বর্তমান যুগে ইফতারে প্রচলিত খাবার গুলোর ইতিহাস।

in Incredible India2 months ago
islam-7077341_1280.png

Pixabay

তিন বেলা ভাতে অভ্যস্ত বাঙালির খাদ্য তালিকায় বিশেষ করে ইফতারিতে কি করে ছোলা, পেঁয়াজু,চপ, বেগুনি এ জাতীয় খাবারের প্রচলন হলো এটা সত্যিই আলোচনার বিষয়। আমার মায়ের কাছ থেকে গল্প শোনা, যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বাবা যেহেতু আর্মিতে ছিলেন সেখানে রেশন হিসেবে চালের পাশাপাশি আটা দেওয়া শুরু হলো। তাও যেনতেন আটা নয়। ভুষি সহ লাল আটা।

কিন্তু আটা খেতে গিয়ে বিপত্তি বাঁধল। আটার রুটি নিয়ে তখন গ্রামে একটি ছড়া কাটা হয়েছিল। ছড়াটি আমার ভাইদের মুখে শোনা।তবে বেশ মনে আছে। ছড়াটি ছিল এরকম-

"আটার রুটি কলের পানি,
রাত পোহালে টানাটানি।
দেড় মনে বস্তা,
চেয়ারম্যানের নাস্তা।"

তখন আটার চাহিদা একেবারে নেই বললেই চলে। রীতিমত সস্তা আর যারাই আটা খায় তাদেরকে নিয়ে হাসাহাসি হতো। ফলশ্রুতিতে আব্বা আটা বিক্রি করে চাল কিনে আনতো। খুব শখ করে বা গোপনে রুটি বানিয়ে কখনো কখনো খাওয়া হতো।

ai-generated-8573977_1280.png

Pixabay

কিন্তু যুদ্ধ পরবর্তীকালীন দুর্ভিক্ষের সময় এই আটার চাহিদা বেড়ে যায়। তখন মানুষ ধীরে ধীরে ভাতের পাশাপাশি রুটি খেতে অভ্যস্ত হতে শুরু করে। দুর্ভিক্ষ শুধু রুটি খাওয়ানো শেখায়নি এমন অনেক জিনিস খাওয়ানো শিখিয়েছে যা আগে বাঙালিরা খেত না। যেমন- কলার মোচা, ভেতরের বগলি, শাক পাতা ভর্তা,লাউ কুমড়ার চামড়া ভাজি, মরিচ বাটা, পুঁই গোটা এরকম আরো অনেক ধরনের খাবার।

দুর্ভিক্ষে যেহেতু খাদ্যের যোগান কম ছিল তাই মানুষ প্রাপ্ত খাবারের মধ্যেই বিকল্প খুঁজে নিয়ে নতুন নতুন খাবার আবিষ্কার করতে থাকে। তখনকার দিনে ইফতারিতে ভাত, চিড়া,খই, দুধ,কলা,দই, মুড়ি, আমসত্ত্ব-নারিকেল এবং নিতান্তই ভাজা জিনিসের মধ্যে থাকতো ডালের বড়া। তবে এমন ডুবো তেলে ভাজা নয়।কয়লার আগুনে লোহার তাওয়ায় সেঁকা।

IMG_20240318_174341.jpg

তখনকার ইফতারিতে এই খাবারগুলি প্রচলিত ছিল। সাথে ছিল চিনির শরবত। তবে সিজনাল ফল অবশ্যই থাকতো।তাহলে এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন বাঙালির রসনা বিলাসে কি করে এলো এমন ধরনের ইফতারি আইটেম? ছোলা,পেঁয়াজু, বেগুনি, আলুর চপ বিভিন্ন ধরনের শরবত,কাবাব, জিলাপি, বুন্দিয়া, ঘুগনি,বিরিয়ানি,খিচুড়ি, হালিম,ফালুদা জাতীয় খাবার।

চলুন তাহলে একটু পিছনে যাওয়া যাক।
মরক্কোর পর্যটক ইবনে বতুতা দীর্ঘদিন এই বাংলায় ভ্রমণ করেন। তাঁর লেখা বই আল- রিহলাত এ তিনি বাঙালির খাদ্যাভ্যাস, জীবন যাপন, আবহাওয়া,পোশাক,কৃষ্টি-কালচার সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা সহ বিভিন্ন বিষয়ে তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন।

IMG_20240318_174320.jpg

কথিত আছে তিনি সিলেটে থাকাকালীন সময় হযরত শাহজালাল রাদিয়াল্লাহু আনহার সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন। সেখানে তিনি দেখেছেন যে ইফতারিতে হযরত শাহজালাল দুধ পান করতেন। ভোর রাতে যদি কেউ সেহরিতে উঠতে না পারতেন তাহলে ভেজানো চাল খেয়ে রোজা রাখতেন। এবং ইফতার ও শুরু করতেন ভেজানো চাল দিয়ে।

এই উপমহাদেশে ব্রিটিশরা বিভিন্ন সময়ে শাসন চালিয়েছে। ওলন্দাজ, পর্তুগিজ,ডাচ সহ বিভিন্ন দেশের বণিকরা ব্যবসার উদ্দেশ্য এই অঞ্চলে আগমন করেছিলেন। ফলে তারা এই জাতির সাথে মিশে তাদের বিভিন্ন খাদ্যাভ্যাস ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড এই উপমহাদেশে ছড়িয়ে দিয়েছিল।

IMG_20240318_174310.jpg

ছোলা খাওয়ার প্রচলন মূলত আফগানদের থেকে এই বাংলায় এসেছে। তখন আফগানিস্তানের কাবুলিওয়ালারা ঝুলিতে করে কিসমিস, বাদাম, খোবানী, খেজুর, আফগানি ছোলা এগুলো সাথে করে নিয়ে আসতেন। কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশে কাবুলি ছোলার প্রচলন খুব একটা ছিল না। পরবর্তীতে কাবলি ছোলার মতো দেখতেই ছোলা বুট কে বিভিন্ন মসলা দিয়ে রান্না করে খাওয়ার প্রচলন শুরু হয়। এটি দীর্ঘ সময় পেট ভরিয়ে রাখত এবং খেতে অত্যন্ত সুস্বাদু হওয়ার কারণে পরবর্তীতে এটি হয়ে উঠেছিল ইফতারের প্রধান খাবার।

পেঁয়াজু, বেগুনি,চপ এগুলো শুরু থেকেই উত্তর ভারতীয় খাবার ছিল। যা বাঙালিরা সানন্দে গ্রহণ করেছে। আর মুড়ি বাঙ্গালীদের অত্যন্ত প্রিয় খাবার হিসেবে পূর্বেই বিরাজমান ছিল।
তবে কাবাব ও হালিম এগুলো মূলত ইরান দেশের খাবার। এছাড়া জিলাপিও এসেছে পারস্য থেকে।তবে জিলাপিকে এই উপমহাদেশে প্রচলিত করেছে মুঘল সম্রাটরা।

meat-7122293_1280.jpg

Pixabay

বর্তমানে বিরিয়ানি ইফতারে চালু হয়েছে ।এই বিরিয়ানি মূলত মুঘলদের আবিষ্কার। বলা যায় মুঘলদের কাছ থেকে ছড়িয়ে পড়া খাবারগুলোই বর্তমানে আমাদের দেশে ইফতারিতে প্রচলিত খাবার। আর অনেকের প্রিয় ঘুগনি মূলত পাকিস্তান আমলে শসা ও লেবু দিয়ে বানানো একটি জনপ্রিয় আইটেম ছিল। এছাড়াও মুঘলরা মাংস,গম, মসলা, লেবুর রস দিয়ে ঘুটে যে খাবারটি প্রচলন করেছিল তার নাম হলো হালিম।আর রাসূল(স) ইফতারে খেজুর ও পানি দিয়ে রোজা ভাঙতেন।তাই ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা সুন্নত হিসেবে এটিকে গ্রহণ করেছে।

অনেকেই জানেন না বর্তমান চকবাজারের আদি নাম বাদশাহী বাজার। ১৮০০ শতকের দিকে মুর্শিদকুলি খাঁ এই চকবাজারকে জনপ্রিয় বাজার হিসেবে গড়ে তোলেন। এখানে বিভিন্ন ধরনের কাবাব সহ জনপ্রিয় সব খাবার পাওয়া যেত। একটি জিলাপির ওজন এক থেকে দেড় কেজি হবে এটা শুধু চকবাজারই শুরু করেছিল।আমি এখনো চক বাজারে গেলে সুতা কাবাব বা পসন্দা কাবাব অবশ্যই কিনে আনি। কারণ এটি চকবাজার ছাড়া আমার জানা মতে বাংলাদেশের আর কোথাও পাওয়া যায় না।

sekerpare-5087996_1280.jpg

Pixabay

এজন্যই বলা হয় যে, চকবাজারের ইফতার ৪০০ বছরের ঐতিহ্য। সত্যিই এখনো চক বাজারে গেলে মন ভরে যায়।তবে যাই হোক না কেন বর্তমান যুগের পেঁপেনি, কুমড়ানি কোথা থেকে এসেছে তা আমরা কমবেশি সবাই জানি। সেটা নিয়ে আর আলোচনা আজ নাইবা করলাম। আজকের মত লেখা এখানেই শেষ করছি।আমার লেখা ব্লগটি আপনাদের কেমন লেগেছে তা জানাতে ভুলবেন না।

DeviceName
Androidvivo v19
Cameratriple camera 48mp+8mp
LocationBangladesh 🇧🇩
Shot by@hasnahena

DiHLrjiPetHt6ciV9azim9NPHuTMQ59H51nYE8xqo83cHwKoMWBRmLojbYwVzV9tQHbQbS38qpoDVF7h1MKDoicCr8iqdBXbBpeXUAhSRs...v2uoYJLLGNKHUduDD6QojicEZMKyFqVqBMZbqeFstcERLXyHRx3F9DTnEwa2aLuKJt3RPuhi1j4YJwfM92kheG2sV3FFD2kYtYaQETCN5Y2txGb7x7NKKhqT3C.png

◦•●◉✿ধন্যবাদ সবাইকে লেখাটি পড়ার জন্য।✿◉●•◦

◦•●◉✿ Thank You For Reading ✿◉●•◦

Sort:  
Loading...
 2 months ago 

সত্যি কথা বলতে এই ইতিহাস সম্পর্কে আমার কোন কিছুই জানা ছিল না। তবে আজকে আপনার পোস্ট পরিদর্শন করতে গিয়ে, ইফতার সম্পর্কে ইতিহাস জানতে পেরে বেশ ভালই লাগলো।

আগেকার মানুষের ইফতার এবং এখনকার বর্তমান সময়ের মানুষের ইফতারের মধ্যে অনেকটা তফাৎ রয়েছে। যেটা আপনি আজকে আমাদের সাথে তুলে ধরেছেন এবং কোন জায়গা থেকে খাবার গুলোর উৎপত্তি হয়েছে। সেটাও শেয়ার করেছেন। ধন্যবাদ চমৎকার বিষয় নিয়ে আলোচনা করার জন্য। ভালো থাকবেন।

TEAM 5

Congratulations! Your post has been upvoted through steemcurator08.

Curated by : @sduttaskitchen
 2 months ago 

ইফতারের খাবার গুলো দেখে খুবই ভালো লাগলো কিন্তু বর্তমান সময়ে আমাদের এই দিকে ইফতারের প্রচলিত খাবার বলতে গেলে বুট বুলদিয়া মুড়ি নানা ধরনের চপ শরবত ইত্যাদি ৷

ধন্যবাদ আপনাকে এত সুন্দর একটি পোস্ট আমাদের মাঝে তুলে ধরার জন্য ভালো থাকবেন সুস্থ থাকবেন ৷

Posted using SteemPro Mobile

 2 months ago 

আমি আমার দাদার মুখে যুদ্ধের সময়ের অনেক ইতিহাস শুনেছি তার মধ্যে একটি হলো খাবার।। আর ওই সময়ে রুটি টাই খাওয়া বেশি হত কারণ চাউল সবাই কিনতে পারতো না বা খেতে পারতো না।। আর হ্যাঁ কবিতাটা খুবই বাস্তব আর খুবি ভালো লেগেছে। ধন্যবাদ এত সুন্দর একটি পোস্ট আমাদের উপহার দেওয়ার জন্য।।

 2 months ago 

ইফতারি সম্পর্কে নিয়ে লেখা টা খুব ভালো লেগেছে। আপনি একদম ঠিক বলেছেন চকবাজারের ঐতিহ্যবাহী ইফতারি বাজার গেলে মনে হয় অন্যরকম একটা ইফতারি কেনার আমেজ।
আর সেখানে কয়েকটা খাবার সেই ৪০০ বছরের পুরনো এখন টিকে আছে। আর খাবারের নামগুলো আমার কাছে ভালো লাগে, ধন্যবাদ খুব সুন্দর একটি পোস্ট করার জন্য।

 2 months ago 

আপনার পোস্ট পড়ে আসলে অনেক কিছু জানার বিষয় ছিল। সেগুলো পড়ে কিছুটা হলে অভিজ্ঞতা নিতে পারলাম। এই ইফতারি নিয়ে যুদ্ধের আগে এবং যুদ্ধের পরে কি অবস্থা সেটা নিয়ে খুব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য শেয়ার করেছেন।

Coin Marketplace

STEEM 0.27
TRX 0.13
JST 0.032
BTC 64802.57
ETH 2975.30
USDT 1.00
SBD 3.69