উপমহাদেশে ইসলামের আবির্ভাব ও বাংলায় স্বাধীন সুলতানি শাসন
বাঙ্গালী জাতি বা বাঙালি জাতি দক্ষিণ এশিয়ার বিশেষ একটি ইন্দো-আর্য জাতিগোষ্ঠীর নাম। স্থানীয় জনসংখ্যা স্বাধীন বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, বরাক উপত্যকা এবং নিম্ন আসাম ও মণিপুরের কিছু অংশের মধ্যে বিভক্ত। তাদের অধিকাংশই বাংলায় কথা বলে, যা ইন্দো- ইরানী ভাষাসমূহের বিশেষ একটি ভাষা।
জাতিগতভাবে বাঙালি একটি সংকর জাতি। প্রায় পাঁচ হাজার বছর পূর্বে ইন্দোচীন থেকে আসাম হয়ে বাংলায় প্রবেশ করে অস্ট্রিক জাতি। তারা নেগ্রিটোদের উচ্ছেদ করে। অস্ট্রিক জাতির সময়ে দ্রাবিড় জাতি এদেশে আসে এবং সভ্যতায় উন্নত বলে তারা অস্ট্রিক জাতিকে গ্রাস করে। অস্ট্রিক দ্রাবিড় জাতির সাথে মঙ্গোলীয় বা ভোটচীনীয় জাতির সংমিশ্রণ ঘটে।
অস্ট্রিক দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীর মিশ্রণে যে জাতির প্রবাহ চলছিল, তার সাথে আর্য জাতি এসে যুক্ত হয়ে গড়ে তুলেছে বাঙালি জাতি।
সমগ্র বাঙালি জনগোষ্ঠীকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথা:
(ক) প্রাক-আর্য/অনার্য জনগোষ্ঠী (খ) আর্য জনগোষ্ঠী
প্রাক আর্যদের চারটি শাখায় ভাগ করা হয়েছে। যথা:
(১) নেগ্রিটো (২) অস্ট্রিক (৩) দ্রাবিড় (৪) ভোটচীনীয়
১. নেগ্রিটো: নেগ্রিটোরা এদেশের প্রাচীন জনগোষ্ঠী। সাঁওতাল, হাড়ি, চণ্ডাল, ডোমদেরকে এদের উত্তরসূরি ধরে নেওয়া হয়। সুন্দরবন অঞ্চল, যশোর ও ময়মনসিংহ জেলায় নেগ্রিটো জনগোষ্ঠীর প্রভাব লক্ষ করা যায়।
২. অস্ট্রিক: নৃতাত্ত্বিকদের মতে অস্ট্রেলিয়া ও ইন্দোনেশিয়া থেকে আসাম হয়ে বাংলায় প্রবেশ করে অস্ট্রিক জাতি। তারা নেগ্রিটোদের উৎখাত করে। তাই বলা হয়ে থাকে বাঙালি জাতির প্রধান অংশ গড়ে উঠেছে অস্ট্রিক জাতি থেকে এবং তাদেরকে ‘নিষাদ জাতি’ বলা হয়। আর্যপূর্ব জনগোষ্ঠীর ভাষা ছিল অস্ট্রিক।
৩. দ্রাবিড়: অস্ট্রিক জাতির সময়েই এরা দক্ষিণ ভারত থেকে বাংলায় অনুপ্রবেশ করে। সভ্যতার বিচারে এরা অস্ট্রিক জাতির থেকে উন্নত। তাই অস্ট্রিক জাতিকে ধীরে ধীরে গ্রাস করে ফেলে।
৪. ভোটচীনীয়: এদের মঙ্গোলীয় জাতি বলা হয়। চীন ও তিব্বত থেকে আগত এ জাতির সাথে অস্ট্রিক ও দ্রাবিড় জাতির সংমিশ্রণ ঘটে। বর্তমানে গারো, ত্রিপুরা, চাকমা, কোচ ইত্যাদি ভোটচীনীয়/মঙ্গোলীয় জাতি গোষ্ঠীর পূর্বপুরুষ ।
(খ) আর্য জাতি
ভারতবর্ষে আর্যদের আগমন ঘটে খ্রিষ্টপূর্ব ১৪০০ বা ১৫০০ অব্দে। আর্যদের আদিনিবাস ছিল ইউরাল পর্বতের দক্ষিণে বর্তমানে মধ্য এশিয়ার ইরানে। আর্যরা সর্বপ্রথম বসতি স্থাপন করে সিন্ধু বিধৌত অঞ্চলে। সনাতন ধর্মাবলম্বী হিসাবে পরিচিত আর্যদের ধর্মগ্রন্থ ছিল বেদ। এভাবেই অস্ট্রিক, দ্রাবিড় ও ভোটচীনীয়দের সাথে আর্য জাতির সংমিশ্রণে ও পরবর্তীতে মধ্যপ্রাচ্য হতে আগত আরব ও ইউরোপের বিভিন্ন জাতির সংমিশ্রণে গড়ে ওঠেছে বাঙালি জাতি। তাই বাঙালি জাতিদের সংকর জাতি বলা হয়। বাংলা ভাষাতেও বিভিন্ন ভাষার প্রভাব লক্ষ করা যায়।
উপমহাদেশে ইসলামের আবির্ভাব
উমাইয়া খলিফা ওয়ালিদ বিন আব্দুল মালিকের রাজত্বকালে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশসমূহের শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। তিনি ৭১২ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসিমকে সিন্ধু রাজা দাহিরের বিরুদ্ধে অভিযানে প্রেরণ করেন। যুদ্ধে দাহির শোচনীয়ভাবে পরাজিত এবং নিহত হন। মোহাম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু বিজয়ের ফলে উপমহাদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। মোহাম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু বিজয়ের প্রায় ৩০০ বছর পর গজনীর সুলতান মাহমুদ ১০০০–১০২৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত উপমহাদেশের পশ্চিমাঞ্চলে ১৭ বার অভিযান পরিচালনা করেন।
ভারতে মুসলিম শাসনের সূচনা
ময়েজউদ্দিন মুহম্মদ বিন সাম ইতিহাসে শিহাবউদ্দিন মুহম্মদ ঘুরী নামে পরিচিত। গজনীতে ঘুরী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হলে মুহম্মদ ঘুরী উপমহাদেশে তাঁর সাম্রাজ্য বিস্তারে মনোনিবেশ করেন। তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধের পর মুহম্মদ ঘুরী উত্তর উপমহাদেশের শাসনভার তাঁর সুযোগ্য সেনাপতি কুতুবউদ্দিনের উপর ন্যস্ত করে গজনী প্রত্যাবর্তন করেন।
যুদ্ধের নাম | তরাইনের যুদ্ধ | |
---|---|---|
প্রথম | দ্বিতীয় | |
প্রতিপক্ষ | মুহম্মদ ঘুরী | ও পৃথ্বীরাজ চৌহান |
সময়কাল | ১১৯১ খ্রি. | ১১৯২ খ্রি. |
ফলাফল | মুহম্মদ ঘুরী শোচনীয়ভাবে পরাজিত ও আহত হয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। | পৃথ্বীরাজ চৌহান পরাজিত ও নিহত হন এবং মুসলিম সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। |
বাংলায় মুসলিম শাসনের সূচনা
তুর্কি বীর ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি ১২০৪ সালে বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি বাংলার শেষ স্বাধীন রাজা লক্ষ্মণ সেনকে পরাজিত করেন। তিনি বাংলার রাজধানী লক্ষণাবতীতে (গৌড়ে) স্থাপন করেন। বাংলায় মুসলিম শাসনের প্রাথমিক পর্যায় ছিল ১২০৪ সাল থেকে ১৩৩৮ সাল পর্যন্ত। তুর্কি আমলে অনেক শাসনকর্তাই দিল্লির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে স্বাধীন হতে চেয়েছিলেন। তবে এদের বিদ্রোহ শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। ঘন ঘন বিদ্রোহ সংঘটিত হওয়ার জন্য দিল্লির ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দিন বারানী বাংলার নাম দিয়েছিলেন ‘বুলগাকপুর’ বা ‘বিদ্রোহের নগরী’। গৌড় বা লখনৌতি বিজয়ের দুই বছর পর বখতিয়ার খলজি তিব্বত অভিযানে বের হন। এ তিব্বত অভিযানই ছিল তাঁর জীবনের শেষ সমর অভিযান। কিন্তু তাঁর এ অভিযান ব্যর্থ হলে তিনি দেবকোটে ফিরে আসেন। তুর্কি এই বীর ১২০৬ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুর মুখে পতিত হন।
তবে অনুমান করা হয় আলি মর্দান নামে একজন আমির তাকে হত্যা করেছিল।
দিল্লি সালতানাত (১২০৬–১৫২৬)
সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবেক (১২০৬–১২১০ খ্রি.)
প্রথম জীবনে সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবেক ছিলেন মুহম্মদ ঘুরীর একজন কৃতদাস। পরবর্তীতে তিনি মুহম্মদ ঘুরীর সেনাপতি নিযুক্ত হন। উত্তর ভারতে রাজ্য বিস্তার করে দিল্লিতে তার রাজধানী স্থাপন করেন। তিনি ছিলেন উপমহাদেশের স্থায়ী মুসলিম শাসনের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি দিল্লি সালতানাতের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম স্বাধীন সুলতান। দিল্লির কুতুব মিনার তাঁর বিখ্যাত স্থাপনা। তার দানশীলতার জন্য তাকে ‘লাখবখশ’ বলা হয়। তিনি ১২২১ সালে মৃত্যুবরণ করেন।
সুলতান শামসউদ্দিন ইলতুৎমিশ (১২১১–১২৩৬ খ্রি.)
সুলতান শামসউদ্দিন ইলতুৎমিশ ছিলেন কুতুবউদ্দিন আইবেকের জামাতা। তিনি দিল্লি সালতানাতের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা। তিনি কুতুব মিনারের নির্মাণ কাজ শেষ করেন। ভারতে মুসলমান শাসকদের মধ্যে তিনিই প্রথম মুদ্রা প্রচলন করেন। ইলতুৎমিশ ১২২৯ খ্রি. বাগদাদের খলিফা আল মুনতাসির বিল্লাহ কর্তৃক ‘সুলতান–ই–আজম’ উপাধিতে ভূষিত হন। সুলতান শামসউদ্দিন ইলতুৎমিশ চল্লিশজন তুর্কি ক্রীতদাসদের নিয়ে একটি দল গঠন করেন যা ইতিহাসে ‘বন্দেগান–ই–চেহেলগান' বা চল্লিশ চক্র নামে পরিচিত।
সুলতানা রাজিয়া (১২৩৬–১২৪০)
সুলতানা রাজিয়া ছিলেন শামসউদ্দিন ইলতুৎমিশের কন্যা। তিনি ছিলেন দিল্লির সিংহাসনে আরোহণকারী প্রথম মুসলিম নারী।
সুলতান নাসির উদ্দিন মাহমুদ (১২৪৬–১২৬৬)
তিনি বাংলার প্রথম তুর্কি শাসনকর্তা ছিলেন। সরল ও অনাড়ম্বর জীবনযাপনের জন্য ফকির বাদশাহ নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি কোরআন অনুলিপি ও টুপি সেলাই করে জীবিকা নির্বাহ করতেন।
সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবন (১২৬৬–১২৮৭)
সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবনকে বলা হয় মহান শাসক। বিচ্ছিন্নতাবাদ নির্মূল ও শান্তি শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সুলতান অত্যন্ত কঠোর ও নির্ণয় নীতি গ্রহণ করেন। তাঁর এ নীতি রক্তপাত ও কঠোর নীতি (Blood and Iron Policy) নামে খ্যাত। তিনি বিদ্যোৎসাহী ও গুণীজনের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। ‘ভারতের তোতা পাখি’ (বুলবুল-ই-হিন্দ) নামে পরিচিত আমীর খসরু বলবনের দরবার অলংকৃত করেন।
খিলজি বংশ (১২৯০–১৩২০)
১২৯০ খ্রিষ্টাব্দে দিল্লীর প্রাথমিক তুর্কি সালতানাতের অবসান ঘটে। এরপর শুরু হয় খিলজি বংশের শাসন। খিলজিগণ ভারতে আসার আগে দীর্ঘদিন আফগানিস্তানে বসবাস করে। প্রকৃতপক্ষে তারা ছিলেন তুর্কি। জালালউদ্দীন ফিরোজ খিলজি ছিলেন এই বংশের প্রথম সুলতান। তিনি ছিলেন দুর্বল প্রকৃতির শাসক। তাঁকে হত্যা করে তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র ও জামাতা আলাউদ্দীন খিলজি সুলতান হন। তিনি ছিলেন খুবই মেধাবী ও শক্তিশালী শাসক। রাজ্য বিস্তার, সাম্রাজ্যে সুশাসন প্রবর্তন, মূল্য নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, স্থাপত্য শিল্পের বিকাশ ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রেই আলাউদ্দীন তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের স্বাক্ষর রাখেন । খিলজি বংশ মোট ত্রিশ বছর শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল। আলাউদ্দীন খিলজির মৃত্যুর পর তাঁর উত্তরাধিকারীগণ তাঁর রেখে যাওয়া বিশাল সাম্রাজ্য কিংবা শাসন ব্যবস্থা কোনটাই ধরে রাখতে পারেননি। ফলে আমীরগণ আবার শক্তিশালী হয়ে ওঠেন।
আলাউদ্দিন খিলজি (১২৯৬–১৩১৬ খ্রি.)
আলাউদ্দিন খিলজি প্রথম মুসলমান শাসক হিসেবে দক্ষিণাত্য জয় করেন। দাক্ষিণাত্য অভিযানে নেতৃত্ব দেন সুলতানের সেনাপতি মালিক কাফুর। তিনি দক্ষিণ – ভারতের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত মুসলিম বিজয় পতাকা উড্ডীন করেন। সুলতান জনগণের সার্বিক কল্যাণের জন্য দ্রব্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণের উপর হস্তক্ষেপ করেন এবং প্রতিটি দ্রব্যের মূল্য নির্দিষ্ট হারে বেধে দেন। আলাউদ্দিন খিলজির পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দিন বারানী, কবি হোসেন দেহলবী, কবি আমির খসরু । ইবনে বতুতার মতে, তিনি ছিলেন দিল্লির শ্রেষ্ঠ শাসক। সুলতান ফ্রান্সের রাজা চতুর্দশ লুই এর ন্যায় ঘোষণা করেন, “আমিই রাষ্ট্র”। আলাই দরওয়াজা (বাংলা: আলাউদ্দিনের দরজা) তার কীর্তি।
তুঘলক বংশ (১৩২০-১৪১৪)
১৩১৬ খ্রিষ্টাব্দে সুলতান আলাউদ্দীন খিলজির মৃত্যুর পর মাত্র চার বছরের মধ্যে খিলজি বংশের অবসান ঘটে। এই বংশের শেষ সুলতান কুতুবউদ্দীন মুবারককে হত্যা করে খসরু মালিক নামক একজন আমীর ক্ষমতা দখল করেন। জন্মসূত্রে তিনি নিম্নবর্ণের হিন্দু। সিংহাসনে বসার পরও তিনি নীচ— স্বভাব ও মনোবৃত্তি ত্যাগ করতে পারেন নি। অল্পদিনের মধ্যেই তিনি অপ্রিয় হয়ে পড়েন। তাঁর অত্যাচার থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য আমীরণণ ঐক্যবদ্ধ হন। পাঞ্জাবের শাসনকর্তা গাজী মালিক এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। যুদ্ধে খসরু মালিক পরাজিত ও নিহত হন। আমীরদের বিশেষ অনুরোধে গাজী মালিক সিংহাসনে বসতে রাজী হন। সিংহাসনে বসার সময় তিনি গিয়াসউদ্দীন তুঘলক উপাধি গ্রহণ করেন। এভাবে তুঘলক বংশের প্রতিষ্ঠা হয়। গিয়াসউদ্দীন তুঘলক, মুহম্মদ বিন তুঘলক এবং ফিরোজশাহ তুঘলক এই বংশের তিনজন বিখ্যাত সুলতান। তুঘলক আমলে স্থাপত্যশিল্পের যথেষ্ট উন্নতি ঘটে। এ যুগে ইতিহাস, দর্শন, জ্যোতির্বিদ্যা, ভ্রমণকাহিনি প্রভৃতি জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় বহু গ্রন্থ রচিত হয় ।
মুহম্মদ বিন তুঘলক (১৩২৫-১৩৫১)
মুহম্মদ বিন তুঘলক এর প্রকৃত নাম জুনা খাঁ। রাজ্য শাসনের প্রত্যক্ষ অসুবিধা দূর করার জন্য কেন্দ্রীয় রাজধানী দিল্লি থেকে দেবগিরিতে স্থানান্তর করেন। তিনি দেবগিরির নতুন নাম করেন দৌলতাবাদ। তার সময়ে ইবনে বতুতা দিল্লিতে আসেন। তিনি ইবনে বতুতাকে প্রথমে দিল্লীর কাজী এবং পরবর্তীতে চীনের রাষ্ট্রদূত করেন। তিনি সোনা ও রূপার মুদ্রার পরিবর্তে প্রতীকী তামার মুদ্রা প্রচলন করে মুদ্রামান নির্ধারণ করে দেন। মুহম্মাদ বিন তুঘলক কৃষির উন্নয়নের জন্য 'দিওয়ান-ই-কোহী’ নামে স্বতন্ত্র কৃষি বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন।
লোদী রাজবংশ (১৪৫১–১৫২৬ খ্রি.)
লোদী রাজবংশ সূচনা করেন বাহলুল খান লোদী। দিল্লির লোদী বংশের সর্বশেষ সুলতান ছিলেন ইব্রাহীম লোদী। দিল্লির সালতানাতের পতন ঘটে ইব্রাহীম লোদী বাবরের কাছে পরাজয়ের মাধ্যমে।
বাংলায় স্বাধীন সুলতানি শাসন (১৩৩৮-১৫৩৮ খ্রি.)
বাংলায় মুসলিম শাসনের সূচনা হয় বখতিয়ার খিলজির সামরিক অভিযানের মধ্য দিয়ে। ১২০৪ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৩৩৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সময়ে এদেশ যাঁরা শাসন করেছেন তাঁরা সকলেই পুরোপুরি স্বাধীন ছিলেন না। তাঁদের কেউ কেউ বখতিয়ার খিলজির সহযোদ্ধা হিসেবে বাংলা অভিযানে অংশ গ্রহণ করেছিলেন। আবার কেউ কেউ তুর্কি বংশোদ্ভূত এবং বলবনী বংশের সুলতান ছিলেন। এ সকল শাসক দিল্লির সুলতানদের দ্বারা নিয়োগ প্রাপ্ত হতেন। তাঁদের অনেকেই স্বাধীনতার জন্য দিল্লির সুলতানদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। তবে তাঁদের বিদ্রোহ সফল হয়নি। দিল্লির সুলতানরা কঠোর হস্তে তাদের দমন করেন। ১৩৩৮ খ্রিষ্টাব্দে সোনারগাঁও-এর ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ বাংলায় স্বাধীন সুলতানী যুগের সূচনা করেন।
তখন থেকে ১৫৩৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় দু'শ বছর ধরে বাংলা অবিচ্ছিন্নভাবে স্বাধীনতা ভোগ করেছিল। এত দীর্ঘ দিন ধরে বাংলার স্বাধীনতা আর কোন সময় স্থায়ী হয়নি। এই স্বাধীন যুগে ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ, ইলিয়াস শাহী বংশ, হাবশী শাসন ও হোসেন শাহী বংশের শাসনামল ছিল। দু'শ বছরের এ স্বাধীন যুগটি ছিল বাংলার গৌরবময় যুগ। এ সময় বাংলার সুলতানগণ নিজেদের যোগ্যতা, শক্তি ও ঐশ্বর্য দিয়ে ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ নৃপতিদের পাশে স্থান করে নিয়েছিলেন। তাঁরা বাংলায় সুশাসন প্রতিষ্ঠা, শিক্ষা-সংস্কৃতির উৎকর্ষ সাধন, জনকল্যাণকামী কর্মকাণ্ডে অংশ গ্রহণ করেছেন। তাঁরা রাজকীয় কর্তব্য পালনেও অপরিসীম দক্ষতা দেখিয়েছেন। এর ফলে তাঁরা বাংলার জনগণের আস্থা ও অকৃত্রিম ভালোবাসা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ (১৩৩৮-১৩৪৯)
ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ ছিলেন বাংলার প্রথম স্বাধীন সুলতান। তিনি সোনারগাঁওয়ের শাসন ক্ষমতা দখল করে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহ (১৩৪২-১৩৫৮)
তিনি ১৩৫২ সালে পুরো বাংলা অধিকার করেন। তাঁর রাজত্বকালে বাঙালিরা সর্বপ্রথম একটি জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। দিল্লির ঐতিহাসিক শামস-ই-সিরাজ আফীফ ইলিয়াস শাহকে 'শাহ-ই-বাঙ্গালাহ’ বা ‘শাহ-ই-বাঙ্গালিয়ান’ বলে উল্লেখ করেন। ‘বাঙ্গালাহ’ নামটি তাঁর সময় থেকেই শুরু হয়। ইলিয়াস শাহ বাংলার রাজধানী গৌড় থেকে পান্ডুয়া নগরীতে স্থানান্তর করেন।
গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ (১৩৯১– ১৪১১)
গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ অত্যন্ত সাহিত্যানুরাগী ছিলেন। পারস্যের কবি হাফিজের সাথে তাঁর পত্রালাপ হতো। একবার তিনি কবি হাফিজকে বাংলাদেশে আসার দাওয়াত জানালে প্রত্যুত্তরে কবি হাফিজ একটি সুন্দর কবিতা লিখে পাঠিয়ে দেন। তার সময়ে শাহ মুহাম্মদ সগীর ‘ইউসুফ জুলেখা' রচনা করেন; কৃত্তিবাস ওঝা 'রামায়ণ' বাংলায় অনুবাদ করেন।
জালালউদ্দীন মুহম্মদ শাহ (১৪১৫ – ১৪১৬ এবং ১৪১৮–১৪৩১)
জালালউদ্দীন মুহম্মদ শাহ ছিলেন রাজা গণেশের পুত্র। তিনি 'খলিফাতুল্লাহ' উপাধি গ্রহণ করেছিলেন।
আলাউদ্দিন হুসেন শাহ (১৪৯৩-১৫১৯ খ্রি.)
আলাউদ্দিন হুসেন শাহ ছিলেন বাংলার স্বাধীন সুলতানদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। এ সময় বাংলার রাজধানী ছিল গৌড়। আলাউদ্দীন হোসেন শাহ তাঁর রাজধানী গৌড় হতে একডালাতে স্থানান্তর করেন। তাঁর শাসনকালে বঙ্গে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্পকলার অভাবিত উন্নতি সাধিত হয়েছিল। এজন্য তার শাসনকালকে বঙ্গের মুসলমান শাসনের ইতিহাসে স্বর্ণযুগ বলা হয়। ১৪৯৮ খ্রিষ্টাব্দে হুসেন শাহ কামতা রাজ্যে অভিযান শুরু করেন। তিনি কামরূপের সেন রাজবংশকে উৎখাত করে কামরূপ কামতাকে বাংলা রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতি উদারতার জন্য সমকালীন কবি বিজয়গুপ্ত আলাউদ্দিন হুসেন শাহকে নৃপতি তিলক, জগৎ ভূষণ ও কৃষ্ণ-অবতার বলে উল্লেখ করেন। আলাউদ্দিন হুসেন শাহের রাজত্বকালে শ্রীচৈতন্যদেব হিন্দু সমাজে প্রচলিত সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে নদীয়ায় বৈষ্ণব আন্দোলন গড়ে তোলেন এবং বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার করেন। বৈষ্ণব ভক্তি আন্দোলনের সন্তধারার প্রধান ব্যক্তিত্বদের অন্যতম ছিলেন মীরাবাঈ। আলাউদ্দিন হুসেন শাহ তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলায় মহাভারত রচনা করেন কবীন্দ্র পরমেশ্বর ও শ্রীকর নন্দী। বাংলা সহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতার জন্য আলাউদ্দিন হুসেন শাহকে বিখ্যাত শাসক বলা হয়। তাঁর উপাধিসমূহ ছিল ১. বাংলার আকবর ২. নৃপতি তিলক ৩. জগৎ ভূষণ ৪. কৃষ্ণবতার। গৌড়ের ছোট সোনা মসজিদ ও সুমতিদ্বার আলাউদ্দিন হুসেন শাহ এর দুটি বিখ্যাত কীর্তি।
নাসিরউদ্দিন নুসরাত শাহ (১৫১৯-১৫৩২)
নাসিরউদ্দিন নুসরাত শাহ এর অমরকীর্তি গৌড়ের বড় সোনা মসজিদ (বারদুয়ারি মসজিদ) এবং কদম রসুল ভবন। তিনি প্রজাদের পানির কষ্ট দূর করার জন্য রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে কূপ ও পুকুর খনন করেন। বাগেরহাটের ‘মিঠা পুকুর’ তাঁর অনন্য কীর্তি।
গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহ (১৫৩৩- ১৫৩৮ খ্রি.)
গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহ ছিলেন বাংলার শেষ স্বাধীন সুলতান। তাঁর শাসনামলে শেরশাহ এর গৌড় দখল করার মাধ্যমে বাংলায় স্বাধীন সুলতানি যুগের অবসান হয়।