"ভালো সময়ের অপেক্ষায় প্রহর গুনছি"

in Incredible India11 months ago
ঘড়িতে রাত ২.৫৭ বাজে। এস.এস.কে.এম হসপিটালের ট্রমা কেয়ার ওয়ার্ডের আই.সি.সি.ইউ ওয়ার্ডের বাইরে বসে আছি আমরা চারজন। অর্থাৎ আমি, আমার মাসি, মাসির মেয়ে ও আমার ছোটদি।কারণ আমার দিদির হাজব্যান্ডের কিছুক্ষণ আগে ব্রেন সার্জারি হলো। বিষয়টি আপনাদের একটু খুলেই বলি। আসলে কাল....
IMG_20230802_204649.jpg
"ঈশ্বরই একমাত্র ভরসা,তিনি যেন আমাদের সহায় হন"

গতকাল রাতে এই পর্যন্তই লিখতে পেরেছিলাম। তারপর আর লেখা হয়নি। কারণ দিদিকে সামলাতে সামলাতে গোটা রাত কাটিয়ে দিয়েছি, আমি, আমার মাসি ও মাসির মেয়ে। জীবনে এত বড় একটা ধাক্কা সামলাতে অনেকটা মনের জোরের দরকার, যেটা হয়তো তখন শুধুমাত্র আমরাই দিদিকে দিতে পারতাম।

যাইহোক এখন আমি রিসেপশন রুমে বসে আপনাদের সাথে লেখাটা শেয়ার করছি। আজও সারারাত দিদির কাছে থাকতে হবে। বাড়িতে গিয়েছিলাম বেশ কিছু জিনিস রাখতে এবং নিজে ফ্রেশ হতে। তারপর একটু খাবার আবার হসপিটালে এলাম।

লড়াইটা এখন আরো বেশি কঠিন হতে চলেছ। গতকাল নিউরোসার্জেন্ট ওটি থেকে বেরিয়ে বললেন দু-তিন দিন পর্যবেক্ষণ করার পরে বোঝা যাবে, ব্রেনের উপরে আদেও কতটা চাপ পড়েছে এবং তাতে ব্রেন ঠিক কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

দিদির হাসবেন্ড বেশ কয়েকদিন ধরে অসুস্থ ছিলেন। জ্বর সর্দি ছিল। ভাইরাল ফিভার মনে করে আলাদাভাবে টেস্ট করানো হয়নি। কিন্তু ভিতরে ভিতরে শরীর অনেক দুর্বল ছিল। ২-৩ দিন আগে নিজে থেকে উঠে বিছানায় পর্যন্ত যেতে গিয়ে হঠাৎ করে মাথা ঘুরে ঘরের ভেতরেই পড়ে যায়।

যেহেতু আমার জামাইবাবু একজন এক্স আর্মি ম্যান। তাই তিনি শরীর স্বাস্থ্য সম্পর্কে সর্বদাই সচেতন থাকতেন। কিন্তু কপাল খারাপ থাকলে যেমনটা হয়,এইবার জ্বরটাকে খুব বেশি সিরিয়াসলি না নিয়ে সাধারণ প্যারাসিটামল ট্যাবলেট খেয়ে ভেবেছিলেন সুস্থ হয়ে যাবেন। কিন্তু ঘটল তার বিপরীত।

IMG_20230802_205837.jpg
"দাদার সাথে তোলা ছবি খুব বেশি নেই।এটি আমাদের ইকোপার্কে ঘুরতে গিয়ে তোলা ছবি"

হঠাৎ করে উঠে দাঁড়াতেই মাথাটা ঘুরে গিয়েছিল এবং তিনি ঘরের ভিতরেই পড়ে যান এবং পুড়ে যাওয়াটা এতটাই খারাপ ছিল যে, তার মাথা ফেটে যায় এবং আটটি সেলাই পড়ে। তারপর হসপিটালে নিয়ে এলে ব্লাড টেস্ট করলে বোঝা যায় তার শরীরে ডেঙ্গুর ভাইরাস রয়েছে। একদিকে ডেঙ্গু, অন্যদিকে ব্রেনে পাওয়া আঘাত, সবকিছু মিলে তার শরীর অনেক বেশি খারাপ হয়।

প্লেটলেট দিয়ে কোনো রকমে ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে লড়াই করা গেলেও, গতকাল তা আরো খারাপ পরিস্থিতি তৈরি করে এবং এমত অবস্থায় ডাক্তারদেরকে সিদ্ধান্ত নিতে হয় অপারেশন করার। কারণ ব্রেনের ভিতরে ব্লাড ক্লড বেঁধেছিল, যা তার শরীরের জন্য অনেক বেশি ক্ষতিকারক।

এই কারণে গতকাল বলতে পারেন এক মুহূর্তের মধ্যে ডিসিশন নেন যে, তারা ব্রেন অপারেশন করবেন। কিন্তু সেই সময়ে তারা ভয় পেয়েছিলেন, ডেঙ্গুর কারনে।

সেইমত আমরা সকলে দিদির পাশে দাঁড়ানোর জন্য হসপিটালে গিয়ে পৌঁছলাম। কিন্তু দুঃখের বিষয় কালকে আবহাওয়াও পরিস্থিতির বিপরীতে চলছিল। কালবৈশাখী ঝড়ের মতন ঝড়, তার সাথে অঝরে অনবরত বৃষ্টি হচ্ছিল। কিন্তু তবুও আমাদের দিদির কাছে পর্যন্ত পৌঁছাতেই হতো।

প্রায় অর্ধভেজা অবস্থায় আমরা সকলে গিয়ে পৌঁছালাম। ততক্ষণে দাদাকে ঢুকিয়ে নিয়েছিল, কারণ অপারেশন শুরু করার আগে চার ইউনিট প্লেটলেট দিয়ে নিয়েছিল। যাতে অপারেশন চলাকালীন অবস্থা খারাপ না হয়। যেহেতু শরীরে ডেঙ্গুর ভাইরাস ছিল তাই, অপারেশন চলাকালীন ব্লাড যাতে নষ্ট না হয় এই কারণে ডাক্তাররা এটিকেই সঠিক পদ্ধতি বলে মনে করেছিলেন।

এই প্রথমবার ওটির বাইরে বসে ডক্টর নার্সদের ছোটাছুটি, তাদের ইশারায় কথা বলা,সবকিছু সামনে বসে দেখছিলাম।কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। সাড়ে তিন ঘন্টার দীর্ঘ লড়াইয়ের পর অপারেশন শেষ হয়। ঘড়িতে তখন প্রায় রাত ১.৪৫ । তারও বেশ কিছুক্ষণ বাদে দাদাকে ওটি থেকে শিফট করা হয়।

তখন দূর থেকে এক ঝলক দেখতে পেলাম। ডক্টর বলেছিলেন দাদার মাথার স্কাল্পটা বাদ দিতে হবে, কারণ সেটাকে পুনরায় এই মুহূর্তে যদি তারা অপারেট করে লাগিয়ে দেয়, তাহলে সেটা আবার ব্রেনের জন্য ক্ষতিকারক হতে পারে। পরবর্তীতে সব ঠিক হলে অপারেশন করে অন্য কোন প্লেট সেখানে লাগাতে হবে।

IMG_20230802_204709.jpg
"ঈশ্বর এদের মুখের হাসি অমলিন রাখুন,দাদাকে সুস্থ করে তুলুন এটুকুই প্রার্থনা"

আসলে কথাগুলো যত সহজে আপনাদের সাথে শেয়ার করছি, সেই পরিস্থিতির দাড়িয়ে শোনাটা আমাদের জন্য ততটাও সহজ ছিল না। কিন্তু দিদির পাশে দাঁড়িয়ে আমাদের দুর্বল হওয়া চলবে না, এটা ভেবেই নিজেদেরকে শক্ত করেছিলাম। যাতে এদিকে সামলাতে পারি। সত্যিই জানিনা আরো কতদিন এই লড়াই চলবে।

সময় যখন খারাপ যায় তখন বোধহয় এরকম ভাবে একটার পর একটা অঘটন ঘটতেই থাকে। বাবার অসুস্থতা থেকে আমাদের জীবনের খারাপ দিন শুরু হয়েছে। তারপর ঠাকুরমার অসুস্থতা, তার পৃথিবী থেকে চলে যাওয়া, আর এখন আবার দিদির হাজবেন্ডের এত বেশি শরীর খারাপ।

পর পর এইসব ঘটনা আমাদেরকে যেন ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিচ্ছে। ভেবেছিলাম মালদা ঘুরতে গিয়েছি, বেশ কয়েকদিনের আনন্দের মুহুর্ত আপনাদের সাথে শেয়ার করব। কিন্তু তার মধ্যেই এত বড় একটি দুর্ঘটনা ঘটে গেল, তাই ভাবলাম আপনাদেরকে বিষয়টি সম্পর্কে জানাই।

আসলে ডাক্তারদের চিকিৎসার পাশাপাশি, ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনাও কিন্তু অনেক সময় অনেক সমস্যার সমাধান করে। আজকে আপনাদের সাথে সম্পূর্ণ বিষয়টি শেয়ার করলাম, যাতে আপনারা প্রত্যেকে আমার দিদির হাসবেন্ডের জন্য একটু প্রার্থনা করেন।

যাতে সে সুস্থ হয়ে তার সন্তানদের কাছে ফিরে আসতে পারেন। কারণ ওদের বাচ্চাদুটো খুবই ছোট। জীবনের বাস্তবতা তারা এখনো বোঝেনা। আমরা কেউ জানিনা কার প্রার্থনার জোর কতটা, তাই আপনাদের প্রত্যেকের কাছে অনুরোধ রইলো, দাদার সুস্থতার জন্য সকলে প্রার্থনা করবেন।

যাতে সবটা ভালো থাকে। আর অবশ্যই নিজেদের খেয়াল রাখবেন। চারিদিকে দিন দিন ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছে। তাই সচেতনতাই একমাত্র আমাদের ডেঙ্গু থেকে দূরে থাকার অবলম্বন। আজকের মত এখানেই শেষ করলাম। ভালো থাকবেন সকলে।

Sort:  
 11 months ago 

এত বড় একটা বিষয় আসলে পড়ে খুব খারাপ লাগলো,,,, সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করি যেন আপনার জামাই বাবুকে ভালো করে দিক।

আমার জায়গা থেকে যতটুকু সম্ভব আমি দোয়া করি। ভালো থাকবেন টেনশন করবেন না।

ঈশ্বর আপনার জামাই বাবুকে তাড়াতাড়ি সুস্হ করে দিক সেই কামনা থাকছে।কিছুদিন আগে আমার একজন কলিগ এর বন্ধুর সেম সমস্যা হয়ছিল,আর আমার নিজের দাদা নিউরোসার্জন থাকায় আমার সঙ্গে বার বার সব শেয়ার করছিল আমার কলিগ।সেই সময় দেখেছি এরকম একটা সময়ে পরিবার কতটা কঠিন সময় পার করে।

 11 months ago 

আপনার পুরো লেখাটি পড়ে বুঝতে পারলাম আপনার জামাইবাবুর ব্রেন সার্জারি করা হয়েছে ৷ আসলে এটা অনেক সিরিয়াস একটি বিষয় এই বিষয়ে আপন জনেরা কেউ ঠিক থাকতে পারে না সবাই অনেক চিন্তিত থাকে ৷
আপনারা সবাই সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করেন যেন আপনার জামাইবাবু পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যায় খুব তারাতারি ৷

আমি ও সৃষ্টিকর্তার কাছে জোর হাতে প্রার্থনা করি যেন আপনার জামাইবাবু পুরোপুরি সুস্থ হয়ে আবার আপনাদের মাঝে ফিরে আসে ৷

আপনারা সবাই ভালো থাকবেন দিদি ৷ মনে শক্তি রাখবেন ৷

 11 months ago 

শম্পা দিদি,আপনার পোস্ট থেকে সার্বিক বিষয়ে জানতে পারলাম।ডেঙ্গুজ্বর থেকে এত বড় ঘটনা ঘটে গেল এটি সত্যিই মর্মান্তিক। যে কারো সাথে এ ধরনের ঘটনা ঘটা সত্যি খুবই কষ্টকর ব্যাপার। ওনার পরিবারের জন্য অনেক দোয়া করছি যাতে ওনারা মনকে শক্ত রেখে পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে পারেন। আপনি তাদের পাশে আছেন তাদেরকে যে মানসিক সাপোর্ট দিচ্ছেন এটাও অনেক বড় ব্যাপার।ভেঙে পড়বেন না। নিশ্চয় সৃষ্টিকর্তা আপনাকে সহায়তা করবেন।

 11 months ago (edited)

আসলেই আমাদের জীবন বড়ই অদ্ভুত। কখনো ভালো সময়, আবার কখনো খারাপ সময় এগুলো প্রতিনিয়ত আমাদেরকে ঘিরে রেখেছে। তবে আপনার তথ্য অনুসারে খুবই খারাপ সময় যাচ্ছে আপনার ও আপনার আপনজনদের সাথে এটা স্পষ্টই বুঝতে পারলাম।

এই মুহূর্তে আপনাকে কিভাবে সান্ত্বনা দিবো বুঝতে পারছি না। তবে একটা কথাই বলবো, "মনকে শক্ত করুন এবং ঈশ্বরের বিশ্বাস রাখুন।"

অনেক প্রার্থনা রইলো ঈশ্বরের কাছে দাদার জন্য। ঈশ্বর যেন খুব শীঘ্রই দাদাকে, সুস্থ্য করে দেন।🙏🙏🙏

Loading...
 11 months ago 

আমাদের অনেক খারাপ লাগছে যে অনেক খারাপ সময় মধ্যে দিয়ে পার করছেন আপনি এখন। আপনার জন্য দোয়া ছাড়া আমরা আর কিছুই করতে পারব না। তবে আল্লাহ সুবাহানাতালা যেটা করেন নিশ্চয়ই ভালোর জন্যই করেন। হয়তোবা আল্লাহ সুবাহানাতালা আপনার ধৈর্য পরীক্ষা করছে না হলে এর সুবাদে ভালো কিছু আপনাকে দান করবেন। ভালো থাকবেন। নিজের প্রতি খেয়াল রাখবেন।

Coin Marketplace

STEEM 0.19
TRX 0.13
JST 0.030
BTC 62567.99
ETH 3431.85
USDT 1.00
SBD 2.47