আমার দাদা বাড়ি ফরিদপুর জেলার একটি প্রত্যন্ত গ্রামে। এমন গ্রাম যেখানে ছোটবেলায় দেখেছি যাতায়াতের জন্য ছিল না কোন ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থা। গ্রীষ্মকালে পায়ে হেঁটে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে তবেই দাদা বাড়ি পৌঁছানো যেত। আর বর্ষাকালে একমাত্র ভরসা ছিল নৌকা। গ্রামের আশেপাশে অন্তত 20/30 কিলোমিটার এর মধ্যে বিদ্যুৎ ছিল না। সন্ধ্যা হলেই ঘরে ঘরে জ্বলে উঠতো কুপি আর হারিকেন। রাত আটটা নয়টার পর কোন ঘরের মানুষই আর জেগে থাকত না। তখন ছিল অন্ধকারের রাজত্ব। এগুলো আমার নিজ চোখে দেখা। আজ থেকে প্রায়২৫/৩০ বছর আগের ঘটনা কিন্তু যে ঘটনা বলব সেটা আরো আগের। আমার দাদার যৌবন বয়সের। তাহলেই বুঝতে পারবেন কোন সময়ের কথা বলছি আর তখন পরিবেশ কেমন ছিল।
করিমের বাড়ি আমার দাদা বাড়ির পাশেই। ছোটবেলা থেকেই করিমের মাছ ধরার নেশা। গ্রাম থেকে কয়েক মাইল দূরে ছোট কোল অবস্থিত। এটা আসলে একটা ছোটখাটো বিল। শীতের সময় পানি কমে গিয়ে আকৃতিতে ছোট হয়ে গেলেও বর্ষাকালে বিশাল আকৃতি ধারণ করে এই বিল। আর এখানে মাছ পাওয়া যায় প্রচুর। করিম আর তার বন্ধু আক্কাস দুজনে মাঝে মাঝেই এই ছোট কোলে মাছ ধরতে যায় নৌকা নিয়ে আবার কখনো বা যায় ট্যাটা বা কোচ নিয়ে। বিশেষ করে রাতের বেলা কোচ দিয়ে মাছ ধরা অনেক সুবিধা। মাছগুলো সব তীরের দিকে অল্প পানিতে চলে আসে। তখন টর্চের আলো ধরলে মাছগুলো স্থির হয়ে যায়। কোচ দিয়ে সহজেই গেথে ফেলা যায়। এক বর্ষার সময়ে আক্কাস আর করিম দুই বন্ধু পরিকল্পনা করল ভোররাতে কোলে যাবে মাছ ধরতে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ভোররাতে আক্কাস এসে করিমকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে যাবে।
ফজরের আজানের ঘন্টাখানিক আগে করিমের ঘরের দরজার কড়া ধরে কে যেন ডাকাডাকি শুরু করল। করিমের বউ তার পাশ থেকে ধাক্কা দিয়ে ডেকে বলল তোমার দোস্ত আইছে মনে হয়। করিম বলল দাড়া আইতাছি। ঝটপট টর্চ আর কোচ নিয়ে বেরিয়ে পড়ল সে। ঘড় হতে বের হতেই দেখল তার বন্ধু তার থেকে হাত বিশেক দূরে হনহন করে হেটে যাচ্ছে সামনের দিকে। করিম কথা না বাড়িয়ে পা চালিয়ে তার পিছু নিল কিন্তু পথে নামতেই দেখল টর্চের ব্যাটারি শেষ। কিছুতেই আলো জ্বলছে না লাইটের। কি আর করা নিভু নিভু টর্চ নিয়েই বন্ধুর পিছু পিছু চলল সে। কিছুদূর যাবার পর চেনা রাস্তা ছেড়ে অন্য পথ ধরল তার বন্ধু। করিম বলল কিরে এই দিহে যাস কেন। জবাবে তার বন্ধু বললো এইদিহে এহন মাছ বেশি পাওয়া যায়। একসময় করিম হাটতে হাঁটতে কিছুটা ক্লান্ত হয়ে গেল, তার ধারণা এতক্ষণে ছোট কোলে পৌঁছে যাবার কথা কিন্তু পথ যেন আজ ফুড়াচ্ছেই না। অন্যদিকে সে যতই জোরে হেঁটে বন্ধুর কাছাকাছি যাবার চেষ্টা করে বন্ধুও যেন আরো দ্রুত হেটে তার সঙ্গে দূরত্ব বাড়িয়ে ফেলে। করিম জিজ্ঞেস করে, কিরে কোন রাস্তায় আইলি। এত দেরি লাগে কেন। জবাবে সামনে থেকে উত্তর আসে এইতো আইয়া পরছি। হঠাৎ তার শরীরের সমস্ত লোম ভয়ে দাঁড়িয়ে গেল। তবে কি সে ভুলো ভূতের পাল্লায় পড়েছে। গ্রামে এমন অসংখ্য ঘটনা প্রচলিত আছে ভুলো বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে বিলের পানিতে চুবিয়ে মারার। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। বেলা মাথার উপর উঠে যাবার পরেও করিম যখন বাড়ি ফিরল না তখন তার বউ পাড়া-প্রতিবেশীদের বলতেই সবাই বেরিয়ে পড়ল করিমের খোঁজে। ছোট কোলের সবচাইতে নির্জন আর কর্দমাক্ত জমিতে কাদার মধ্যে উপুড় হয়ে পরে থাকতে পাওয়া গেল করিমকে। সারা গায়ে অসংখ্য আচরের দাগ আর কাঁদায় মাখামাখি। অনেক বদদি আর কবিরাজ দেখানোর পরে জ্ঞান ফিরলেও আগের কথা তার কিছুই মনে নেই। অন্যদিকে আকাশকে জিজ্ঞেস করে জানা গেল পেট ব্যথার জন্য সে ঘর হতে বের হতেই পারেনি ওই রাতে।
আপনাদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে তাহলে এই ঘটনা সবাই জানলো কিভাবে আসলে পরবর্তীতে সুস্থ হয়ে জ্ঞান ফেরার পর করিম বলেছিল এই গল্প আমি যেমন শুনেছিলাম তেমনটাই বললাম বিশ্বাস করা না করা আপনাদের ব্যাপার। আজকের মতো এতোটুকুই। আবার কথা হবে অন্য কোন বিষয় নিয়ে। সবাই ভালো থাকবেন সুস্থ থাকবেন এই কামনায় আজকের মত এখানেই শেষ করছি।
ভাই আগের দিনে এমন ঘটনা নাকি সত্যিই ঘটতো। আমি আমার ফুফুর মুখে এমন গল্প শুনতাম। ভয়ে জরসড় হয়ে বসতাম একদম। আজ আপনার লেখা টা রাতের বেলা পড়ছিলাম আর ভাবছিলাম কি ভুলে যে পড়তে নিলাম 😉। সত্যি বলতে আমার বেশ ভয় লাগে ভাই । এই জন্য আমি হরোর মুভিও দেখি না। তবে করিম সাহেব যে বেঁচে ছিলেন এটাই অনেক বড় ব্যাপার।
আমার কাছে ব্যাপারটা সম্পূর্ণ উল্টো। রাতের বেলা হরর মুভি দেখতেই আমার কাছে বেশি ভালো লাগে। আর আমিও এমন ভৌতিক গল্পের পোকা। ছোটবেলায় যে কত গল্প শুনেছি তার হিসেব নেই। মতামত শেয়ার করার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ ভাই।
ছোটবেলায় আমরা যখন দাদু বাড়িতে যেতাম তখন কারেন্ট ছিল না। আমরা সকলেই হারিকেন জ্বালিয়ে বসতাম সন্ধ্যার সময়। ঠিকই বলেছেন গ্রামের বাড়িতে সবাই সকাল সকাল ঘুমিয়ে পড়তো।
এরকম গল্প ছোটবেলায় অনেক শুনেছি আব্বুর কাছে। কারেন্ট চলে গেলে আমরা সবাই বসে এ ধরনের গল্প আব্বুর কাছে শুনতাম। আগে মনে হয় এরকম গল্প কাহিনী অনেক ঘটতো । আপনার গল্পটি পড়ে এবং ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেল।
আগের সেই দিনগুলোকে খুব মিস করি। দাদা দাদির কাছে কত গল্প যে শুনেছি তার হিসাব নেই। হারিকেনের আলোয় রাতের বেলা সবাই মিলে গল্প শোনায় যে কি আনন্দ তা বলে বোঝানোর মত নয়।