"কিছু ঘটনা আমাদের জীবনের বাস্তবতার সম্মুখীন করে"
|
---|
Hello,
Everyone,
ঘড়িতে এখন রাত ১২.১৩ বাজে। সবেমাত্র পোস্ট লিখতে বসলাম। অন্যান্য কাজের ব্যস্ততায় আজ একটুও পোস্ট লেখার সময় হয়নি। কমিউনিটির কাজের পাশাপাশি, আজ পারিবারিক বেশ কিছু কাজে সময় দিতে হয়েছে। ফলত সারাদিন বেশি ব্যস্ততার মধ্যেই কেটেছে।
আপনারা যারা আমার পোস্ট পড়েন, আশা করছি তারা সকলেই একথা জানেন যে, শনিবার শুভ অফিস থেকে একটু আগেই ফেরে। আজও সন্ধ্যা দিতে যাওয়ার কিছুক্ষণ আগে শুভ অফিস থেকে ফিরলো, ওকে শরবত দিয়ে আমি সন্ধ্যা পূজো দিয়ে গেলাম।
উপরের ঘরে প্রদীপ দেখাতে গিয়ে দেখি, ফ্যান চালিয়ে শুভ খাটের উপর চুপচাপ বসে আছে। দেখে মনে হল বোধহয় কিছু ঠিক নেই। ভেবেছিলাম অফিসেই কোনো না কোনো সমস্যা হয়েছে। আমি কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই আমাকে ডেকে বলল, -"বকুদের বাড়ির সামনে অনেক লোক দাঁড়ানো দেখলাম জানো, বোধহয় কারোর কিছু হয়েছে। ওর জ্যেঠিমা অসুস্থ শুনেছিলাম।"
|
---|
প্রসঙ্গত বলে রাখি বকু শুভর ছোটবেলার বন্ধু। একেবারে প্রাইমারি স্কুল থেকে ওরা একসাথে পড়াশোনা করেছে। কর্মসূত্রে যদিও এখন দুজনের সাথে তেমন যোগাযোগ নেই, তবে বিয়ের পরেও আমি ওদের বেশ ভালো বন্ডিং দেখেছি।
কি হয়েছে জানতে চাইলে ও বলল, - বুঝতে পারলাম না, তবে ওর জ্যাঠা, ছোট পিসি, মামা সবাইকে দেখলাম রাস্তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। বকুর মামার মেয়ে অর্থাৎ মামদির সাথে শুভর বন্ধুদের খুব ভালো একটা সম্পর্ক ছিলো।
তবে বিয়ের পর এখন আর তেমন ভাবে দেখা সাক্ষাৎ হয় না। তবে শুভ বন্ধুদের প্রত্যেকের জন্মদিনে মামদি শুভেচ্ছা জানাতে কোনো বছর ভুল করে না। সেই সূত্র বলতে পারেন, সোশ্যাল মিডিয়ায় সকলের সাথে যোগাযোগ আছে এখনও পর্যন্ত।
আমি ওকে বললাম একবার মামদির কাছে জিজ্ঞেস করে দেখো বাড়ির কেউ অসুস্থ হয়েছে কিনা। মামদি নিশ্চয়ই জানবে। আমার কথা শুনেই ও ফোন নিয়ে মামদিকে ফোন করললো। তবে নম্বর তখন ব্যস্ত বলছিলো।
ইতিমধ্যে আমিও নিচে গিয়ে ঠাকুর শয়ন দিয়ে, এক কাপ চা করে ওর জন্য নিয়ে উপরে গেলাম। গিয়ে দেখলাম একদম চুপচাপ বসে আছে। জানতে পারলাম বকুর বাবা মারা গেছেন আজ সকালে। তার বডি নিয়ে আসা হচ্ছে বলেই রাস্তার সামনে মানুষের ভিড়।
|
---|
বকুর মায়ের চাকরির জন্য রাজারহাটে ফ্ল্যাট কিনেছে। তবে সেখানে বকু, বকুর স্ত্রী ও বকুর মা থাকেন। বকুর বাবা আমাদের বাড়ির পাশেই থাকেন। কারণ ওনার এক কথা, শহর পছন্দ নয়।
ওনার যা কিছু সব এই গ্রামের বাড়িতে। একই বাড়িতে ওর জ্যাঠা,কাকু সবাই থাকে। আগে বকুর মাও এই বাড়ি থেকেই অফিসে যাতায়াত করতেন। কিন্তু বয়সের কারণে প্রতিদিন যাতায়াতে ওনার কষ্ট হয় বলে, অফিসের কাছাকাছি একটা ফ্লাট নিয়েছেন। তবে ছুটি পেলে সকলেই গ্রামের বাড়িতে চলে আসেন।
মানুষ হিসেবে বকুর বাবা অতুলনীয় ছিলেন, তবে বড্ড বেশি উদাসীন। আমার শাশুড়ি মা ও শুভর কাছে শুনেছি সাংসারিক কোনো বিষয় হোক বা সন্তানের পিছনে সময় দেওয়া হোক, কোনো ব্যাপারেই ওনার তেমন দায়িত্ববোধ ছিলো না। বাড়ির সকলে সবটা সামলে নিতো বলে উনি ওনার মতন থাকতেন।
উনি সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকতেন বই পড়তে, কবিতা লিখতে। পেশায় যদিও উকিল ছিলেন, তবে ওকালতি ততটা মন দিয়ে করতেন না, যতটা মন দিয়ে তিনি নিজেকে সামাজিক বিভিন্ন কাজে যুক্ত রেখেছিলেন।
মানুষটা উদাসীন হলেও প্রতিটি মানুষের কাছে তার সুনাম ছাড়া কখনো বদনাম শোনা যায় নি। ওনাকে আমি একদিনই দেখেছিলাম সেটাও বকুর বিয়ের দিন।
যখন আমরা গিয়েছিলাম, আমাদেরকে দেখে গেটেই দাঁড় করালেন এবং শুভকে জিজ্ঞেস করলেন- "তোমার পাশের এই বৌটিকে ঠিক চিনতে পারলাম না তো?"
শুভ উত্তর দিয়েছিলো, - "আমার ওয়াইফ"
তিনি উল্টে তখন শুভকে বকা দিয়ে বললেন, -"ওয়াইফ আবার কি? বউ বলতে কিসের কষ্ট?"
সেই বিষয়টি নিয়ে আমরা তো খুব হাসাহাসি করেছিলাম। ওইদিনই উনার সাথে আমার প্রথম এবং শেষ দেখা। তবে কথাগুলো আজও কানে ভাসছে।
বাংলা ভাষার প্রতি তার অনেক বেশি শ্রদ্ধা ছিল, এই কারণেই ওয়াইফ শব্দটা শুনে তার এমন প্রতিক্রিয়া ছিল। ওনার ছেলের বিয়েতে গিয়েছি বলে, সবার সাথে শুধুমাত্র সৌজন্যতা বজায় রেখে কথা বলবেন, এমনটা নয়। সব সময় মানুষের সাথে যেমন কথা বলতেন, সেদিনও তেমনই বলেছেন। এটাই বোধহয় ওনাকে অন্যান্য মানুষের থেকে আলাদা করে।
|
---|
গত এক মাসে আমার শ্বশুর বাড়ির আশেপাশে চারজনের মৃত্যু সংবাদ পেয়েছি। একজনের গল্প আমার পূর্বের একটি পোস্টে আপনি আমি শেয়ার করেছি। আর আজ বকুর বাবার মৃত্যু সংবাদ পেলাম।
তবে শুভকে দেখে আজ আশ্চর্য হলাম। এমন ভাবে ভেতর থেকে ওকে কখনো নড়তে দেখিনি। তবে যা বুঝলাম ও আমাদের ভবিষ্যৎ পরিস্থিতির কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছে আজ। কারণ সত্যি এটাই, এরকম একটা দিন আমাদের জীবনেও আসবে, যেদিন আমার শ্বশুরমশাই এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যাবেন। হয়তো সেই দিনের ঘটনা ভেবে শুভকে আজ বেশ বিচলিত লাগলো।
ও কিছুতেই যেতে চাইছিল না, তবে অনেক বুঝিয়ে ওকে বকুদের বাড়িতে পাঠালাম। কারন ছোটবেলা থেকে অনেক সময় কাটিয়েছে বকুদের বাড়িতে। তাই কাকুর সাথে ওর খুব ভালো সম্পর্ক ছিলো।
আজ হয়তো বন্ধুদের সাথে তেমন ভাবে যোগাযোগ নেই, কিন্তু জীবনের বেশিরভাগটা সময় এই মানুষগুলোর আশেপাশেই কাটিয়েছে, তাই পরপারে যাত্রা কালীন সময়ে তাদের পাশে থাকাটা জরুরী। দু একবার বলার পর আর আপত্তি করেনি। দেখলাম যেতে রাজি হয়েছে। তাড়াতাড়ি করে ওকে একটি ম্যাগী বানিয়ে দিলাম। সেটা খেয়ে ও চলে গেলো।
শশুর মশাইও খবরটি পাওয়ার পর কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গিয়েছিলেন। মৃত্যু জীবনের সবচেয়ে বড় সত্যি, একথা আমরা সবাই বলি ঠিকই, তবে মেনে নেওয়াটা আসলেই খুব কঠিন। অন্যের পরিস্থিতিতে নিজেদেরকে দাঁড় করালেই বোধহয় বোঝা সম্ভব এই সময় গুলো কত কঠিন হয়। বেশ কিছুক্ষণ পরে বডি নিয়ে সবাই শ্মশানের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলে শুভ বাড়ি ফিরে আসে।
গতকালকে ও কতো পরিকল্পনা করেছিল আজকের দিনটি নিয়ে। সন্ধ্যা বেলায় বন্ধুদের সাথে বেরোবে, ফেরার সময় শ্বশুরমশায়ের ইনসুলিন কিনে নিয়ে আসবে। তবে দেখুন আজ পরিস্থিতি এনে কোথায় যেন দাঁড় করালো।
|
---|
আসলে পরিকল্পনাগুলো আমাদের হাতে থাকলেও, পরিস্থিতি বদলানোর ক্ষমতা আমাদের হাতে থাকে না। তবে হ্যাঁ একজন ভালো মানুষ পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে গেলেন। পরপারে ঈশ্বর তাকে ভালো রাখবেন এ কথা আমি বিশ্বাস করি। কারণ কর্ম অনুযায়ী ঈশ্বর সবাইকে তার ফল দিয়ে থাকেন।
বকুর মা খুব সংসারী মহিলা, ঠিক ততখানি উদাসীন ছিলেন বকুর বাবা। কিন্তু মানুষের মনে তার স্থান ছিল অনেকটা উঁচুতে। মানুষ হিসেবে জন্মে এইটুকুই তো ওনার সব থেকে বড় পাওনা, যেখানে মানুষের মনে জায়গা করে নিতে পেরেছেন।
গতকাল রাতে বুকে ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিলো। স্ট্রোক করেছিলো, আবার সকালেও একবার স্ট্রোক করার পরে তিনি মারা গেছেন। কোনো কষ্ট পাননি, কাউকে কষ্ট দেননি, কি সুন্দর ভাবে ইহকাল ত্যাগ করে পরলোকে গমন করেছেন। ভাল কর্ম না হলে এত সুখের মৃত্যু সম্ভব হতো কি?
ভরপুর পরিবার স্ত্রী, পুত্র, বৌমা, ছোট্টো নাতনি সবাইকে রেখে আজ তিনি চিরঘুমের দেশে চলে গেলেন। আর যা রেখে গেলেন তাহলো নিজের কর্ম। আর এই কর্মের মাধ্যমেই মানুষের মনে আজীবন তিনি বেঁচে থাকবেন।
শুভর মত মানুষকে আজ শেষ অচেনা লাগছিল আমার। মনে হচ্ছিল যে বাস্তবতা থেকে এতোদিন দূরে থাকার চেষ্টা করছিল, আজ তার মুখোমুখি হয়েছে ও। এই পরিস্থিতি গুলোর সম্মুখীন না হলে, ওর জন্য সামনের পরিস্থিতি আরো কঠিন হবে।
তাই একপ্রকার জোর করেই আজ ওকে পাঠিয়েছিলাম। বকুর পাশে দাঁড়াতে বলেছিলাম। কারণ যে মুহূর্তে ওর মাথার উপরে ছাদটা সরে গেলো, তখন বন্ধু হিসেবে পাশে দাঁড়ানোটা শুভর কর্তব্য ছিলো।
|
---|
এরকম একটি খবরে মনটা বেশ খারাপ ছিলো ঠিকই, তৎসত্ত্বেও কমিউনিটির বেশ কিছু দায়িত্ব পালন করার পর, রুটি তৈরি করে সবাইকে ডিনার করিয়ে, নিজে খেয়ে, তারপর এসে পোস্ট লিখতে বসলাম।
আজ যে মানুষটিকে নিয়ে এতগুলো কথা আপনাদের সাথে শেয়ার করলাম, সারা জীবনে একদিনই তার সাথে দেখা হয়েছে। তবে তার গল্প শুনেই তার প্রতি শ্রদ্ধা জাগ্রত হয় আমার মনে। মানুষ হিসেবে এইটুকু প্রাপ্তি যেন ঈশ্বর আমার ভাগ্যেও লেখেন, শেষ করার আগেই শুধু এইটুকুই প্রার্থনা রইলো ঈশ্বরের কাছে। পরপারে ভালো থাকুক আমাদের সকল আপনজনেরা।