"কিছু কিছু মৃত্যু সত্যিই সুখের হয়"
|
---|
Hello,
Everyone,
আচ্ছা আপনারা কজন বিশ্বাস করেন বলুন তো আমাদের বাবা মায়েরা আমাদের প্রতি যতখানি দায়িত্ববান হন, যতটা নিঃস্বার্থ ভাবে আমাদেরকে ভালবাসেন, একটা সময়ের পর আমরাও তাদের প্রতি ততটাই যত্নশীল হতে পারি?
আপনাদের উত্তরটা মন্তব্যের মাধ্যমে জানতে পারবো এই আশা রাখি। তবে আজ আমি এই বিষয়ে আমার নিজস্ব মতামত আপনাদের সাথে শেয়ার করবো। তবে তার আগে একটি ঘটনা আমি আপনাদের সাথে শেয়ার করি, তাহলেই হয়তো আপনাদের কাছে প্রশ্নটি আরো বেশি স্পষ্ট হবে। আর আপনারা বুঝতে পারবেন কেন আজ হঠাৎ করে এমন একটি বিষয়ে লিখতে বসলাম।
বিশেষ কিছু কাজে আজ বিকালের দিকে বাইরে বেরিয়েছিলাম। যখন বেরিয়েছি তখন শ্বশুর মশাই ঘুমাচ্ছিলেন এবং শরীরও মোটামুটি ভালোই ছিল। ঘন্টা তিনেক অনেক বাদে বাড়িতে ফিরে দেখতে পেলাম, তিনি দুটো কম্বল গায়ে দিয়ে শুয়ে আছেন এবং উপর থেকে শাশুড়ি মা দুটো কোলবালিশ তার উপরে চাপা দিয়ে রেখেছেন। তবুও তিনি কাঁপছেন।
যেহেতু এই জিনিসগুলো গত এক বছর ধরে দেখছি, তাই বুঝতে অসুবিধা হলো না সম্পূর্ণ বিষয়টি হয়েছে ইউরিন ইনফেকশনের জন্য। তড়িঘড়ি শুভকে ফোন করে বিষয়টি জানালাম এবং ফেরার পথে ওষুধ নিয়ে আসতে বললাম। তারপর কমিউনিটির কিছু কাজ সেরে, আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ শেষ করতে রাত প্রায় দশটার বেশি বেজে গেলো।
শ্বশুরমশাইকে ইনসুলিন দিয়ে রুটি করতে গেলাম। এমন সময় পাশের বাড়ির একজন জ্যেঠিমা এলেন আমাদের বাড়িতে। অতো রাতে ওনাকে দেখে বেশ অবাক হলাম। শাশুড়ি মা তালা খোলার পর, তিনি ঘরে এসে বললেন আমাদের পাড়াতেই একজন কাকু মারা গেছেন এবং সেই সংবাদটাই তিনি আমাদের বাড়িতে দিতে এসেছেন।
|
---|
তিনি মারা যাওয়ার সংবাদ পেয়ে আশেপাশের সকলেই বেশ খুশি। কথাটা শুনে নিশ্চয়ই অবাক হচ্ছেন? তবে এখানেই গল্পের আসল সত্যি। আমরা সর্বদাই ভাবি মৃত্যুর থেকে কষ্টদায়ক বোধহয় আর কিছু হয় না। তবে কোনো কোনো মানুষের ক্ষেত্রে মৃত্যুটাই হল সব থেকে সুখের। ঠিক তেমনটি ছিল ওই কাকুটির ক্ষেত্রে।
উনি পোস্ট অফিসে চাকরি করতেন। আমার বিয়ের পর আমার শশুর বাড়িতে ওনার সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয়। কারণ সেই সময় পোস্ট অফিসে আমাদের একটা বই খোলা হয়েছিলো। যার টাকা নেওয়ার জন্য প্রতিমাসের একটি নির্দিষ্ট দিনে তিনি আমাদের বাড়িতে আসতেন।
বিয়ের পর প্রথম যেদিন এসেছিলেন সেদিন বসে অনেকক্ষণ কথা হয়েছিলো। আমার সম্পর্কে, আমার পরিবারের সম্পর্কে, পড়াশুনা সম্পর্কে, বেশ অনেক কথাই জানতে চেয়েছিলেন এবং তারপর থেকে মাঝেমধ্যে ওনার সঙ্গে রাস্তায় বা পোস্ট অফিস দেখা হলে তিনি হেসে কথা বলতেন।
শাশুড়ি মায়ের কাছে শুনেছিলাম ওনার একটাই মেয়ে সন্তান। যার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। বাড়িতে উনি এবং ওনার স্ত্রী থাকতেন। বিয়ের বেশ কয়েক মাস বাদে হঠাৎ শুনলাম, ওনার মেয়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে চলে এসেছে এবং সে ডিভোর্স ফাইল করেছে, আর সংসার করবে না বলে।
পরে কাকু একদিন আমাদের বাড়িতে এলে, তিনি নিজেই জানান মেয়ে শশুর বাড়িতে থাকতে পারছে না বলে চলে এসেছে। তিনি ফিরে যাওয়ার জন্য বুঝিয়েছেন, তবে খুব বেশি জোর করেননি, কারন জোর করলে যদি মেয়ে কিছু করে বসে সেই ভয়।
এর ঠিক কয়েক মাস বাদে থেকে প্রায়শই ওই বাড়ি থেকে ঝগড়ার আওয়াজ পাওয়া যেতে এবং লোকমুখে শুনেছি মেয়েটি ও তার মা এক দলে হয়ে কাকুর সাথে ঝগড়া করতো। কারণ বাবা মেয়েটাকে একটু হিসেব করে চলতে বলতেন।
|
---|
মধ্যবিত্ত সংসারে যেমনটা হয়ে থাকে, এমন অনেক ইচ্ছে আমাদের থাকে যেগুলো হয়তো সব সময় পূরণ করা সম্ভব হয় না। কিন্তু তবুও বাবা-মায়েরা তাদের সাধ্যমত চেষ্টা করেন। এক্ষেত্রে কাকুটিও তেমনটাই করেছিলেন, তবে যে জিনিসগুলো তার সাধ্যের বাইরে ছিলো, সেগুলি করতেই তিনি যখন আপত্তি জানাতেন, তখনই শুরু হতো অশান্তি।
এরকম ভাবে চলতে চলতে একটা সময় তিনি নিয়মিত পোস্ট অফিসে যেতে পারতেন না, তারা শারীরিক অবস্থার কারণে। একদিন রাস্তার মধ্যে ওনাকে দেখে এত বেশি খারাপ লাগছিল যে ভাষায় প্রকাশ করার নয়। আমি যখন ওনাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম কেমন আছেন? উনি অবাক হয়ে বলেছিলাম আমাকে নাকি চিনতেই পারেন নি। মানসিক অত্যাচার বোধ হয় এমনটাই হয়। আর ওনার ক্ষেত্রে মানসিক এবং শারীরিক দুইভাবেই অত্যাচার চলত।
মাস তিনেক আগে ওনাকে বাড়ির উঠোনে দেখেছিলাম। চুল ও দাঁড়ি এতটাই বড় হয়েছিল যে, দেখতে পাগলের মতো লাগছিল। পরে শুনলাম পাশের বাড়ির একজন ওনার স্ত্রীকে বলেছিলেন চুল, দাঁড়ি এগুলো কাটিয়ে দিতে।
|
---|
তখন সেটা নিয়ে পাশের বাড়ির সাথে ঝামেলাও করেছিলেন ওনার স্ত্রী এবং মেয়ে। আর সেই ঘটনার পর থেকে সচরাচর তাদের সাথে আর কেউ বেশি কথাও বলত না। বলতে পারেন একই পাড়ার মধ্যে থাকলেও, পরিবারটি নিজেদের মতন একলা থাকতেই পছন্দ করত।
এরপর আর ওনাকে দেখিনি কখনো। তবে আজ এই জ্যেঠিমার মুখে শুনলাম স্ট্রোক করে ঘরের মধ্যেই পড়েছিলেন তিনি। মেয়ে বা স্ত্রী কেউই ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়নি, বা ডাক্তারকে বাড়িতে ডাকার প্রয়োজন মনে করেনি।
আমাদের এখানে বাড়ি বাড়ি ঘুরে যে লোকটি মিটারের রিডিং নেন, তিনি ঢুকেছিলেন ওনাদের বাড়িতে মিটারের রিডিং নেওয়ার জন্য। তিনি ওই কাকুর গোঙানির আওয়াজ শুনতে পেয়েছিলেন এবং তিনি জানতে চাওয়াতে তার মেয়ে বেশ অসভ্য আচরণ করেছিলেন।
পাশের বাড়িতে মিটারের রিডিং দেখতে এসো তিনি বিষয়টি জানান। তারপর পাশের বাড়ি থেকে একজন কাকু ওনার বাড়িতে গিয়ে ওনার খোঁজ জানতে চান এবং শেষমেষ ওনার স্ত্রী জানাতে বাধ্য হয়েছেন।
এই সব ঘটনার থেকেও যেটা বেশি কানে লেগেছে, ঐ সময় নাকি তার মেয়ে পাশের ঘরে শুয়ে ফোন দেখছিলো। এদিকে তার বাবাকে নিয়ে যখন সবাই দৌড়াদৌড়ি করে হসপিটালে যাচ্ছিলো, তখন জানালাটা খুলে মেয়েটা নাকি প্রশ্ন করেছে, - এখনও বেঁচে আছে, এখনও মরেনি?
শেষমেশ হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার পর তাকে মৃত বলে ঘোষণা করে। তাই ক্লাবের ছেলেরা আবার তাকে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। তবে স্ত্রী এবং মেয়ের অভিব্যক্তি দেখে নাকি মনে হয়েছিলো, তারা এতদিনে মুক্তি পেয়েছে। কারোর চোখ থেকে এক ফোঁটা জলও পড়েনি। বাড়িতে বেশিক্ষণ বডি রাখেনি। কোনো মতে ওনার শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়েছে। জানিনা বাকি নিয়ম কানুন ওনার স্ত্রী বা মেয়ে আদেও পূরণ করবে কিনা।
এই কথা বলতে বলতে জ্যেঠিমার চোখ ছলছল করছিলো, অন্যদিকে শুনতে শুনতে আমাদের। এতটা নিষ্ঠুর কোনো মানুষ হতে পারে? কোনো স্ত্রী কোনো সন্তান কিভাবে তার বাবার প্রতি এতটা খারাপ আচরণ করতে পারে, এটা ভাবতেই অবাক লাগছিলো।
এতদিন জানতাম এই বিষয়গুলো শুধুমাত্র সিনেমা, সিরিয়ালেই সত্যি হয়। কিন্তু বাস্তবে যে এমন চরিত্রের মানুষ থাকতে পারে, তা আজ প্রথমবার জানতে পারলাম। আশে পাশের প্রত্যেকেই প্রায় ওই কাকুর কষ্টের কথা জানতেন বা বুঝতে পারতেন। এই কারণেই বুঝি সকলে খুশি হয়েছেন যে, উনি মারা গেছেন অন্তত ওনার শাস্তি পাওয়ার মেরাদ ফুরিয়েছে, উনি মুক্তি পেয়েছেন।
ভাবুন তো এই সন্তানকে কত কষ্ট করে তিনি লালন-পালন করেছিলেন। আমি মানছি হয়তো বাবার প্রতি কখনো কখনো আমাদের সকলেরই কিছু রাগ, কিছু অভিমান, জমা হয়। কিন্তু তার কোনো কিছুই ভালোবাসাকে ছাপিয়ে যেতে পারে না।
|
---|
সন্তান হিসেবে মেয়েটি তার বাবার সাথে যে আচরণ করেছে, এর জন্য কি তার বিবেকে কখনো তাকে প্রশ্ন করেছে? তাকে আদরে যত্নে বড় করার তিনি কি কখনো ভেবেছিলেন, তার সন্তান কখনো তার প্রতি এমন অবিচার করবে? এমনকি ওনার স্ত্রীর বিষয়টা ভাবলেও খুব অবাক লাগছে। আমার যে মানুষটার সঙ্গে বছরের পর বছর সংসার করা হয়, সে অনেক খারাপ হলেও, তার সাথে কি কখনো এই ব্যবহার করা আদেও সম্ভব?
সত্যি কথা বলতে সংসার করতে করতে কখনো কখনো পরিস্থিতির চাপে অনেক রাগ, অনেক অভিমান আমার নিজেরও হয়। অনেক সময় প্রতিশোধ নিতে ইচ্ছে করে, প্রতিবাদ করতে ইচ্ছে করে, অনেক কথার উত্তর দিতে ইচ্ছা করে, কিন্তু তবুও দিন শেষে এই মানুষগুলোর প্রতি একটা মায়া তৈরি হয়েছে। তাই তাদের সাথে ঝগড়া হতে পারে, মনোমালিন্য হতে পারে, মতানৈক্যতা হতে পারে, কিন্তু তাদের সাথে এমন অমানবিক আচরণ করবো, এমনটা ভাবতেও পারি না। আর এখানে তো মেয়েটি নিজের বাবার সাথে এমন করেছে।
এই সম্পূর্ণ ঘটনা জানার পরেই এই প্রশ্নটি আমার মনে এসেছে- আদেও কি আমরা আমাদের বাবা-মাকে তাদের মত করে ভালবাসতে পারি? সত্যিই পারি না।
আমি জানিনা আমার প্রার্থনা আদেও কতখানি গ্রহণীয় হবে। তবে সত্যিই মন থেকে চাই মানুষটির আত্মা যেন শান্তি পায়। তিনি ভালো ছিলেন, মন্দ ছিলেন, এই সমস্ত কিছুর ঊর্ধ্বে গিয়ে তিনি একজন মানুষ ছিলেন, তাই তার প্রতি একটু মানবিক আচরণ নিশ্চয়ই করা যেতো বলে আমার বিশ্বাস।
বেশ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আজকের পোস্ট লেখা শেষ করছি। ঘটনাটি সম্পর্কে আপনাদের মতামত নিশ্চয়ই জানতে চাইবো।
সম্পূর্ণ ঘটনা জেনে আমার তো ওনার স্ত্রী এবং মেয়েকে মানসিকভাবে অসুস্থ মনে হয়েছে, কারণ কোনো সুস্থ মানুষের পক্ষে নিজের স্বামী, বা নিজের বাবার সাথে এমন আচরণ করা অসম্ভব।
পৃথিবীতে পিতা মাতাই একমাত্র আমাদেরকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসে, পিতা মাতার ভালোবাসার তুলনা কিছুই হতে পারে না, হয়তো একটা সময় আমরা সেই ভালোবাসার মূল্য দিতে পারি না, বিশেষ করে কিছু মানুষ রুপি জানোয়ার রয়েছে, যারা বৃদ্ধ বয়সে পিতা-মাতাকে কষ্ট দেয়, আপনার পাশের বাড়ির কাকুর ঘটনা শুনে খুব খারাপ লাগলো, আমার মনে হয় তার স্ত্রী এবং মেয়ে মানসিকভাবে অসুস্থ, আমাদের সকলের উচিত পিতা মাতার সাথে সঠিক ব্যবহার করা এবং তাদের যত্ন নেওয়া। ধন্যবাদ ভালো থাকবেন।
Thank you so much for your support @aviral123 ma'am. 🙏
সত্যি দিদি আপনার পোস্ট পড়তে আমার খুবই ভালো লাগে। এত সুন্দর লেখেন যে আমি কি কমেন্ট করব সেটাই বুঝতে পারি না। তবে এখনকার যুগে বাবা-মায়ের থেকে নিঃস্বার্থ ভালোবাসা আর কেউই বাঁচতে পারে না। যতদিন যাবে ততই মানুষের মধ্যে হিংসা বেড়ে যাবে। এখনকার দিনে সন্তানদের নিরাপদ জায়গা হল মায়ের কোল। আপনার পোস্ট সর্বদাই পড়তে আমার খুবই ভালো লাগে। সুন্দর পোস্টটি শেয়ার করার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
আপনার লেখা এবং ঘটনাটি সত্যিই হৃদয়স্পর্শী এবং মনকে অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি করে দেয়। বাবা-মায়ের নিঃস্বার্থ ভালোবাসা এবং তাদের প্রতি আমাদের দায়িত্ব কতটা পূর্ণ করতে পারি, সেটি সত্যিই ভাববার বিষয়। এমন নিষ্ঠুরতা কোনো সুস্থ মনের মানুষের পক্ষে করা সম্ভব নয়। বাবা-মা আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ, এবং তাদের প্রতি ভালোবাসা ও যত্ন সবসময়ই আমাদের প্রায়োরিটি হওয়া উচিত। বাবা-মা যেমন আমাদের বড় করেছেন, তেমনই আমাদের উচিত তাদের বার্ধক্যে পাশে থাকা।