ঘুমাতে পারিনি সেই দুশ্চিন্তার রাতে
হ্যালো বন্ধুরা আসসালামু আলাইকুম/আদাব। সবাই ভালো আছেন এবং সুস্থ আছেন আশা করছি। আমিও মহান আল্লাহর অশেষ রহমতে ভালো আছি আলহামদুলিল্লাহ। সবাইকে শুভেচ্ছা জানিয়ে আমার ব্লগ লেখা শুরু করছি।
আমি কুড়িগ্রাম জেলার রৌমারী থানায় অবস্থিত একটি এলসি স্টেশন দিয়ে পাথর ও কয়লা আমদানি করতাম। যে সময়ের কথা বলছি সেটা ছিল ডিসেম্বর মাসের শেষের দিকে। এ সময়ে নদীর পানি প্রায় শুকিয়ে যায়। তাই নৌকা পারাপার হওয়া অনেক কষ্টসাধ্য ব্যাপার।
যাইহোক আসল ঘটনায় ফিরে আসি, আমি সাধারণত ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত কয়লা আমদানি করতাম। তারপর বছরের বাকি সময়গুলোতে পাথর আমদানির মত। সাধারণত পাথর ও কয়লা ট্রাকে বোঝাই হয়ে যমুনা সেতুর উপর দিয়ে কুড়িগ্রামে পৌঁছায়।
এক্ষেত্রে কয়েকশো কিলোমিটার ঘুরে কুড়িগ্রামে আসতে হয়। ভাটায় কয়লা শেষ হওয়ার কারণে জরুরী ভিত্তিতে রাতেই কয়লা দিতে বলেছিল। এদিকে ট্রাকে লোড দিয়ে কুড়িগ্রাম পৌঁছাতে সারারাত্রি পার হয়ে পরের দিন দুপুর পর্যন্ত সময় দিতে হবে।
তাই ভাবছি নদীপথে কয়লা চিলমারী বন্দর পর্যন্ত নিয়ে সেখান থেকে ট্রাক লোড দিয়ে রাতেই পৌঁছানো যাবে। ভাটার ক্ষেত্রে বিষয়টা অত্যন্ত স্পর্শকাত। কারণ ভাটায় শুরুতে একবার আগুন দিলে শেষ হওয়া পর্যন্ত মাঝখানে বন্ধ করার কোন অপশন নেই।
তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম নদী পার করে রাতেই ট্রাক বোঝাই দিয়ে কয়লা ভাটায় পৌঁছাব। সেই মোতাবেক নৌকায় কয়লা তুলে চিলমারী বন্দর পৌছালাম। ঘাটে নেমে কিছুক্ষণের মধ্যেই একটি ট্রাক বন্দোবস্ত করে ফেললাম। রীতিমতো ট্রাকে কয়লা বোঝাই হয়ে গেল।
ঘড়ির কাঁটায় তখন রাত্রি দশটা কয়লা বোঝাই হয়ে ট্রাক ছেড়ে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত। আমি মনে মনে অনেক খুশি হলাম খুব তাড়াতাড়ি যেতে পারছি বলে। যেই না ট্রাক স্টার্ট করে গিয়ার লাগিয়ে দিল অমনি এক বিপত্তি ঘটে গেল। ট্রাক আর সামনের দিকে এগোচ্ছে না পিছনের চাকা মাটিতে বসে গিয়েছে।
অনেক চেষ্টা করার পরেও ট্রাক এক ইঞ্চি উপরে উঠানো গেল না। লেবাররা চাকার সামনে ও পেছনে মাটি খুঁড়ে অনেক চেষ্টা করছিল কিন্তু কোন কাজ হয়নি। নদীর একদম কাছাকাছি ট্রাক চাপানো ছিল। এই ধরুন পাঁচ মিটার দূরে, সেটাই হচ্ছে বিপদের মূল কারণ।
ওভারলোড ট্রাক সে কারণে যতই সামনে পিছনে আপডাউন করছে ততই চাকা নিচের দিকে বসে যাচ্ছে। নদীর খুব কাছে হওয়াতে মাটিগুলো নিচের দিকে বেশি নরম। যত সময় গড়িয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে বিপদের সম্ভাবনা আরো ঘনীভূত হচ্ছে। ধীরে ধীরে মাটিতে ফাটল ধরতে শুরু করে।
চেষ্টার কোন ত্রুটিই করা হয়নি, ট্রাকটিকে টেনে তোলার জন্য আরো দুইটি ট্রাক্টর ভাড়া করে নিয়েছিলাম। রশি বেঁধে টেনে তোলার অনেক চেষ্টা করে হয়েছে। ওই যে আগেই বলেছিলাম যতই টানাটানি করা হচ্ছিল ততই ফাটল আস্তে আস্তে বড় হতে থাকলো।
রাত অনেক গভীর হয়ে গিয়েছে কিন্তু এখন পর্যন্ত এখান থেকে ট্রাক ছাড়তে পারিনি। সবাই বলছে এক জায়গায় শুয়ে বিশ্রাম নিতে। কিন্তু মাথায় এত দুশ্চিন্তা নিয়ে কি আর চোখ বন্ধ করা যায়। চোখে প্রচন্ড ঘুম কিন্তু দুশ্চিন্তার কারণে ঘুমাতে পারছি না
রাত গভীর হওয়ার সাথে আস্তে আস্তে লোকজন কমতে শুরু করলো। শুধুমাত্র ভাড়া করা ট্রাক্টরের ড্রাইভার দুইজন আর চারজন লেবার আছে সাথে। যখন নদীর পারে ফাটল আস্তে আস্তে কিছুটা বাড়তে শুরু করল তখন আর সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করলাম না।
ট্রাক্টর দিয়ে খুব দ্রুততার সাথে কয়লা আনলোড করে অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হল। এভাবে দুটি ট্রাক্টর দিয়ে পর্যায়ক্রমে কয়লা দূরে কোথাও নিয়ে রাখতে ফজরের আযান দিয়ে দিল। সারারাত চোখে ঘুম নেই তবুও নদীতে কয়লা ডুবে যাওয়া থেকে রক্ষা করতে পেরেছি এতেই কিছুটা শান্তি লাগছে।
আমাদের জীবনে চলার পথে কিছু কিছু ঘটনা থাকে যা কখনো ভুলে যাওয়ার নয়। আমার কাছে সেই রাতের ঘটনাটি লোমহর্ষক ছিল। এখনো মাঝেমধ্যেই ঘটনাটি আমার মনে পড়ে। ভাবতে গা শিউরে উঠে যদি তৎক্ষণাৎ কয়লা গুলো সরিয়ে না নিতাম তাহলে হয়তো নদীর পাড় ভেঙ্গে পানিতে পড়ে যেত।
আর কয়লা পানিতে পড়ে গেলে সেখান থেকে উদ্ধার করা একেবারেই অসম্ভব। আজ গভীর রাতে অন্য কিছু লিখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু হঠাৎ করে আমার পুরনো সেই স্মৃতি মনে পড়ে গেল ডুবতে ডুবতে বেঁচে যাওয়া আর কি!!
বন্ধুরা আজ আর লিখছিনা। অন্য কোনদিন অন্যকিছু অভিজ্ঞতা আপনাদের মাঝে শেয়ার করতে চলে আসবো। আজকের জন্য বিদায় নিচ্ছি। সবার জন্য শুভকামনা। আল্লাহ হাফেজ।
- খুব কঠিন একটা সময় চলে গেছে আপনার উপর দিয়ে, আপনি ঠিক বলেছেন, এমন একটি লোমহর্ষক অতীতকে ভোলার মত না। মাঝে মাঝেই আপনাকে সেই ঘটনাটি কড়া নারবে। আমি নিজের আপনার ঘটনাটি পড়তে গিয়ে শিউড়ে উঠছিলাম। যদি কয়লা গুলো পড়ে যেত নদীতে অনেক ক্ষতি হত। আর বুদ্ধিমানের কাজ করেছেন তার আগেই সবগুলো নামিয়ে। আল্লাহ সব সময় সহায় হোন। ভালো থাকবেন আসসালামু আলাইকুম