নজরকাড়া উদ্যোগ || আলপনায় সেজে উঠলো পয়লা বৈশাখ
নমস্কার বন্ধুরা। আমার এবং আমার পরিবারের তরফ থেকে সকলকে জানাই শুভ নববর্ষের শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা। নতুন বছর সকলের ভালো কাটুক। সকলের সুস্থ থাকুন। ভালো থাকুন। সকলের শুভ হোক।
রাতদুপুরে আলপনা মেখে
আজ বৈশাখ মাসের ২ তারিখ। আর আমি আজকে লিখতে চলেছি পহেলা বৈশাখের আগের দিনের একটা দুর্দান্ত কর্মসূচির গল্প। প্রত্যেকবার পহেলা বৈশাখের আগের দিন আমার শহর সেজে ওঠে আলপনায়। এর জন্য আমার শহরের চারুকলা সোসাইটি নিঃস্বার্থভাবে উদ্যোগ নেয় । চারুকলা সোসাইটির হাত ধরেই শহরের নানা প্রান্তে আলপনা দেওয়া হয়।সোসাইটির সাথে যুক্ত ছোট বড় সকলে মিলে এই কাজে লিপ্ত থাকে।
ব্যস্ত সকলে
আমার মনে আছে প্রথম ওদের উদ্যোগ শুরু হয়েছিল কৃষ্ণনগর রেলওয়ে স্টেশন রোডে। ওরা সকলে সারা রাত জেগে সন্ধ্যা থেকে শুরু করে ভোর অব্দি, আলপনা দিয়েছিল। আর তারপরেই এটা সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট হয় এবং সকলে চারুকলা সোসাইটি কে ভীষণ বাহবা দেয়। সাথে ধন্যবাদ জানায় শহরকে এত সুন্দর করে সাজানোর জন্য।
তাই প্রত্যেকবার সেই বছরের পর থেকেই ওরা কৃষ্ণনগরের কিছুটা অংশ বেছে নিয়ে নতুন ভাবে আলপনা দেওয়ার চেষ্টা করে। এর আগের বছর পহেলা বৈশাখের আগের দিন ওরা আমাদের কৃষ্ণনগরের ঐতিহ্যপূর্ণ একটি জায়গা মালোপাড়া অঞ্চলে সমস্ত রাস্তায় আলপনা দিয়েছিল।
ছোটদের নিখুঁত কাজ
এইবারে ওদের ইচ্ছে আমাদের কৃষ্ণনগরের কেন্দ্রবিন্দু। কৃষ্ণনগরের হৃৎপিণ্ড অর্থাৎ ঘূর্ণি পুতুল পট্টিকে সাজিয়ে তুলবে। কৃষ্ণনগর বলতেই আমরা জানি এখানকার মৃৎশিল্পের অস্বাভাবিক খ্যাতির কথা। কৃষ্ণনগরে বহু যুগ ধরে মৃৎশিল্প বংশ পরম্পরায় চলে আসছে। যে পরম্পরার সাথে আমার নিজের পরিবারও যুক্ত। এমনকি দেশ বিদেশে এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় আমার শহর মৃৎশিল্পের শহর নামে বিখ্যাত।
এই শহরের মূল মৃৎশিল্পের ঘাঁটি ঘূর্ণি পুতুল পট্টি এলাকায় এবার চারুকলা সোসাইটি ঠিক করে আলপনা দেবে। ঘূর্ণি পুতুল পট্টি এলাকায় অনেক মাটির পুতুলের এবং মূর্তির দোকান রয়েছে। এর মধ্যে আমাদেরও দুটি মূর্তির শোরুম আছে। স্বাভাবিকভাবেই আমাদের জায়গাকে এত সুন্দর করে তোলার জন্য ওনারা উৎসাহি হলে আমরাও ওনাদের পাশে এসে দাঁড়াই।
আমরা যে কজন রয়েছি এলাকাবাসী, অথবা যাদের এখানে নিজস্ব শোরুম রয়েছে। আমরা সকলে মিলে তাদের সাহায্য করার চিন্তাভাবনা করি। কারণ রাস্তা আটকে সন্ধ্যে থেকে এভাবে আলপনা দেওয়া সহজ কথা নয়। সব থেকে বড় কথা এদের একটা সেফটির ব্যাপার আছে। এদের মধ্যে ছোট থেকে বড় সকলে উপস্থিত। তাই এনাদের সম্পূর্ণ সেফটির দায়িত্ব আমরা এলাকাবাসী নিয়েছিলাম।
আমার বাবা এবং আমার বাবার বন্ধুরা দায়িত্ব সহকারে সন্ধ্যে থেকে ওদের সহযোগিতা করা শুরু করে। ওরা যখন আলপনা দেওয়া শুরু করে তখন থেকেই রাস্তা ঘিরে রাখার ব্যবস্থা করা হয়। সাথে বসার জন্য কিছু চেয়ার ,টেবিল ফ্যান এবং ওদের যাতে কোনরকম শারীরিক সমস্যা না হয় সে কারণে সম্পূর্ণ সাহায্য করার চেষ্টা করা হয়। কারণ ভীষণ গরম পরেছে। সাথে সকলের জন্য সন্ধ্যের টিফিনের ব্যবস্থা করা হয়। আমাদের ঘূর্ণির মৃত শিল্পীরা সকলে সেখানে উপস্থিত থাকে সন্ধ্যে থেকেই।
কিন্তু মানুষ বড়ই জটিল। রাস্তা দিয়ে এত সুন্দর সুন্দর করে আলপনা দিতে দিতে ছোট থেকে বড় সকলে কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছে। এদিকে কিছু মানুষ অন্য রাস্তা দিয়ে যেতে নারাজ। তাদের দাবি তারা এখান দিয়েই যাবে। আমাদের পুতুল পট্টির মোড়েই মহিলা পুলিশ থানা রয়েছে। থানা থেকেও আমাদের সহযোগিতা করা হয় এ কারণে। এত সুন্দর আলপনাগুলোকে নিখুঁতভাবে যারা ক্রমাগত দিয়ে আসছে। স্বাভাবিকভাবেই এই আলপনাগুলো না শুকানো অব্দি এদের যত্ন করতেই হবে। তারপর পয়লা বৈশাখের সকাল থেকে গাড়ি তো চলবেই।
কিন্তু কিছু মানুষ বড্ড জেদি অথবা এতটাই স্বার্থপর যে এগুলো কোনটাই বুঝতে চায় না।
আর গন্ডগোল তখনই হয়। আমি বাড়িতে পড়াশোনা করছিলাম সন্ধ্যাবেলায় ।বেশ কিছুক্ষণ পর বাবা আমাকে ফোন করার পর আমি সাথে সাথে বাড়ি থেকে আলপনা দেখার জন্য পুতুল পট্টির মোড়ে যাই। আমি যেহেতু এই এলাকাতেই থাকি তাই আমার বেশিক্ষণ সময় লাগেনি। হাঁটা পথে দু তিন মিনিট। তারপর সেখানে গিয়ে সকলের এত উদ্যোগ দেখে আমার ভীষণ ভালো লাগলো।
সব থেকে বড় কথা এই আলপনা দেওয়াতে চারুকলা সোসাইটিকে কোনরকম টাকা দিয়ে সাহায্য করা হয় না। কিন্তু তা সত্বেও বৈশাখের আগের দিন এরা যেভাবে উদ্যোগ নিয়ে প্রত্যেকবার শহরের এক এক প্রান্ত সাজিয়ে তোলে, তা সত্যিই মন ছুয়ে যায়। কারণ মানুষ এখন স্বার্থেই বেশি কাজ করে। শহরের প্রতি ভালবাসা কজনের থাকে। আপনি ভাবুন তো ,কি দরকার ওদের এইভাবে সারারাত জেগে সন্ধ্যে থেকে পরিশ্রম করে আলপনা দেওয়ার, রাস্তায় বসে।
সকলের পড়াশোনা রয়েছে ,ব্যস্ততা রয়েছে ,সকলের বাড়ির লোকজন রয়েছে, সকলেই অনেক গুণী। তবুও এই যে শিল্পের প্রতি ভালোবাসা ,কাজের প্রতি ভালোবাসা এবং শহরের প্রতি নিজের কর্তব্য এরা বজায় রাখছে এটা অবশ্যই আমাদের ভাবিয়ে তোলে। আমরা এখান থেকেই শিখতে পারি অনেক কিছু।
গন্ডগোল
আমি যতটা পেরেছি আপনাদের সকলের সাথে প্রত্যেকটি আলপনা নিখুঁতভাবে দেখানোর চেষ্টা করেছি। রাতে খাওয়া দাওয়ার পর রাত পোনে এগারোটা নাগাদ আমি আবার গিয়েছিলাম আলপনা দেখতে। তখন কাজটা অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে। স্বাভাবিকভাবে পহেলা বৈশাখের আগের দিন সন্ধ্যেবেলায় ভীষণ ভিড় থাকে রাস্তায় ।তাই সন্ধে বেলা সকলকে কন্ট্রোল করা ভীষণ সমস্যার হয়ে যাচ্ছিল ।কিন্তু রাত যত বাড়তে থাকে,সাথে সাথে রাস্তায় গাড়ি চলাচল কমে এলে ওদেরও কাজ করতে সুবিধা হয়।।
আমি যাওয়ার সাথে সাথে দেখি ওরা সবাই খাওয়া-দাওয়া করছে। আমার বাবা এবং বাবার বন্ধুরা সকলে ওদের খাওয়ার দেওয়ার পর নিজেরা খেতে বসেছে। ঘূর্ণীর এত নামিদামি শিল্পীরা একসাথে রাস্তায় নেমে যেভাবে শহরের জন্য এবং নিজের এলাকা কে সুন্দর করে সাজিয়ে তুলতে চারুকলা সোসাইটিকে সাহায্য করেছে ,তা দেখে আমিও ভীষণ গর্বিত।
খাবারের ব্যবস্থায় ছিল রুটি, পনিরের তরকারি এবং মিক্সড ভেজ, এবং দু'রকমের মিষ্টি। মোটামুটি ৬০-৭০ জন মানুষ ছিল সমস্ত কাজের সাথে যুক্ত। তাই সেরকম রাতের খাবারের ব্যবস্থাও করা হয়।
খাওয়া দাওয়া শেষ
সকলে পেট ভরে খাবার পর আবার কাজে লেগে পড়ে।
আমি বেশিক্ষণ ছিলাম না ।আমি আর আমার ভাই গিয়েছিলাম। যেহেতু ভাইয়ের পরীক্ষা তাই আমাকে তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে হয়েছিল। কিন্তু আমার বাবা প্রায় অনেকক্ষণ ওদের সাথে ছিল। তারপর রাত- আড়াইটা নাগাদ বাড়ি আসে।
সকালের দিকে যখন পুতুল পট্টিতে যাই ।তখন দেখি কৃষ্ণনগরের কেন্দ্রবিন্দু চকচক করছে। চারুকলার সোসাইটির হাত ধরে কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্পের ঘাঁটি আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। সূর্যের আলোতে সে জায়গার অহংকার যেন ফুটে উঠছে প্রতিটি আলপনায়।
দিদি আপনাকে পহেলা বৈশাখের অনেক অনেক শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। শুভ নববর্ষ। আপনার আগামী বছর আরো হাসিখুশি কাটুক সেই কামনা করছি। আলপোনা সবারই ভালো লাগে। বৈশাখের আগের দিন আপনার শহরে রাস্তায় আলপোনা আঁকার মহুর্ত আমাদের সাথে ভাগ করে নিয়েছেন। সব দেখে দারুন লাগছে। ভালো থাকবেন আপু। ধন্যবাদ এত সুন্দর মহুর্ত আমাদের সাথে ভাগ করে নেয়ার জন্য।
আপনারও নতুন বছর ভালো কাটুক। আপনি সুস্থ থাকুন। ধন্যবাদ