পর্ব -২| অন্ধকারের গল্প ( 10% @shy-fox এবং 5% @abb-school এর জন্য বরাদ্দ )
তো‚ যে টপিক নিয়ে লেখার জন্য এই সিরিজ শুরু করা। অন্ধকারের গল্প। বলা ভালো অন্ধকার শুরুর গল্প। প্রতিটা গল্পের খলনায়কের খলনায়ক হওয়ার গল্প। আমরা একটা মানুষকে যেভাবে দেখি‚ মানুষটার সেই অবস্থায় আসার পেছনের কোন ঘটনা লুকিয়ে আছে তা বেশিরভাগ মানুষই জানার চেষ্টা করে না। অথচ প্রতিটা মানুষই জন্মায় ফাঁকা স্লেট হয়ে। তারপর পরিস্থিতি তাদের এক একটা নির্দিষ্ট পরিচিতি দেয়।
এটা আমাদের পাড়ার ঘটনা। আমাদের বাড়ির থেকে কয়েকটা বাড়ির পরেই থাকে। বড় চাকুরে। মাস গেলে সম্ভবত লাখের কাছাকাছি উপার্জন করে। অসম্ভব ভদ্রলোক‚ পাড়ায় আজ পর্যন্ত কারও সাথে কোনো ঝামেলা ওনার হয়নি বরং অন্যকে যথেষ্ট সাহায্য করে বিপদে আপদে‚ পারিবারিক দিক থেকেও একেবারে ঠিকঠাক। নিজের স্ত্রীকে একেবারে রাজরানীর মতো রেখেছে। ছেলেমেয়েদের জন্যও যথাসাধ্য করেন বাবা হিসাবে। মানে এক কথায় একজন আদর্শ মানুষ হতে গেলে যা যা প্রয়োজন সবই প্রায় আছে ওনার! তবে শুধু একটা জিনিস বাদে‚ মায়ের প্রতি ভালোবাসা। ভদ্রলোক নিজের মাকে একদমই দেখতে পারে না। দেখতে পারেনা বললেও কম বলা হয়‚ সহ্যই করতে পারেনা। বাড়ির এক কোনে ভদ্রমহিলা মানে ওনার মা পড়ে থাকে। বিধবা মানুষ। পেনশনের টাকায় একাই রান্না করে‚ একাই খায়। যদি শরীর খারাপ থাকে বা কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ আসে আর ঘরে যদি রসদ না থাকে তাহলে শুধু জল খেয়েই পেট ভরাতে হয়। এমন হয়েওছে কয়েকবার।
স্বাভাবিকভাবেই পাড়ার সবাইই লোকটার এই আচরণের সমালোচনা করত নিজেদের মধ্যে। পাড়ার বউদের আলোচনার অন্যতম হট টপিক ছিলো লোকটার পারিবারিক কেচ্ছা। এছাড়াও যা হয় আরকি‚ মানুষের মুখে মুখে গল্প ডানা ছড়ায়। কেউ বলে বাড়ির বউটা কালোজাদু করেছে যাতে ছেলে আর মার ঝামেলা হয়। কেউ বলে যে নারী নির্যাতনের মিথ্যে কেস করার ভয় দেখিয়ে বউটা বরকে বাধ্য করেছে নিজের মায়ের থেকে আলাদা থাকতে। কেউ সেখানে আবার পরকীয়া তত্ত্ব নিয়ে আসে তো কেউ আবার অন্য কোনো কাহিনী খাড়া করে। মোটের উপর লোকটাকে নিরীহ বলদমার্কা বানিয়ে আর বউটাজে কুচক্রী বানিয়ে বেশ কিছু ষড়যন্ত্রতত্ত্ব ধরনের গল্প বাজারে চলত। তবে কিনা কেউ ওদের সামনাসামনি কিছু বলত না কারণ আগেই বলেছি‚ পরিবারটার সাথে সবার সম্পর্ক ভালো ছিলো।
কিন্তু ভেতরের আসল খবর জানতাম আমি। বলা ভালো যে পুরো পাড়ার মধ্যে জানতাম আমি আর আমার মা। ওই বাড়ির বাচ্চা মেয়েটা আমার মার কাছে টিউশন নিতে আসত। সেখানেই একদিন বউটা মাকে বলেছিল আসল ঘটনা। আমিও কাছে থাকায় আমিও তা শুনতে পাই।
লোকটা অর্থাৎ যার কথা শুরুতেই বলেছিলাম সে ছিলো আসলেই একজন হতভাগ্য। তার জন্মের সময় তার বাবার সন্দেহ জাগে যে এই বাচ্চাটা তার নিজের ঔরসজাত নয়। দোষ আসলে কার‚ লোকটার সন্দেহ সত্যি নাকি ফালতু - সেসবে যাচ্ছি না। সেসব আমি জানিওনা আর তা আমার কন্টেন্ট এর উপজীব্যও নয়। কিন্তু যেহেতু লোকটার বাবার সন্দেহ হয়েছিল এই বাচ্চা তার না তাই নিজের বউয়ের প্রতি সম্পর্ক শীতল করে দেয়। তাদের সম্পর্ক কোনোদিনই স্বাভাবিক হয়নি। সারাজীবনই সে বউএর প্রতি সন্দেহ আর অভিযোগ নিয়ে বেঁচেছে যতদিন না মৃত্যু এসে তাকে এই বিরক্তিকর জীবন থেকে রক্ষা করেছে।
অন্যদিকে স্বামীর ভালোবাসা আর সাহচর্য থেকে বঞ্চিত হয়ে বউটা মানে লোকটার মা নিজের ছেলেকেই নিজের দুর্ভাগ্যের কারণ হিসাবে চিহ্নিত করে বসে। যে‚ এই ছেলে অপয়া। এ এসেছে বলেই আমার জীবন নষ্ট হয়ে গেছে‚ ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি………
ফলে শৈশব অবস্থা থেকেই চলতে লাগল বাচ্চার প্রতি অবহেলা। একটু বড় হওয়ার পর থেকেই নিরন্তন অত্যাচার - শারীরিক আর মানসিক দুইই। লোকটার বাবার ছিলো দূরে চাকরি। সপ্তাহে একদিন হয়তো বাড়ি আসত কি তাও আসত না। আর সেই সুযোগে তার স্ত্রী নিজের ছেলেকে নিজের স্বামীর প্রতিনিধি বানিয়ে‚ স্বামীর উপর জমে থাকা রাগ মেটাত। মানসিক অত্যাচারের মধ্যে ছিলো ছেলের সামনে বাবা ( মানে ওর স্বামী ) আর সেই বংশের সবার নামে কুৎসিত সমালোচনা‚ গালাগালি‚ নিজেদের জীবন নষ্ট করে দেওয়ার দোষারোপ‚ (বড় হওয়ায় পর) হাতে হাতখরচ এর টাকাপয়সা না দেওয়া‚ খেলতে যেতে না দেওয়া‚ ছেলের চরিত্র নিয়ে সন্দেহ করে ঝগড়াঝাঁটি করা ইত্যাদি আর শারীরিক অত্যাচারের মধ্যে ছিলো মারধোর। এমন একদিনও নাকি যায়নি যেদিন লোকটা মায়ের হাতে মার খায়নি। এমনকি প্রতিবেশীর সাথে ঝগড়া হলেও ছেলেকে মায়ের হাতে মার খেতে হত মায়ের মুড ঠিক করার জন্যে। মা পরে আবার বন্ধুদের সাথে গল্পও করত যে আমার মন মেজাজ ভালো থাকেনা‚ দুমদুম করে মেরে দি।
তো এইরকমই চলছিল বহু বছর ধরে। ছেলেটা পনের বছর বয়স পর্যন্ত এইভাবে অত্যাচার সহ্য করে। তারপর ওর বাবার মৃত্যুর পর এক আত্মীয়ের সাহায্যে রামকৃষ্ণ মিশনের হোস্টেলে চলে যায়। সেখান থেকেই কারিগরিতে উচ্চশিক্ষা নিয়ে চাকরি পায় রেলে। চাকরি পেয়ে বাড়ি ফেরে‚ বিয়ে করে আর তারপরই নিজের মাকে নিজের জীবন থেকে একেবারে সরিয়ে দেয়। এমনকি অতীতের অত্যাচারের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য দুই একবার নাকি মায়ের গায়ে হাত পর্যন্ত তুলতে গেছিল‚ ওর বউ বাঁধা দেয় বলে তুলতে পারেনি।
এই ঘটনা আমার একপক্ষের মুখে শোনা। কতটা ঠিক কতটা ভুল জানিনা। তবে তার সাথে এটাও ঠিক যে আমিও অনেক ভেবে দেখেছি‚ নিপাট ভদ্রলোক ওই লোকটার এমন অদ্ভুত আচরণের অন্য কোনো যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা পাইনি। যে সবার সাথে ভালো আচরণ করে সে নিজের মায়ের প্রতি এমন আচরণ করবেই বা কেন যদি অতীতের কোনো ট্রমা বা প্রতিহিংসা না থাকে?
আমি এখানে লোকটার পক্ষে বা বিপক্ষে কোনো যুক্তি দিতে আসিনি। লোকটার মা কেন তেমন আচরণ করত তারও ব্যাখ্যা আমার কাছে নেই। মনস্তত্ত্ববিদরাই ভালো ব্যাখ্যা দিতে পারবেন এর। আমি তো শুধুমাত্র আমার জানা ঘটনাটার নিরপেক্ষ বর্ণনা দিলাম। যাতে লোকটার এমন অন্যায়ের পেছনে আসল কারণটা সম্পর্কে ধারণা পেতে পারি। ব্যাস।
** চলবে.....**
অনেক সময়তেই এটা ঘটে থাকে, সামনে থেকে দেখলে একরকম মনে হয় কিন্তু গভীরে থাকে নানা উচুনিচু সম্পর্কের জাল। গল্পের পরবর্তী অংশের অপেক্ষায় রইলাম।
হ্যাঁ আমরা সবসময় মানুষকে সামনে থেকেই দেখি কিন্তু তাদের অতীত ভুলে যাই। সেগুলোই তুলে আনব এখানে।