উপন্যাস রিভিউ -পুতুল নাচের ইতিকথা(10% beneficiaries for @shy-fox)
কেমন আছেন সবাই? আশা করি ভাল আছেন।আমিও আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। আমার বাংলা ব্লগ পরিবারের সকল সদস্যদের সুস্বাস্থ্য কামনা করে আজ আমি শুরু করছি আমার একটি বুক রিভিউ।
আমার প্রিয় যতগুলো লেখক ছিল তার মধ্যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ছিল অন্যতম। আজ সেই প্রিয় লেখক এর মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৫৬ সালের আজকের এই দিনে অর্থাৎ তেসরা ডিসেম্বর ইন্তেকাল করেন। আমার প্রিয় লেখক এর স্মরণে আজ আমি তার লেখা একটি উপন্যাসের রিভিউ দিব আপনাদের সাথে। সাহিত্যের অসাধারণ সৃষ্টি হচ্ছে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বাংলা সাহিত্যের অবদান স্বরূপ যে উপন্যাস গুলো লিখে গেছেন তার মধ্য অন্যতম ছিল পুতুল নাচের ইতিকথা, দিবারাত্রির কাব্য, পদ্মা নদীর মাঝি অন্যতম। এই তিনটি উপন্যাস আপনাদের সামনে আমি ধারাবাহিক ভাবে উপস্থাপন করব। তারই প্রেক্ষিতে আজ আমি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুতুল নাচের ইতিকথা উপন্যাসটির আপনাদের সাথে তুলে ধরছি।
গুরুত্বপূর্ণ তথ্য
উপন্যাস রিভিউ | পুতুল নাচের ইতিকথা |
---|---|
লেখক | মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় |
প্রথম প্রকাশ | ১৯৩৬ সালে |
উপন্যাসের ধরন | বিশ্লেষণ ধর্মী উপন্যাস |
ভাষা | বাংলা |
ISBN | ৯৭৮-৯৮৪-৯০০৭৮-৩৬-৬ |
প্রকাশনা | সুচয়নী পাবলিশার্স |
প্রচ্ছদ | মোঃ জহিরুল হাসান |
উপন্যাসের মূল কাহিনী
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস গুলো সাধারণত মধ্যবিত্তদের জীবন গাঁথা এবং তিনি সাধারণত মানুষের জীবন বিশ্লেষণ ধর্মী উপন্যাস লিখতে পছন্দ করেন। সেই রকম একটি উপন্যাস হচ্ছে পুতুল নাচের ইতিকথা। এটি একটি জীবন বিশ্লেষণ ধর্মী উপন্যাস। এই উপন্যাসের মাধ্যমে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন যে গ্রামের মধ্যবিত্ত মানুষদের জীবন ,তাদের স্বপ্ন, তাদের নিত্যদিনের জীবন গাথা কাব্য। এই উপন্যাসটি কবি এমন ভাবে লিখেছেন যেখানে প্রথম ভাগের সাথে শেষভাগের কোন মিল নেই। আবার শেষ ভাগের সাথে মধ্যভাগে কোন মিল নেই। অর্থাৎ প্রতিটি বিভাগেই মধ্যবিত্তদের জীবন ফুটে উঠেছে। এই উপন্যাসটির মূল চরিত্রে আমরা যাকে দেখতে পাই তার নাম হচ্ছে ডাক্তার শশী। যিনি কিনা একজন গ্রামের ছেলে। শশী গ্রামের এক সুদ ব্যবসায়ীর ছেলে। তার বাবার স্বপ্ন ছিল শশীকে ডাক্তার বানাবে তাই তাকে শহরে ডাক্তারি পড়ার জন্য পাঠিয়ে দেয় । ডাক্তারি পড়ানোর সময় সে ছিল একদম গ্রাম্য অর্থাৎ গ্রাম্য পরিবেশ ঘরোয়ার একটি ছেলে। কিন্তু সে যখন কলকাতায় যায় তার জীবন এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন চলে আসে। সে সবকিছু নতুন করে শুরু করে শিক্ষার আলোয়। শহরের সভ্যতার আলোয়, শিক্ষারআলোয়, নতুন শিক্ষা, নতুন উচ্ছ্বাস সবকিছু নতুনভাবে উপলব্ধি করতে পারে। যে সব কিছু যুক্তি ধর্ম ও বিজ্ঞান মনষ্ক থেকে দেখতে পারে। গ্রামের সেই কুসংস্কার কে ভেঙে ফেলার এক ব্রত তৈরি হয়ে যায় তার কল্পনায়। তার এই নতুন ভাবধারা নতুন প্রজন্মের পেছনে ভূমিকা তারই বন্ধু কুমুদ।
তবে এই উপন্যাসটি শুরু হয়েছিল এক মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। শশী যখন ডাক্তারি পড়া শেষ করে গ্রামে ফিরে আসে তখন সে গ্রামেরই হারু ঘোষ যে তার মেয়ের জন্য পাত্র দেখতে গিয়েছিল এবং পথিমধ্যেই এক ব্জ্রপাতে তার মৃত্যু হয়। এই উপন্যাসটি তার লাশের মাধ্যমেই শুরু হয়েছিল। শশী যখন হারু ঘোষের লাশ গ্রামে নিয়ে আসে পথিমধ্যেই বিভিন্ন ধরনের ঘটনা ঘটতে থাকে। অন্যদিকে শহরে শিক্ষায় আলোকিত হয়ে যখন গ্রামে ফিরে আসে তখন সে হাসপাস শুরু করে দেয়। এই গ্রাম্য পরিবেশে সে কীভাবে থাকবে ?কীভাবে সবার সাথে মানানসই হবে? তার জন্য গ্রামের পরিবেশে থাকা খুব কষ্টকর হয়ে যায়। আবার গ্রামের মানুষের সহজ-সরল সবুজ প্রকৃতি এবং মানুষের সমস্যাগুলো যেগুলো সে সমাধান করার ব্রত গ্রহণ করেছিলেন। এক পর্যায়ে সে সবকিছু ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করে এবং গ্রামের সাথে গ্রামের পরিবেশের সাথে মিশে একাকার হয়ে যায়।
এছাড়াও এই উপন্যাসে আরও দুটি চরিত্র আছে। কুমুদ ও মতি। কুমুদ যাকে কিনা এক সময় শশী খুব হিংসা করত। শশীর মতে কুমুদ ছিল বহু জ্ঞানের অধিকারী, বহু গুণের অধিকারী। এক পর্যায়ে শশী মেয়েদের মতো কুমুদের প্রেমে পড়ে যায় এবং কুমুদকে বিভিন্ন মুহূর্তে যখন সে টাকা ধার দিতে পারতো না তার নিজের কাছে খারাপ লাগতো। খুব অসহয় বোধ করত কেন কুমূদের জন্য কিছু করতে পারলাম না? অন্যদিকে কুমুদ অনেকটাই গতিহারা, গতিহীন নদীর মত অর্থাৎ যারা নিজস্ব কোন গতি নেই যার নিজস্ব কোন ধারা ছিল না যে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধারা তে প্রবাহিত হতো। কিন্তু একটা পর্যায়ে দেখা যায় কুমুদ একটি যাত্রা দলে যোগ দেয়। এবং আমরা দেখতে পাই সেই যাত্রা দলটি এক পর্যায়ে শশীর গন্ডারিয়া গ্রামে আসে। কুমুদ যখন সেখানে অভিনয় করার জন্য যায় তখন একটি মেয়ে মতি সে কিনা হারু ঘোষের মেয়ে তার পাত্র দেখার জন্য গিয়ে হারু ঘোষ বজ্রাঘাতে মারা যায়। একপর্যায়ে শশীর সাথে মতির পরিবারের খুব ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। কেননা মতি যখন ম্যালেরিয়া তে আক্রান্ত হয় তখন শশী চিকিৎসা করেছিল। তখন মতিদের বাসায় শশী অবাধ যাতায়াত করতো। যার ফলশ্রুতিতে শশী এবং মতির মধ্যে একটি ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সেই মতি কুমুদ কে প্রথম দেখায় এবং প্রথম কথায় মতি কুমুদের প্রেমে পড়ে যায়। মতি কুমূদকে তার স্বপ্নের রাজকুমার ভাবা শুরু করে। যাত্রাপালার সেই রাজকুমার যে কিনা মতিকে নিতে এসেছে এবং কুমুদ মতিকে দেখে মতির সেই লাজুক, ভীরুতা এগুলোর প্রতি প্রেমে পড়ে যায়। চিরদিন গতিহারা গতিহীন কুমুদ যেন এক নিমিষেই তার স্থান খুঁজে পায়। কুমুদ মতিকে বিয়ে করে নিয়ে চলে যায় এবং শুরু হয়ে যায় জীবন নিয়ে দুটি মানুষের ছেলেখেলা আর এক গল্প।
উপন্যাসের আরেক চরিত্র কুসুম যে কিনা গ্রামের মেয়ে, গ্রামের পরিবেশে তার বেড়ে ওঠা। তার মধ্যে কোন ধরনের গ্রাম্যতা ভাব নেই সংস্কারের প্রতি তার কোন পিছুটান নেই। তবে আত্মসম্মানবোধের ছিল সে ভরপুর। কুসুমের আর একটি পরিচয় যে ছিল গল্পের উপেক্ষিত চরিত্র পরানের স্ত্রী। পরনের মাঝে সব সময় হীনমন্যতায় ভাব ছিল। স্ত্রী কুসুমের স্বভাব-চরিত্র সাথে পরান ছিল একেবারে বেমানান। পরান ছিল এই উপন্যাসের নিষ্ক্রিয় চরিত্র যে কিনা পরিবারের কর্তা হয়েও পরিবারের সিদ্ধান্তে যার কোন অবদান বা প্রভাব থাকত না।
উপন্যাসে আরেকটি পটভূমিতে দেখা যায় তুচ্ছ কথার জন্য গাওদিয়া সাধক যাদব এর মৃত্যুতে শশীর জীবনের নতুন এক মোড় নেয়। যাদবের মৃত্যু-পরবর্তী ইচ্ছা অনুযায়ী যাদবের নামে একটি হাসপাতাল তৈরি করে এবং সে হাসপাতালের সকল দায়িত্ব নিজেই পালন করে। কিন্তু কোন এক অচেনা মায়া শশীকে বারবার টানে। যে সুতোর টান শশী কখনো ফেরাতে পারে না। শশী অনিশ্চিত যাত্রা কথা ভাবে। অন্যদিকে দেখা যায় শশীর বাবা যে কিনা সকল দিক থেকে নিজের কর্তৃত্ব বজায় রাখলেও নিজের ছেলে ক্ষেত্রে সে কর্তৃত্ব বজায় রাখতে পারে না কারণ এখানেও সেই সুতার টান । সেই অদৃশ্য সুতোর টানে শেষ পর্যন্ত কি গন্ডারিয়া গ্রাম ছেড়ে যাবে শশী? পরিবার ছেড়ে সেই কল্পনা নির্বাসনে যেতে পারবে নাকি সেই অদৃশ্য মায়ার টানে সে নিজেকে বা নিজেই পুতুল হয়েছিল? জানতে হলে আপনাদের অবশ্যই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অমর কীর্তি পুতুল নাচের ইতিকথা পড়তে হবে।
শিক্ষা
এই উপন্যাস থেকে যে শিক্ষা অর্জন করতে পারি তার মধ্যে হচ্ছে-
- গ্রামের কুসংস্কারচ্ছন্ন কে মুক্তি দেওয়া। এবং গ্রামের সহজ সরল মানুষের জীবন প্রকৃতি মধ্যবিত্তদের অভাব বোধ সম্পর্কে সম্যকভাবে ধারণা পায়।
- মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এই উপন্যাসের মধ্য দিয়ে গ্রামের মানুষের জীবন সম্পর্কে ধারণা জীবনের অর্থ খোঁজার চেষ্টা করেছেন তিনি গ্রামের মানুষের মনকে বিশ্লেষণ করে মনস্তাত্ত্বিক বিষয়গুলোকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।
- আমরা এই গল্পের মাধ্যমে শিখতে পারি একজন গ্রামের ছেলে শহরে গিয়ে গ্রামের মমতাকে ভুলতে পারেনা। গ্রামের মানুষকে ভালোবেসে গ্রামের মানুষের জন্য কিছু করতে পারায় তার জীবনের সার্থকতা খুঁজে পায়।
- আশা নিরাশা হতাশা নিঃসঙ্গতার মাঝে কিভাবে একজন মানুষ তার জীবনে অতিবাহিত করে সে সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় ।
ব্যক্তিগত মতামত
ব্যক্তিগত রেটিং ৪.৬/৫
উপন্যাসের পিডিএফ লিংক 👉এখানে
উপন্যাস রিভিউ | পুতুল নাচের ইতিকথা |
---|---|
রিভিউ করেছেন | @abidatasnimora |
Photo | Samsung galaxy S6 |
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখাগুলি সত্যিই অনেক সুন্দর।পুতুল নাচ এখন প্রায় বিলুপ্ত ,তবে আগে এটি মানুষের জনজীবনে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল।অনেক কিছু শিক্ষনীয় বিষয়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের আনন্দ ও বিনোদনের বিষয় ছিল।সুন্দর রিভিউ করেছেন।ধন্যবাদ আপু।