ভারতবর্ষে মুঘল সাম্রাজ্যের সমাপ্তি

in Bulls Mind2 years ago

সেলিম নুর উদ্দিন মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর (১৬০৫–১৬২৭)

সমগ্র বাংলা বিজয়ী প্রথম মুঘল সম্রাট। তার বিশতম ও সর্বাপেক্ষা প্রিয় স্ত্রী নূরজাহান (প্রকৃত নাম মেহেরুন্নেসা) । তিনিই প্রথম ও একমাত্র সম্রাজ্ঞী যার নাম রৌপমুদ্রায় অঙ্কন করা হয়। জাহাঙ্গীর বাংলাকে নিজ শাসনাধীনে আনতে ইসলাম খান চিশতীকে সুবেদার হিসেবে নিয়োগ দেন। ১৬০৮ সালে সম্রাট জাহাঙ্গীর এর ফরমান বলে ইংরেজরা সুরাটে প্রথম বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে। তিনি ১৬১০ সালে রাজধানী ঢাকায় আনেন ও নাম দেন ‘জাহাঙ্গীরনগর’আগ্রার দুর্গ নির্মাণ করেন সম্রাট জাহাঙ্গির। তার রাজত্বকালেই ইংরেজরা ভারতে আগমন করেন। ১৬১২ সালে ইসলাম খান বাংলার বারোভূঁইয়াদের দমন করে পুরো বাংলায় মুঘল শাসন কায়েম করেন। জাহাঙ্গীর এর লিখিত আত্মজীবনীর নাম ‘তুজুক–ই–জাহাঙ্গীর’


800px-Corona_Prusia-mj2.jpg

শাহজাহান ওরফে খুররম (১৬২৮–১৬৫৮)

শাহজাহানের শাসনের সময় মুঘল সাম্রাজ্যশিল্প ও স্থাপত্যের দিক দিয়ে ব্যাপক সমৃদ্ধি লাভ করে। ময়ূর সিংহাসন, সালিমার উদ্যান, দিল্লীর জামে মসজিদ, লালকেল্লা, দিল্লীর রাজকেল্লা, শালিমার বাগান, জাহাঙ্গীরের মাজার, মোতি মসজিদ, শীষ মহল, দেওয়ান–ই–আম, দেওয়ান–ই–বাস তারই অসামান্য কীর্তি। এজন্য তাকে Prince of Builders বলা হয়। বিশ্ববিখ্যাত কোহিনূর হীরা তার মুকুটে শোভাবর্ধন করতো। অনেক স্ত্রীর মধ্যে মমতাজকে অধিক ভালোবাসেন। মমতাজের গর্ভে জন্ম নেওয়া চার পুত্র সন্তানের নাম যথাক্রমে-

পুত্র সন্তানের নামতথ্য
দারাএলাহাবাদ ও লাহোরের শাসনকর্তা ছিলেন।
শাহ সুজাবাংলা শাসনে নিযুক্ত ছিলেন।
আওরঙ্গজেবদক্ষিণ ভারতের শাসক ছিলেন।
মুরাদগুজরাট, মালদয়ের শাসনকার্যে নিয়োজিত ছিলেন।

১৬৩১ খ্রিষ্টাব্দে মমতাজ মৃত্যুবরণ করলে শোকাহত সম্রাট পত্নীপ্রেমকে অমর করতে নির্মাণ করেন তাজমহল

শাহজাহানের নির্মাণশৈলী

তাজমহল: স্ত্রী মমতাজের স্মৃতি রক্ষার্থে ভারতের উত্তর প্রদেশের আগ্রায় যমুনা নদীর তীরে ৪২ একর স্থান জুড়ে মমতাজ মহল তৈরি করা হয় যা পরবর্তীতে ‘তাজমহল' নামে পরিচিতি পায়। তাজমহলের নির্মাণ কাজ ১৬৩২ সালে শুরু হয়ে ১৬৫৩ সালে শেষ হয়। ওস্তাদ আহমেদ লাহুরির নকশায় প্রায় ২০ হাজার নির্মাণ শ্রমিকের নিরলস শ্রমে এই তাজমহল নির্মিত হয়। তাজমহলের স্থপতি ওস্তাদ ইশা খাঁ

লালকেল্লা: ভারতের দিল্লিতে যমুনা নদীর তীরে অবস্থিত লাল কেল্লা ছিল মুঘল সাম্রাজ্যের রাজধানী১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের ব্যর্থতার পর শেষ মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ লালকেল্লা ছেড়ে চলে গেলে ব্রিটিশরা পরবর্তীতে এটি সেনানিবাস হিসেবে ব্যবহার করেন।

শীশমহল: শীশমহল নির্মিত হয়েছে সাদা মারবেল পাথরের চেয়েও দামি আয়না দিয়ে। ১৬৩১ সালে পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের লাহোরের রাজ পরিবারের জন্য এটি নির্মিত হয়। একে ‘Palace of Mirrors' বলা হয়। এর নকশাকারক ছিলেন আসিফ খান

খাস মহল: মুঘল সম্রাটের লাল কেল্লার ভিতরে ব্যক্তিগত বাসভবনকে খাস মহল বলা হতো যা ১৬৩৬ সালে নির্মিত হয়।

ময়ূর সিংহাসন: এটি এখন পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে দামি সিংহাসন হিসেবে বিবেচিত হয়। এটি ১৬২৮ থেকে ১৬৩৫ খ্রিষ্টাব্দে নির্মাণ করা হয়। ১৭৩৯ সালে দিল্লি আক্রমণের সময়ে নাদির শাহ কর্তৃক এটি লুণ্ঠিত হয়। এই সিংহাসনেই বিখ্যাত কোহিনূর হীরা বসানো ছিলো।
কোহিনূর হীরা: কোহিনূর শব্দের অর্থ আলোর পর্বত১৩০৪ খ্রিষ্টাব্দ থেকে কোহিনূরের ইতিহাস জানা যায়। প্রথমে এটি মালওয়ার রাজাদের অধীনে থাকলেও পরবর্তীকালে তা মুঘল সম্রাটদের কাছে আসে এবং সম্রাট শাহজাহানের নির্মাণ করা ময়ূর সিংহাসনে স্থাপিত হয়। এর পর নাদির শাহ কর্তৃক দিল্লি আক্রমণের সময় এটি ইরানে চলে যায় যা পরবর্তীতে আফগান সম্রাট হুমায়ুনের পুত্রের কাছে আসে। আফগান শাসনের নিকট থেকে তা পাঞ্জাব মহারাজা রঞ্জিত সিংহের কাছে আসে। ১৮৫০ সালে এটি ব্রিটিশ রানি ভিক্টোরিয়ার কাছে চলে যায়। এরপর এটি স্থান পায় ব্রিটিশ রানির মুকুটে। বর্তমানে এটি ‘টাওয়ার অব লন্ডনে’ আছে।

শালিমার উদ্যান: এটি ছিল সম্রাট শাহজাহানের বিচারালয় যা পাকিস্তানের লাহোরের বাগবানপুরায় অবস্থিত। ১৬৪১ সালে এটি নির্মাণ করা হয়। এই বাগানে ৪১০টি ঝরনাধারা রয়েছে।

দিল্লি মসজিদ: ১৬৪৪ থেকে এর নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে ১৬৫৬ সালে শেষ হয়। মসজিদের ৩টি গম্বুজ রয়েছে। এর প্রকৃত নাম ছিল মসজিদ- ই-জাহান—নুমা

আওরঙ্গজেব (১৫৫৮-১৭০৭)

মুঘল রাজবংশের শেষ শক্তিধর শাসক ছিলেন সম্রাট আওরঙ্গজেব। তিনি ছিলেন সম্রাট শাহজাহানের তৃতীয় পুত্র। তার প্রকৃত নাম ছিল মুহিবউদ্দিন মুহাম্মদ আলমগীর। তিনি দাক্ষিণাত্যের ধুদে নামক স্থানে ১৬১৮ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে তার গভীর জ্ঞান ছিল। তিনি আরবি, ফার্সি, তুর্কিসহ বেশ কয়েকটি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন। সামরিক দিক থেকেও তিনি পারদর্শিতার পরিচয় দেন। মাত্র ১৮ বছর বয়সে আওরঙ্গজেব দাক্ষিণাত্যের সুবেদারের দায়িত্ব লাভ করেন। এছাড়াও তিনি ১৬৪৫ খ্রি. গুজরাট, ১৬৪৮ থেকে ১৬৫২ খ্রি. পর্যন্ত সিন্ধু ও মুলতানের শাসনকর্তার পদে নিয়োজিত ছিলেন। উত্তরাধিকার সংগ্রামের মাধ্যমে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাইদেরকে পরাজিত করেন। ভ্রাতৃযুদ্ধে ‘জাহানারা,’ ‘দারার’ এবং ‘রওশন আরা’ আওরঙ্গজেবের পক্ষ নেন। আলমগীর বাদশাহ গাজী উপাধি নিয়ে সিংহাসন অলংকৃত করেন। ‘ফতোয়া–ই–আলমগীর’ নামক শরিয়া আইন‘ইসলামী অর্থনীতি’ চালু করেন। আওরঙ্গজেবের শাসনামলে বাংলায় নিযুক্ত সুবেদার ‘মীর জুমলা’ আরাকান মগ ও দস্যু দমন করতে ১৬৬০ সালে রাজমহল থেকে ঢাকায় রাজধানী স্থাপন করেন। ১৬৬০ সালে শায়েস্তা খান চট্টগ্রামকে মুঘল শাসনের আয়ত্তে আনেন ও ‘ইসলামাবাদ’ নাম রাখেন। সম্রাট আওরঙ্গজেব অতিশয় ধর্মপ্রাণ মুসলমান ছিলেন। টুপি ও কোরআন বিক্রির মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করতেন। এজন্য তাকে ‘জিন্দাপীর’ বলা হতো। মারাঠাদের দমন করতে গিয়ে তিনি মারা যান।

মুহম্মদ শাহ (১৭১৯-১৭৪৮)

মুহম্মদ শাহ এর শাসনামলে পারস্যের নাদির শাহ ভারত আক্রমণ (১৭৩৯ খ্রিষ্টাব্দে) করেন। নাদিরশাহ ভারত হতে মহামূল্যবান ‘কোহিনূর হীরা’, ‘ময়ূর সিংহাসন' এবং প্রচুর ধনরত্ন পারস্যে নিয়ে যান। ময়ূর সিংহাসনটি বর্তমানে ইরানে আছে।

দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ (১৮৩৭–১৮৫৭)

দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ ছিলেন শেষ মুঘল সম্রাট। সিপাহী বিদ্রোহের পর ১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দে তাঁকে রেঙ্গুনে (বর্তমান ইয়াঙ্গুনে) নির্বাসন দেওয়া হয়। ১৮৬২ সালে রেঙ্গুনে নির্বাসিত অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। রেঙ্গুনেই তাঁকে সমাহিত করা হয়।

Coin Marketplace

STEEM 0.17
TRX 0.15
JST 0.028
BTC 57930.87
ETH 2362.47
USDT 1.00
SBD 2.36