একসময়ের ঐতিহ্যবাহী কাসিদা যেন ঠাঁই নিয়েছে ইতিহাসের পাতায়।
প্রাচীন ঢাকা এখন মেগাসিটি হলেও হারিয়েছে অনেক কিছুই ।আর সে তালিকা দিন দিন দীর্ঘই হয়ে চলছে ।এর একটা উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায় পবিত্র রমজান মাসে শহরের ঐতিহ্যবাহী ‘কাসিদা’ সঙ্গীতের কথা।
এক সময় ঢাকায় এই রমজান মাসে সেহরির সময় মহল্লায় মহল্লায় কাসিদা গাওয়ার দৃশ্য খুবই স্বাভাবিক একটা বিষয় ছিল। সৃষ্টিকর্তার প্রতি নিবেদিত আধ্যাত্মবাদী সঙ্গীতের সুরে শেষ রাতে ঘুম ভাঙত রোজাদারদের।কাসিদা’, মূলত ফার্সি শব্দ হলেও এর উৎপত্তি হয়েছে আরবি ভাষা থেকে আর এর অর্থ হল পরিপূর্ণ, আকাঙ্ক্ষা অথবা প্রত্যাশা।
আর এক কথায় বলতে গেলে, কবিতার ছন্দে, সুর করে প্রিয়জনের প্রশংসা করাকেই বলে কাসিদা। ইসলাম ধর্ম প্রচার লাভের অনেক আগেই এর শুরু হয়েছে এবং আরবি সাহিত্যের বিপুল একটি অংশ জুড়ে আছে এর বিশাল ভাণ্ডার। আরবি ভাষার পরে ধীরে ধীরে ফারসি, তুর্কি ও উর্দু ভাষায় কাসিদা বিস্তৃত হয়ে ছড়িয়ে পরে জনপদ থেকে জনপদে।
ইতিহাস থেকে জানা যায় যে , মুঘল সাম্রাজ্যের দিনগুলোতে মেহফিলের আয়োজন করে কাসিদা পরিবেশন করা হতো।আর তখন এর মূল বিষয় ছিলো সম্রাটদের প্রশংসা এবং গুণকীর্তন করা। আর মুঘলদের মাধ্যমেই পরবর্তীতে বাংলা অঞ্চলে কাসিদা গাওয়ার প্রচলন হয়।
এ সময় ঢাকার নায়েবে নাজিমদের পৃষ্ঠপোষকতায় জাঁকজমকের সঙ্গে পরিবেশিত হতো কাসিদা। কিন্তু সেটা ছিল সাধারণ জনগণের ত্রিসীমানার বাইরে। কারণ কাসিদা তখন আবদ্ধ ছিল অভিজাত শ্রেণীর মাঝেই ।
মুঘল শাসনের সমাপ্তির পর এই ঐতিহ্যবাহী এ সংগীত দীর্ঘদিন ধরে টিকে ছিল পুরোনো ঢাকাকে কেন্দ্র করেই। যদিও পরবর্তী সময়ে ধীরে ধীরে সেটা ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরের পাড়া-মহল্লায় ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছিল।
১৮৪০ সালে ইংরেজ ইঞ্জিনিয়ার কর্নেল ডেভিডসন ঢাকায় এসেছিলেন,তার ডায়েরিতে এ শহরের বর্ণনায় লিখেচেছেন যে , দিনে রাতে ঢাকায় বেহালার শব্দ শোনা যায় ।আর তাই ঢাকাবাসীকে তিনি উল্লেখ করেছেন ‘‘মিউজিক্যাল পিপল’’ হিসেবে।
এশিয়াটিক সোসাইটি প্রকাশিত ‘‘ঢাকা কোষ’’ গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে উল্লেখ রয়েছে,
নবাবি আমলে ঢাকা শহরের প্রায় প্রতিটি মহল্লার সর্দাররা কাসিদা দলের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। নবাব আহসান উল্লাহর সময় কাসিদা গাওয়ার ব্যাপক প্রসার ঘটে এবং তিনি নিজেও কাসিদা রচনা করতেন।
মোঘলদের সময় ফার্সিতে কাসিদার প্রচলন থাকলেও ইংরেজ এবং পাকিস্তান আমলে পুরান ঢাকায় কাসিদা লেখা হতো উর্দুতে।
বাংলাতেও যে লেখা হয় নাই এমন না ,লেখা হয়েছিল কিছু কাসিদা । এই কাসিদা যারা লিখতেন তাদেরকে কাওয়াল নামে ডাকা হতো । পাকিস্তান আমলে পুরান ঢাকার কাসিদা রচয়িতাদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ছিলেন মোহাম্মদপুর বিহারি ক্যাম্পের তালিব আহমেদ, নওয়াব মুস্তাকিম কাওয়াল, পুরান ঢাকার বকশী বাজারের বাসিন্দা এজাজ আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দুর অধ্যাপক সাইদানি প্রভৃতি ব্যাক্তিরা।
তবে রমজানে সেহরির সময় আহ্বানের জন্য ব্যবহার করা হলেও কাসিদার ব্যবহার কিন্তু শুধু এতেই সীমাবদ্ধ নয়।সেহরি ছাড়াও মিলাদ, মাহফিল এবং ঈদের মতো প্রায় সব ধরনের ধর্মীয় উৎসবেই কাসিদা গাওয়া হতো।
আর রমজানকে ঘিরে পুরান ঢাকায় গড়ে উঠেছিল অসংখ্য গানের দল।
তবে সময়ের সাথে সাথে কাসিদা আজ প্রায় বিলুপ্ত। এখন আর পাড়া-মহল্লার অলিগলিতে আজ আর ভেসে আসে না সুরেলা সেহরি খাওয়ার সেই আহ্বান। বলতে গেলে কাসিদা যেন ঠাঁই নিয়েছে ইতিহাসের পাতায়।
পুরনো আমলের কিছু কিছু জিনিস আমাদের সমাজের বর্তমানে বঞ্চিত হয়ে গেছে। বর্তমান সময়ের সবকিছু আধুনিক হওয়াতে এসব যেন ঐতিহাসিকের মতো স্মৃতির বাসায় জুড়ে গেছে। একটি শিক্ষনীয় পোস্ট শেয়ার করার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ ।
পুরোনো সময়ের অনেক কিছুই হারিয়ে গেছে বা যাচ্ছে।ভাব্লে খারাপ লাগে যে, একসময় আমাদের সময় এর কালচারও হারিয়ে যাবে আর এর জায়গা এসে দখল করবে নতুন কোন সংস্কৃতি। আসলে সব কিছুই পরিবর্তনশীল।
সময়ের সাথে সাথে সব কিছুই পুরোনো হয়ে যায়।
মানুষ থেকে শুরু করে সবকিছুই
আপনার মন্তব্য পরে খুব ভালো লাগলো। এত সুন্দর করে একটা মন্তব্য করার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। ভালো এবং সুস্থ থাকবেন সবসময় শুভকামনা রইল আপনার জন্য।
একদম নতুন নতুন কিছু লেখা সম্পর্কে জানতে পারলাম আমি তবে আমার কাছে বেশ ভালো লেগেছে।
আশা করব এরকম সুন্দর সুন্দর পোস্ট শেয়ার করবেন ধন্যবাদ।
রমজান মাসে ঐতিহ্যবাহী এই সংগীত গ্রামে ও ঢাকায় ভয় জায়গায় আগে দেখেছি। তবে আমি ঢাকায় যে জায়গায় থাকি সেখানে এখনো এই সংগীতের প্রচলন রয়েছে। তবে বর্তমানে আমাদের গ্রামেই সংগীতের কোন প্রচলন নেই। আপনাকে ধন্যবাদ জানাই এত সুন্দর একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করার জন্য।