরদার ভাইবোনেরা খুব একটা যোগাযোগ রাখছিলেন না। বুঝতেই পারছেন, কারণ এখানে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া জমির বন্টন এর ব্যাপার আছে।

আমার প্রথম ঠাকুরমা আমাদেরকে বড় করেছেন বলতে গেলে। উনার নিজের সন্তান ছিল না বলেই হয়ত আমাদেরকে খুব আদর যত্ন বড় করেছেন। উনার সাথে ভারতের পরিবারের কিছু যোগাযোগ ছিল উনি মারা যাওয়ার পর সেটা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

আর আমার বাবা অথবা আমার চাচারাও আর কেউ সেই যোগাযোগটা পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করে নি। কেননা নতুনভাবে এই সম্পর্ক আবার শুরু করার চেষ্টা করলেই সবাই ধরে নিত যে আমরা জমিজমা অথবা উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পত্তির কারনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছি। তার থেকে আমরা বাংলাদেশে যেভাবে আছি পুরো পরিবার নিয়ে সেভাবেই অনেকটা ভালো আছি বলা চলে।

will-francis-Rm3nWQiDTzg-unsplash.jpg
source

কিন্তু কোথায় যেন একটা ফাঁকা বোধ হয়, মনের ভিতরে। মাঝে মাঝে নিজেদের অপূর্ণ মনে হয়। মনে হয় কি যেন নেই কি যেন নেই। হ্যাঁ, আমাদের অর্ধেক আত্মীয়ই নেই; বলতে গেলে। পুরো পরিবার নিয়ে যখন কোনো কথা হয়, আমার ছোট ঠাকুমার পরিবার নিয়ে কোন কথা, কে কেমন ছিলেন অথবা কোন একটা পুরোনো ঘটনা, আমার ঠাকুরদার পরিবারের এরকম কোন ঘটনা সামনে আসেনা কারন আমরা সেগুলো জানিনা। অথবা অসুস্থতা নিয়ে কোন উদাহরন যেমন অনেকেই বলেন উনার ঠাকুরদার এরকম আচরণ ছিল অথবা এই রোগটা ছিল, সে কারণে পরবর্তীতে আমাদের হয়েছে। আমরা আসলে এগুলোর কোন উদাহরন দিতে পারি না কারণ আমরা এগুলো নিয়ে কিছু জানিনা।

ঠাকুরদার ভারতে বসবাসরত পরিবার তো অনেক দূরের কথা, ঠাকুরদা যেহেতু নিজেই অনেক অল্প বয়সে মারা গেছেন, উনার কোনো স্মৃতি আমাদের মধ্যে নেই। উনার স্মৃতি বলতে শুধু ওনার রেখে যাওয়া হাতঘড়ি আর কিছু টুকটাক জিনিস। তবে আমার ঠাকুরমা এখনও আমার ঠাকুরদার পুলিশের চাকরির/ সরকারি চাকরির সুবাদে ওনার পেনশন পান।

এইতো, এই হল সেই ইতিহাস। উত্তরাধিকারসূত্রে আমরা ভারতের হতে পারি কিন্তু সেই সম্পর্কটি যেহেতু আর গড়ে উঠেনি, সেহেতু উত্তরাধিকার টানাটাও খুব একটা যুক্তিযুক্ত নয়।

এখনো মাঝে মাঝে মনে হয় কেমন হতো যদি আমার ঠাকুরদার পরিবারের সাথে আমাদের যোগাযোগ থাকত, আমরা জানতে পারতাম ওনার বেড়ে ওঠা, উনার পরিবারের মানুষ কেমন ছিল সেসব নিয়ে। কিন্তু সেগুলো শুধু চাওয়া পাওয়া হয়ে ওঠেনি কখনো, হয়তো আর হবে ও না।

আমার লেখাটা পড়ার জন্য ধন্যবাদ।

Sort:  
 3 years ago 

ভালো লিখেছেন আপনার অতীতের ঘটনাগুলো নিয়ে ধন্যবাদ আপনাকে ।

আপনাকেও ধন্যবাদ আমার লেখাটা পড়ার জন্য।

 3 years ago 

দেশভাগ একটা যন্ত্রনাময় অতীত । একই বাংলার মানুষ আজ দুটি ভিন্ন দেশের লোক । লেখাটি খুবই ভালো হয়েছে ।

সেটাই মাঝে মাঝে ভাবি। নোংরা পলিটিক্সের কারণে পুরো ইতিহাস, সংস্কৃতি কিভাবে পরিবর্তন হয়ে গেছে। কত পরিবার আলাদা হয়ে গেছে। পরিবার না থাকার কষ্ট অনেক বেশি।
ধন্যবাদ আমার লেখা পড়ার জন্য।

Coin Marketplace

STEEM 0.15
TRX 0.12
JST 0.026
BTC 56095.11
ETH 2533.38
USDT 1.00
SBD 2.23