"দেবীপক্ষের সূচনা-মহালয়"
|
---|
Hello,
Everyone,
রাত পোহালেই দেবীপক্ষের সূচনা হবে। আর অবসান ঘটবে আপামর বাঙালির অপেক্ষার। দেশ হোক বা বিদেশ বাঙালি বোধহয় অধীর আগ্রহে এই দেবীপক্ষের অপেক্ষা করেন, কারণ এদিন থেকেই তো সূচনা হয় বাঙালির সবথেকে বড় উৎসবের।
দেখতে দেখতে বছর পেরিয়ে আবার পুজো চলে এলো। যদিও প্রকৃতি অনেক আগেই জানান দিয়েছে মা আসছেন। মায়ের আগমনের বার্তা সবার আগে প্রকৃতি আমাদের দিয়ে থাকে, অথচ এই বছর এই প্রকৃতি বোধহয় সকলের আনন্দে কিছুটা হলেও বিঘ্ন ঘটাবে। অন্তত আবহাওয়া দপ্তরসূত্র তেমনি পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। তবে ওই যে মা চাইলে সব পারেন, সেই আশাতেই বাঙালি বুক বেঁধে আছে।
ছোটবেলা থেকেই অন্যান্য অনেকের মতন পুজো নিয়ে আমার আলাদা কোনো উৎসাহ আমার মধ্যে ছিল না, আর আজও নেই । মানে ঐ পুজোতে ঘুরতে যাবো, রাত জেগে প্যান্ডেলে ঠাকুর দেখবো, এইসব আর কি।
তবে ভালো লাগে যখন চারিদিকে উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হয়। ফোনের গ্যালারি ভরে যায় শুভেচ্ছা বার্তায়। সোশ্যাল মিডিয়ায় চোখে পড়ে বিভিন্ন দেশ-বিদেশের মায়ের মূর্তির ছবি এবং পুজোর ছোটো ছোটো বিভিন্ন মুহুর্ত। সবকিছু মিলিয়ে ঘরে বসেও কিন্তু পুজোর আনন্দ উপভোগ করা যায় ।
আজ এই পোস্টের মাধ্যমে ছোটবেলার কিছু স্মৃতি রোমন্থন করবো, পাশাপাশি সেই দিনগুলো বর্তমান সময়ে কিভাবে পার হয় সে কথাও বলব।
মহালয়ার স্মৃতিতে ছোটবেলা মানেই ভীষণ আনন্দঘন একটি দিন, পাশাপাশি উত্তেজনায় ভরপুর। আজকাল প্রত্যেক বাড়িতে হয়তো প্রতিটা রুমেই একটা করে টিভি থাকে। তবে আমার ছোটবেলায়, আমার গ্রামে হাতে গোনা কয়েকটি বাড়িতেই টিভি ছিলো।
তবে মহালয়া দেখার আনন্দ সব থেকে বেশি সেই সময় অনুভব করেছি। প্রথমে ছিল সাদা কালো টিভি, তারপর যখন দু-একটা বাড়িতে রঙিন টিভি এলো, মানুষের ভিড় উপচে পড়তো সেই বাড়ির ঘর, বারান্দায়। কারণ তখন রঙিন টিভিতে মহালয় দেখার উত্তেজনা ছিল সবার মধ্যে।
আগের দিন বিকেল থেকেই অনেক প্ল্যানিং হতো। কটা নাগাদ ঘুম থেকে উঠতে হবে, কে কার বাড়িতে ডাকতে যাবে, দলবেধে কটার সময় আমরা সেই বাড়িতে পৌঁছাবো সেসব নিয়ে। আগের দিন সেই বাড়িতে গিয়ে বলে আসতাম আমরা কখন যাবো মহালয়া দেখতে।
আজকের দিনে আমাদের বেড়ার বাড়ীটাকে খুব মিস করি। কারণ পাঁকা দেওয়ালের বাড়িতে যে আনন্দ তার থাকে, তার থেকে অনেক বেশি শান্তি আছে ওই বেড়ার দেওয়ালে। ঘুম থেকে উঠতে দেরি হলে, সেই বেড়ার ফাঁক দিয়ে বান্ধবীদের ডাক মিস করি।
আমার মাকে সকলে খুব ভয় পেতো, এই কারণে খুব ধীরে ধীরে আমার খাটের পাশের বেড়াতে গিয়ে নাম ধরে ডাকতো। তারপর ধীরে ধীরে আমি উঠে মাকে ডেকে তুলতাম। তারপর হাতমুখ ধুয়ে, মাকে সাথে নিয়ে, বান্ধবীদের সাথে পৌঁছে যেতাম মহালয়া দেখতে।
আজকাল বেড়ার বাড়ি প্রায় চোখেই পড়ে না এমনকি আমাদের গ্রামেও নয়। বেড়ার বাড়ি ব্যক্তিগত ভাবে আমার ভালো লাগে। অন্তত বেড়ার দেয়ালের দুই পাশে থাকা মানুষগুলো নিজেদের কথা শুনতে পারে, অনুভূতি বুঝতে পারে, তবে আজকাল পাঁকা দেওয়াল পার করে নিজের কান্না গুলো খুব কাছের মানুষের কাছে পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে না।
মহালয়া দেখে ফেরার পথে শিউলি ফুল কুড়ানোর সেই স্মৃতিগুলো আজও জ্বলজ্বল করে চোখের সামনে। সারা বছর যদিও এখন অনেক গাছে শিউলি ফুল ফোটে, কিন্তু শরতের শিউলি ফুলের গন্ধ মায়ের আগমনী বার্তা পৌঁছে দেয় আমাদের কাছে।
গ্রামে তখন বেশিরভাগ বাড়িতে এই ফুল গাছ থাকলেও, মল্লিক বাড়ির শিউলি ফুল গাছে তলায় মানুষের ভিড় হতো অনেক। বিশাল বড় এক শিউলি ফুল গাছ গোটা উঠোন জুড়ে ফুলে সাদা হয়ে থাকতো। আমরা এত মানুষ কুড়াতাম তবুও কিভাবে যেন ফুল ফুরাতেই চাইত না। বলতে পারেন এই মল্লিক বাড়ির শিউলি ফুলে আমাদের পাড়ার দুর্গা ঠাকুরের পুজো হতো।
ছোটবেলার মহালয়ার কাহিনী গুলো ভালো লাগতো। মা দুর্গার জীবন কাহিনী দেখানো হতো গল্পের মাধ্যমে। তবে আধুনিকতার ছোঁয়ায় আজকাল সমস্ত কিছুর পাশাপাশি পরিবর্তন এসেছে এখানেও। তবে আমাদের ছোটবেলাকার মহালয়ার গুলি যতটা হৃদয় স্পর্শী ছিলো, আজকাল মহালয় ততখানি ছুঁতে পারে না আমাকে।
তবে যেটা ছুঁতে পারে সেটি হল বীরেন্দ্র কিশোর ভদ্রের মহালয়। যেটা শুনে ছোট থেকে বড় হওয়া। তখনকার দিনে এফএম রেডিওতে এই মহালয় শোনা যেতো। আমাদের বাড়ির যে রেডিওটি ছিল সেটা সারারাত আস্তে আস্তে চালানো থাকতো মায়ের কানের কাছে।
যাতে মহালয়া শুরু হলে মা বুঝতে পারে। আর ঠিক যখন মহালয়া শুরু হতো, তখন রেডিওর শব্দ বাড়িয়ে দিতো। শুধু আমাদের বাড়িতে নয়, আশেপাশের সব বাড়িতে একই সাথে বেজে উঠতো বীরেন্দ্র কিশোর ভদ্রের মহালয়ার সুর। আজকাল আর তেমনভাবে বাজে না, কারণ সকলে হাতে এখন স্মার্টফোন আর কানে দেওয়ার জন্য আছে হেডফোন।
এইভাবেই যুগ পরিবর্তন হচ্ছে ধীরে ধীরে। তাই যুগের পরিবর্তনে নিজেকে মানিয়ে নিলেও, বেশ কিছু অনুভূতি যেন আজও পরিবর্তিত হয়নি আর হবেও না কখনো। কারণ আজও সেই ছোটবেলার স্মৃতিতে ভাসতে বড় ভালো লাগে। বহু বছর ভোরবেলায় উঠে মহালয় দেখা হয় না, ইচ্ছাও করে না জানেন। কারণ এখন না আছে সেই বেড়ার ঘর,না আছে সেই বন্ধুরা, না আছে সেই উত্তেজনা, আর আর না আছে মহালয়ের সেই সুন্দর সকাল।
শহর তো ছেড়ে দিন, আজকাল গ্রামের মানুষেরাও বড্ড বেশি আত্মকেন্দ্রিক। তাই নিজেদের বাড়িতে, নিজেদের ঘরে, যার যার টিভিতে তারা মহালয়া দেখতে পছন্দ করেন। আজ আর কারোর বাড়ির বারান্দায় মহালয় দেখার ভিড় উপচে পড়ে না। তাই বোধয় ভালোলাগাও কাজ করে না খুব বেশি।
তবে জানেন ছোটবেলায় যখন বেশ কিছুজনের পিছনে বসে অন্যের বাড়িতে মহালয়া দেখতে হতো, তখন মনে মনে খুব চাইতাম আমাদের একটা টিভি হোক, আমার একটা টিভি হোক, যেখানে শুধু আমি একাই দেখতে পারবো। অন্য কারোর পিছনে বসে আমাকে দেখতে হবে না। এখন ভাবলে হাসি পায়।
আজ কিন্তু তেমনই সব, আমার ঘর আছে, ঘরে টিভি আছে, যেটার উপরে আমার একারই আধিপত্য, কিন্তু দুঃখের বিষয় যা নেই তা হল সেই আবেগ, সেই অনুভূতি, সেই উচ্ছ্বাস। কারণ আর অন্য কিছুই নয় স্মৃতিগুলো ছোটবেলার হলেও, নিজে অনেকটা বড় হয়ে গেছি। এই কারণেই বাস্তবতা ছুঁয়েছে আমাকে, পরিস্থিতি পরিবর্তন করেছে আমার অনুভূতি, নিজের ভিতরের বাচ্চাটাকে মাঝেমধ্যে খুব ফিরে পেতে ইচ্ছে করে, কিন্তু একথাও সত্যি এ জীবনে তা আর সম্ভব নয়।
এমন করে আরো অনেকগুলো মহালয় পার হবে। দেবী আসবেন প্রতিবছর। পরিবর্তন হবে এই জীবনের পরিস্থিতি। বদলে যাবে সময়, আর বদলে যাবো আমি। তবে যা বদলাবে না তা হলো, ছোটবেলার সেই আবেগ মিশ্রিত স্মৃতিগুলো। থাক না সেগুলো মনের মনিকোঠায় জমা। বছরে এই একটি দিনেই না হয় ফিরে যাব সেখানে, উলোটপালোট করে দেখবো দিনগুলো। মন্দ কি!!!
আপনাদের মহালয়ের দিনগুলো কেমন ছিলো অবশ্যই জানাবেন। সকলে খুব ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন, আপনাদের সকলকে মহালয়ার অনেক অনেক শুভেচ্ছা জানাই। দেবী পক্ষের সূচনায় আপনাদের সকলের জন্য রইল আগাম দুর্গোৎসবের শুভেচ্ছা। শুভরাত্রি।
Thank you so much @eliany ma'am for your support. 🙏