অবেলায় চিলেকোঠায় !! @shy-fox 10% beneficiary

in আমার বাংলা ব্লগ3 years ago

অবেলায় চিলেকোঠায়

সেই ছোটো থেকেই দাদা বাড়িতে থাকি আমি। সবাই খুব ভালোবাসে আমাকে। এইজন্য আমার সব আবদার তারা শোনে। আমার বয়স তখন নয় বছর। একদিন দাদার কাছে গিয়ে আবদার করলাম আমাদের দোতলা বাড়িটার ছাদে আমাকে ছোট্ট করে একটা ঘর বানিয়ে দিতে। দাদা হেসে বলেছিল " কেনো রে বুড়ি, হঠাৎ চিলেকোঠায় থাকতে ইচ্ছে হলো তোর?"
আমি মাথা নেড়ে বললাম "হ্যাঁ,খুব ইচ্ছে"।
এরপর মাত্র কয়েকদিন সময় লেগেছিল। দু তিনটা লোক জোগাড় করে দাদা একটু সুন্দর ছোট্ট ঘর বানিয়ে দিলেন ছাদে। তেমন কোনো আহামরি অবশ্য না কিন্তু এত সুন্দর ...দেখলেই মনটা ভরে যেত একদম।
তারপর থেকে একটু একটু করে সাজিয়েছি ঘরটা। মেঝেতে মাদুর বেছানো,দুটো বড়ো বালিশ আছে। মাথার উপর ছাদটার মাঝখানে গোল করে একটু ফাঁকা রাখতে বলেছিলাম।ঐখান দিয়েই প্রতিদিন শুয়ে শুয়ে চাঁদ দেখা হয় আমার। ঘরের দেয়াল গুলো আমি নিজের হাতে রং করেছি, রঙিন কাগজের প্রজাপতি দিয়ে দেয়ালগুলো সাজিয়েছি। নিজের আঁকা কয়েকটা ছবি দেয়ালে ঝুলিয়ে দিয়েছি। ঘরের একটা পাশে কাঠ দিয়ে বানানো লম্বা তাকটায় আমার খুচরো পয়সা দিয়ে কেনা সব বই জায়গা পেয়েছে। ওগুলো আমার ভীষণ প্রিয়।

আজ এত বড় হওয়ার পর ও....ঠিক আগের মতই...আমি আমার সুন্দর সকল, কড়া দুপুর, মিষ্টি বিকেল, শান্ত সন্ধ্যা আর তারামাখা রাত ওই চিলেকোঠায় বসে উপভোগ করি খুব। এখন দুপুর দুইটা। এই সময়টায় সাধারণত আমি আসি না চিলেকোঠায়। কিন্তু কিছু করার ছিল না। তাই আসলাম। রোদটা কমেনি এখনো। ঘরের ভেতর টা গরম হয়ে আছে খুব। আমি মাদুরটার উপর গিয়ে বসে পড়লাম। আজ হঠাৎ করেই কেনো যেনো ইচ্ছে হচ্ছে কাব্য সাজাতে। মাথার ভেতর নানা শব্দ খেলা করছে এলোমেলোভাবে। আমি কোনো কবি নই,কোনো গল্পকারও না। কবিতা লিখি নি, ইতিহাস পড়িনি, গভীরভাবে ভেবে দেখি নি জীবনকে। তবুও আজ ভীষণ ইচ্ছে হচ্ছে কবি হতে, লিখতে ইচ্ছে হচ্ছে বিরাট কোনো কাব্য যার কোনো শেষ থাকবে না। মানুষ সেই কাব্যের গভীরে হারিয়ে যাবে, কিনারা খুঁজে পাবে না। সব এলোমেলো অদ্ভুত ইচ্ছে কাজ করছে ভেতরে। ইচ্ছে হচ্ছে আজ নিজেকে নিয়ে নীলরঙা বৃষ্টিতে ভিজতে, এই করা রোদের দুপুরে নতুন সুরে গান লিখতে ইচ্ছে হচ্ছে খুব। আমার পুরনো তুলির আঁচড়ে শেষ বিকেলের ছায়ায় নীল আকাশের বুকে বেগুনি রঙা স্বপ্ন আঁকতে পারলে দারুন হতো। হাজার রঙের প্রজাপতি ধরে এনে আমার এই ছোটো চিলেকোঠায় রেখে দিতে পারতাম যদি! নোনা বালিচরে হাঁটতে হাঁটতে আকাশের সমুদ্রস্নান দেখতে কেমন লাগে তা অনুভব করতে ইচ্ছে হচ্ছে খুব কাছ থেকে। আচ্ছা,গোধূলির আলো আঁধারির মায়ায় নীল আকাশের বুকে হারাতে কেমন লাগে সেটাও তো ভাবা দরকার।

এই অবেলায়, ওই দূর আকাশে নিরব আপোষে আমার ভীষণ শীতল চোখ দুটো ভেসে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে কোনো অবসন্ন বিকেলের কাছে হাজির হয়েছি আমি। পুরনো কোনো ভায়োলিনের সুরে ভেতরটা কেপে উঠছে বারবার। আমার ভেতর সেই সুর উত্তাল ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ছে আমার অনুমতি ছাড়াই। কখনো অভিমান, কোনো নাম না জানা অনুভূতি....ঠিক কোন কারণে এই অবেলায় আমি চিলেকোঠায় কাব্য বুনছি আমি জানি না। মনে হচ্ছে আকাশের তক্ত গরম মেঘগুলো কালো হয়ে আসছে, একটু পরই অকারণ বর্ষণ ঘটাবে। সেই ঝুম বৃষ্টির আগমনের আগেই আমি অবাক রঙে সাদা কালো রঙ মাখা ফানুশ এঁকে নিজের কল্পনার আকাশ রাঙ্গিয়ে তুলছি। পুরে ছাই হওয়া আবেগের মত আজ মেঘগুলোকে ভীষণ কালো দেখাচ্ছে আমার জোছনা পোড়া চোখে।

ধীরে ধীরে বিকেল নেমে এলো দুপুর গড়িয়ে।মায়ের ডাক শুনতে পাচ্ছিলাম আমি।

  • এই যে,দুপুর যে গড়াচ্ছে,খাবে কে?খাবার সব জুড়িয়ে যাচ্ছে কিন্তু। আমি পরে তোর এইসব নিয়ে বসে থাকতে পারবো না একদম।
  • খেতে ইচ্ছে হচ্ছে না মা। খাবার তুলে রাখো। পরে খেয়ে নিবো নে আমি।
    মায়ের আর কোনো ডাক কানে তুললাম না। এখনো তো আমার বিকেল নিয়ে কাব্য বুনা বাকি।
    আমার চিলেকোঠায় যে ছোট্ট জানালা টা, সেটা দিয়ে দক্ষিণের ভেসে আসা মৃদু বাতাস শরীর জুড়িয়ে দিচ্ছিল । মনে হচ্ছিল আমার সেই দুপুরের নীল স্বপ্নীল দৃষ্টি নিঝুম কোনো অরণ্যে মিলিয়ে যাচ্ছে। আঁধারির মাঝে ঘুমহীন কিন্তু অচেতন হয়ে রাত্রিযাপন ঠিক কতটা আনন্দের সেটা অনুভব করতে ইচ্ছে হচ্ছে খুব। কিন্তু এখনও রাত নামতে অনেক দেরি, অনেক। সেই অচেতন রাত্রিযাপনের অপেক্ষায় মিশে যায় আমার জীবনের সব স্মৃতিচারণ। আমি সেই স্মৃতিতে হাসছিলাম, উড়ছিলাম স্বপ্নীল আকাশে। ভীষণ ইচ্ছে চাপলো চাঁদের দেশে হারিয়ে যাওয়ার। দিশেহারা আমার সেই রাতের প্রতীক্ষায় খুব ইচ্ছে জাগলো ওপারে ভেসে যাওয়ার। আমার সত্তা প্রহর গুনছিলো রাতের অপেক্ষায়।
    ধীরে ধীরে বিকেল সন্ধ্যায় রূপ নিল। এই সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে মনে হচ্ছিল দুচোখ আমার সাগরের অতলে ডুবে যাচ্ছে, আমার চোখ লুকিয়ে যাচ্ছে অবাক জোছনার আলোতে। আমার মনে হচ্ছিল নোনা স্বপ্নে গড়া স্মৃতিতে শত রঙে রাঙিয়ে কোনো একটা সুন্দর আলোর দেখছি আমি। সেই আলোতে খেলা করছিল আঁধার, তার মধ্যে মিশে যাচ্ছিলাম আমি নিজের অজান্তেই। আজ আমার এই ধূসর সময়ে বারবার মনে হচ্ছিল পথ হারাচ্ছি, বেওয়ারিশ কোনো ঘুড়ি হয়ে ওই অনাবিল আকাশের শূন্যতায় উড়ছি আমি। মানুষের বিষাদ চোখে আলোর উৎসব খুঁজছিলাম আমি। স্মৃতির ঝড়ো হাওয়ার তালে তাল মিলিয়ে মনে হচ্ছিল বিশাল কোনো পাহাড়ের চূড়ায়, একা দাড়িয়ে আছি। আমার সরল রেখার চিন্তার ধারায় আড়াআড়ি দাগ কাটলো আমার মায়ের ডাক।
  • ভূতে টুতে ধরলো নাকি? এখনো ঘরে আসছিস না কেনো?সন্ধ্যা হয়ে গেলো তো।
  • মা, আজকে এখানটায় থাকি একটু। রাতে এখানেই ঘুমিয়ে পড়বো। অত ভাবতে হবে না। রোকেয়া কে দিয়ে খাবার টা পাঠিয়ে দাও আর ঘরে গিয়ে বিশ্রাম করো।

মা কিছু বললো না আর। মা খুব ভালো জানে তার মেয়ে মাঝে মাঝেই এরকম কবি হয়ে তার চিলেকোঠায় কাব্য রচনা করতে বসে! আমি আবারও আমার কাব্য রচনার মন দিলাম। খুব ইচ্ছে করছিল পাহাড় চূড়া বেয়ে আকাশ ছুঁতে। স্রোতস্বিনীর মাতাল হাওয়া মনে হচ্ছিল সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের মত আমার বুকের উপর দুরন্ত বেগে ছুটে চলছে। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে....সব আলো নিভে যাক আজ রাতের আধারে, শুধু জেগে থাকুক ওই দূরের তারাগুলো। সব শব্দ রূপ নিক নিস্তব্ধতায় আর এই সমুদ্র জেগে থাকুক আমার চিলেকোঠায়। হৃদয় ভরে উঠুক অজানা আনন্দে। আজ আমার কি হয়েছে আমি জানি না। শুধু মনে হচ্ছে মহাকাল আজ অবাক দৃষ্টি নিয়ে আমার হৃদয় গভীরে হাজির হয়েছে। আমার ওই সমুদ্রের বুকে আলপনা আঁকছি নিজের সমস্ত ভালোবাসা দিয়ে এরকম মনে হচ্ছিল।

একটা মানুষের দরকার খুব এই সময়টায়। যার কাছে আমার আজকের অদ্ভুত এলোমেলো চাওয়াগুলো তুলে ধরা যাবে খুব সহজে। চাইতে ইচ্ছে হচ্ছে একটুকরো চাঁদের মাটি, হিমালয়ের চূড়া়র একটুখানি বরফ, নীল আকাশের একটুকরো সাদা মেঘ, আঁধার রাতের একটা তারা। জানতে ইচ্ছে হচ্ছে ওই দূর আকাশ যার প্রেমে আমি প্রতিদিন পড়ি, তার শেষ কোথায়....
আমার শেওলা ধরা অকেজো মনটাতে আজ হঠাৎ করেই কেউ একজন আবোলতাবোল অন্য রকম অনুরোধ নিয়ে হাজির হয়েছে। তার অনুরোধ পুরোটাই অবাস্তব, তার চাওয়াগুলো এই সময়ের সাথে মানানসই না।
আমার দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে নিঃস্ব কোনো মানুষের শেষ যাত্রায় হাসিমুখটা। আমার ফিরে পেতে ইচ্ছে হচ্ছে কালের গর্তে হারিয়ে যাওয়া আমার পুরনো গানের গলা।

মনে হচ্ছে আজ এই কাব্য রচনার আসরে আমার চিলেকোঠার দেয়ালের সব ছেড়া রং ধুয়ে যাচ্ছে। ছোট্ট জানালা দিয়ে বহু প্রতীক্ষার সেই রাতের আগমন ঘটছে ধীরে ধীরে। অবলিল হাওয়া আমার এই বদ্ধ ঘরে ঝেঁকে বসছে আস্তে আস্তে। মনে হচ্ছে আবছা রাতের আলোয় আমার এই ছোট্ট ঘরটা শূন্যের কাঁটাতারে ঝুলছে। ছাদের ফাঁকা জায়গাটা দিয়ে অনেক দূরের চাঁদ টা দেখতে পেলাম অবশেষে যার অপেক্ষায় আমি সেই দুপুর থেকে।
আমার এই স্বপ্নঘরে আজ সময় থমকে গেছে। ভাঙ্গা স্মৃতি, ছেড়া স্বপ্ন আর আকাশ সব মিলে যেনো আজ আমার চোখের সামনে খেলায় মেতেছে। ধীরে ধীরে অন্ধকার হয়ে আসা এই ঘরে আমি গভীর অরণ্যের ঘ্রাণ পাচ্ছিলাম। সেটাতে বিঘ্ন ঘটিয়ে দরজায় টোকা দিল রোকেয়া। তার হাতে প্লেট দিয়ে ঢাকা আমার রাতের খাবারটা।

  • রেখে যা ওখানটায়। আর আসিস না।
  • আচ্ছা,আপা।

ও চলে যেতেই আবারও কোথায় যেন ডুব দিলো আমার কাব রচনার তাড়না। দেখতে পেলাম আমার ঘরের দেয়ালটা রেখায় ভর্তি, সেইসব রেখার ফাঁকে ফাঁকে উকি দিচ্ছে জোছনা। কি সুন্দর! মনে হচ্ছিল আজ আমি নিজেই নির্জনতার মধ্যে ঝুলে আছে। আমি ঘর থেকে বেরিয়ে ছাদে দাড়ালাম। মনে হলো এই একা রাতটায় কেউ করুন সুরে একতারা বাজাচ্ছে আমার চিলেকোঠার পাশে বসে! একটুও অবাক হলাম না। সুরটা ভীষণ চেনা চেনা লাগছিলো। এই রাতের বেলায় আমার কাব্যের আকাশে আমি রঙিন ঘুড়ি উড়ে যেতে দেখছিলাম, দেখছিলাম তারাদের মিটমিট হাসি। ওই তারাগুলোকে বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল মন খারাপের রাতে যেনো তারা আমার চোখে ঘুম হয়ে নেমে আসে।

সুরে বেসুরে কাব্য রচনায় ডুবে গিয়ে ভুলেই গিয়েছিলাম রাত অনেক হয়েছে। রাতের খাবারটা খেয়ে নিলাম। শুয়ে শুয়ে ভাবলাম....আজকের এই অবেলায় চিলেকোঠায় না আসলে এত সুন্দর একটা কাব্য চোখের সামনে সাজাতে পারতাম না। বিরাট বড় একটা আফসোস রয়ে যেত তখন। এরপর মধ্যরাতের অপেক্ষায় আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আজ না হয় সারাটা রাত আমি কাব্য রচনা করেই কাটিয়ে দিলাম.....

girl-3421489_960_720.webp

Image score

Sort:  
 3 years ago 

গল্প আমার কাছে ভালো লাগে, কিন্তু আপনি এতো সুন্দর গল্প আপনি লিখলেন কিভাবে? যারা কাব্য রচনা করে, তাদের সময়ের প্রতি কোন দৃষ্টিপাত থাকে না, কি রাত্রি কি দিন!

 3 years ago 

আপনি অনেক সুন্দর একটি মন্তব্য করেছেন আপু। তবে আমি এই গল্পটি লিখতে হারিয়ে গিয়েছিলাম সেই গল্পের বাস্তবতায়। অনেক সময় নিয়ে আমি এই গল্পটি লিখেছি। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ আপু আমার গল্পটি পড়ার জন্য।

Coin Marketplace

STEEM 0.20
TRX 0.19
JST 0.034
BTC 91222.02
ETH 3113.00
USDT 1.00
SBD 2.90