বারোভূঁইয়াদের উত্থান-পতন ও বাংলায় সুবেদারি শাসন থেকে নবাবী শাসন

in Bulls Mind2 years ago

বারোভূঁইয়া

‘বারো’ বলতে নির্দিষ্ট বারো সংখ্যাটি বুঝায় না বরং অনির্দিষ্ট সংখ্যা বা বারোয়ারি বা পঞ্চায়েত বুঝায়। ‘ভূঁইয়া’ শব্দের অর্থ ভূ-স্বামী বা জমিদার। আফগান শাসক ও মুঘল সাম্রাজ্য উত্থানের মধ্যবর্তী সময়ে বাংলার ভাঁটি অঞ্চলের স্থানীয় সামরিক প্রধান ও জমিদারদের ‘বারোভূঁইয়া’ বলা হতো।

বারোভূঁইয়াদের নাম ও অধিকৃত এলাকা

বারোভূঁইয়াদের নামঅধিকৃত এলাকাবারোভূঁইয়াদের নামঅধিকৃত এলাকা
ঈসা খান ও মূসা খানঢাকা জেলার অর্ধাংশ, ময়মনসিংহ, পাবনা, বগুড়া ও রংপুরের কিছু অংশলক্ষ্মণ মাণিক্যভুলুয়া (নোয়াখালী)
চাঁদ রায় ও কেদার রায়শ্রীপুর (বিক্রমপুর ও মুন্সিগঞ্জ)পরমানন্দ রায়চন্দ্রদ্বীপ (বরিশাল)
বাহাদুর গাজীভাওয়ালবিনোদ রায়, মধু রায়চান্দপ্রতাপ (মানিকগঞ্জ)
সোনা গাজীসরাইল (ত্রিপুরার উত্তর সীমানায়)মুকুন্দরাম, সত্রজিৎভূষণা (ফরিদপুর)
ওসমান খানবোকাইনগর (সিলেট)রাজা কন্দর্পনারায়ন, রামচন্দ্রবরিশাল জেলার অংশ বিশেষ
বীর হামিরবিষ্ণুপুর (বাকুড়া)প্রতাপাদিত্যযশোর

ঈসা খান

বারোভূঁইয়াদের নেতা ছিলেন ঈসা খান। তার পিতার নাম সুলায়মান খান। ঈসা খানের সময় রাজধানী ছিল সোনারগাঁওয়ে। তার উপাধি ছিল ‘মসনদ-ই-আলা'। তিনি মুঘলদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ঈসা খান ১৫৯৭ সালে মুঘলদের বশ্যতা মেনে নেন।

মুসা খান

বারো ভূঁইয়াদের নেতা ঈসা খানের মৃত্যুর পর পুত্র হিসেবে মুসা খান বারোভূঁইয়াদের নেতা হিসেবে ১৫৯৯ সালে সোনারগাঁও এর মসনদে বসেন। তার জমিদারি এলাকা ছিল বৃহত্তর ঢাকা, কুমিল্লা ও বৃহত্তর ময়মনসিংহ১৬০৩ সালে মানসিংহের নিকট হেরে যান। ১৬১১ সালে ইসলাম খানের সঙ্গে যুদ্ধে সোনারগাঁওয়ের কদম রসুল দুর্গ হারান এবং মূসা খানের নেতৃত্বাধীন জমিদার বাহিনী জাহাঙ্গীরের বশ্যতা স্বীকার করে নেন। এর মধ্য দিয়ে বাংলায় বারোভূঁইয়াদের শাসনের অবসান ঘটে। বারোভূঁইয়াদের মধ্যে অন্যতম জমিদার প্রতাপাদিত্যের রাজধানী ছিল ধুমঘাঁটি নামক স্থানে। প্রতাপাদিত্যকে রাজা প্রতাপ সিংয়ের সাথে তুলনা করা হতো। চাঁদ রায় ও কেদার রায়ের জমিদারি ছিল বিক্রমপুরের শ্রীপুরেমুসা খানের সমাধি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থিত


image.png

বাংলায় সুবেদারি শাসন

বাংলায় মুঘল শাসনের দুটি ধাপ ছিল। একটি সুবেদার শাসন আর অন্যটি নবাবী শাসনসম্রাট আকবর বাংলা বিজয় করলেও বাংলা 'সুবা’ তার শাসনকালে শক্তভাবে দাঁড়াতে পারেনি। এ সময়ে বারো ভূঁইয়াদের হাতেই ছিল বাংলার মূল ক্ষমতা। সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময় বারো ভূঁইয়াদের দমন করা সম্ভব হয় এবং সমগ্র বাংলার মুঘলদের সুবেদারী শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম দিক থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশ পর্যন্ত ছিল সুবেদারী শাসনের স্বর্ণযুগ। বেশ ক'জন দক্ষ সুবেদারের নেতৃত্বে এ সময় বাংলার সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান উন্নতি হয়। আওরঙ্গজেবের পর দুর্বল উত্তরাধিকারীদের যুগে মুঘল শাসন শক্তিহীন হয়ে যায়। এ সুযোগে বাংলার সুবেদারাণ প্রায় স্বাধীনভাবে বাংলা শাসন করতে থাকেন। এ যুগ নবাবী আমল নামে পরিচিত। ১৭১৭ থেকে ১৭৫৭ সাল পর্যন্ত প্রায় ৪০ বছর ছিল নবাবদের শাসনকাল। এ যুগে কোন কোন নবাবের দক্ষতায় বাংলার শান্তি, শৃঙ্খলা ও সমৃদ্ধি বাড়ে। অন্যদিকে ইউরোপীয় বণিকদের প্রতিপত্তিও সাথে সাথে বাড়তে থাকে। ক্ষমতা নিয়ে প্রাসাদের ভেতর চলতে থাকে ষড়যন্ত্র। এরই পথ ধরে এক সময় অবসান ঘটে মুঘল শাসনের। মুঘল শাসন যুগের গৌরবময় দিক ছিল তাঁদের সুশৃঙ্খল শাসন ব্যবস্থা। বাংলায় মুঘল শাসনের অবসান ঘটলেও তাদের শাসন ব্যবস্থার রেশ থেকে যায়।

বাংলায় সুবেদারি শাসন

মুঘল সম্রাটবাংলার সুবেদারসংশ্লিষ্ট সুবেদারের উল্লেখযোগ্য তথ্য
সম্রাট জাহাঙ্গীরইসলাম খান (১৬০৮–১৬১৩), ১ম সুবেদার. বারোভূঁইয়াদের দমন করে বাংলায় সুবেদারি শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। . সুবেদার ইসলাম খানই বাংলার রাজধানী হিসেবে ঢাকা শহরের গোড়াপত্তন করেন। . তিনি ১৬১০ সালে সুবা বাংলার রাজধানী রাজমহল থেকে ঢাকায় স্থানান্তরিত করেন। . তিনি সম্রাটের নাম অনুসারে ঢাকার নামকরণ করেন জাহাঙ্গীরনগর। . তিনি 'ধোলাই খাল খনন করেন।
সম্রাট শাহজাহানকাসিম খান জুয়িনীকাসিম খান পর্তুগিজদের হুগলি থেকে উচ্ছেদ করেন।
সম্রাট শাহজাহানশাহ্ সুজাঢাকার চকবাজারের ‘বড় কাটরা’ নির্মাণ করেন ১৬৬০ সালে। তিনি চকবাজারের ‘চুরিহাট্টা’ মসজিদের নির্মাতা। তিনি ইংরেজদের বিনাশুল্কে অবাধ বাণিজ্য করার সুযোগ দেন।
----------------------------------------------
সম্রাট আওরঙ্গজেবমীর জুমলাঢাকা গেট নির্মাণ করেন। তিনি আসাম যুদ্ধে যে কামান ব্যবহার করেন তা বর্তমানে ওসমানী উদ্যানে সংরক্ষিত আছে।
সম্রাট আওরঙ্গজেবশায়েস্তা খান (১৬৬৪-১৬৮৮)তিনি চট্টগ্রামের নাম রাখেন ইসলামাবাদ। তিনি মগ ও পর্তুগিজ জলদস্যুদের এ অঞ্চল থেকে বিতাড়িত করেন। স্থাপত্য শিল্পের বিকাশের জন্য এই যুগকে বাংলায় মুঘলদের স্বর্ণযুগ বলা হয়।ঢাকায় শায়েস্তা খান নির্মিত কীর্তিগুলো হলো- ঢাকার চকবাজারের ছোট কাটরা, লালবাগের কেল্লা, চক মসজিদ, সাত গম্বুজ মসজিদ। লালবাগ কেল্লার অভ্যন্তরে শায়েস্তা খানের কন্যা পরিবিবি (আসল নাম-ইরান দুখত) এর সমাধি অবস্থিত।

বাংলার নবাবী শাসন (১৭১৭-১৭৫৭)

বাংলার নবাবী শাসন প্রতিষ্ঠাঃ মুঘল সম্রাট কর্তৃক নিযুক্ত বাংলার শেষ সুবেদার ছিলেন মুর্শিদকুলী খান। পরবর্তী মুঘল শাসকরা ছিলেন দুর্বল। সিংহাসন নিয়ে একে অন্যের সাথে দ্বন্দ্ব লেগেই থাকত। তাই দূরের প্রদেশগুলোর উপর সম্রাটের নিয়ন্ত্রণ কমে আসে। অনেক সুবেদার প্রায় স্বাধীন রাজার মতোই শাসন করতে থাকেন। মুর্শিদকুলী খানও শেষ দিকে তাই করেছিলেন। এ সময় থেকে পরবর্তীকালে আর কখনও মুঘল সম্রাটদের সরাসরি নিয়ন্ত্রণ বাংলার উপর ছিল না। ফলে দিল্লি থেকে কাউকে বাংলার সুবেদার নিয়োগ করে পাঠানোর সুযোগ ছিল না। এ সময় থেকে সুবেদার পদটি বংশগত হয়ে পড়ে । সুবেদারগণ ক্ষমতা দখল করে সিংহাসনে বসতেন। এজন্য মুঘল সম্রাটের কাছ থেকে শুধু একটি অনুমোদন নিয়ে নিতেন। তাই আঠারো শতকের বাংলা মুঘল শাসন ইতিহাসে নবাবী আমল রূপে পরিচিত লাভ করে। নবাবগণ প্রায় স্বাধীন শাসক ছিলেন।

মুর্শিদকুলী খান (১৭১৭-১৭২৭)

মুর্শিদকুলী খান বাংলার প্রথম স্বাধীন নবাব। তাঁর উপাধি ছিল জাফর খান। তিনি বাংলার সুবেদার নিযুক্ত হন ১৭১৭ সালে। তিনি ‘মাল জমিনি’ নামে রাজস্ব ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন এবং রাজধানী ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে স্থানান্তর করেন। তিনি বাংলার স্বাধীন রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। তার সময় উচ্ছেদকৃত জমিদারদের প্রদত্ত ভরণপোষণের ব্যবস্থা হলো নানকর

সুজাউদ্দিন খান (১৭২৭-১৭৩৯)

সুজাউদ্দিন খানের প্রকৃত নাম ফররুখ শিয়ার। তিনি ছিলেন মুর্শিদকুলী খানের জামাতা

আলীবর্দী খান (১৭৪৬–১৭৫৬)

আলীবর্দী খানের প্রকৃত নাম 'মির্জা মুহম্মদ আলী'। তার সময়ে বাংলায় বর্গীদের আগমন বৃদ্ধি পায় এবং তারা এদেশে এসে অত্যাচার ও লুণ্ঠন করা শুরু করে। এসব বৃদ্ধি পেলে আলীবর্দী খান বর্গীদের দমন করেন। তার আমলে বাংলার রাজধানী ছিল মুর্শিদাবাদ। তিনি ১৭৫৬সালের ১০ এপ্রিল মারা যান।

নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা (১৭৫৬–১৭৫৭)

নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার প্রকৃত নাম ‘মির্জা মুহমম্মদ সিরাজ-উদ-দৌলা'। পিতার নাম জয়েনউদ্দিন আহমদ, মাতার নাম আমিনা বেগম। নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার খালার নাম ঘসেটি বেগম। তিনি ১৭৫৬ সালের ১০ এপ্রিল সিংহাসনে আরোহণ করেন। সিংহাসনে আরোহণের সময় বয়স ছিল ২৩ বছর। তিনি ছিলেন বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব। তাকে হত্যা করেন মোহাম্মদী বেগ মতান্তরে মীর মীরন (মীর জাফরের ছেলে)। নবাব সিরাজ- উদ–দৌলার প্রধান সেনাপতির নাম মীর জাফর। পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পতনের জন্য দায়ী মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতা।

পলাশীর যুদ্ধ

● পলাশীর যুদ্ধ হয়– ২৩ জুন, ১৭৫৭ সালে।
● পলাশীর প্রান্তর অবস্থিত— ভাগীরথী নদীর তীরে।
● প্রতিপক্ষ— সিরাজ-উদ-দৌলার বিপক্ষে ইংরেজরেজ বাহিনী।
● পরাজিত হন— নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা।
● সিরাজের পক্ষে যুদ্ধ করেন— মীরমদন, মোহনলাল ও ফরাসি সেনাপতি সানফ্রে।
● বিশ্বাসঘাতক সেনাপতি— মীরজাফর, জগৎশেঠ, রায়দুর্লভ, ইয়ারলতিফ, উমিচাঁদ।
● অন্ধকূপ হত্যার প্রচারক— হলওয়েল।

মীর কাশিম (১৭৬০-১৭৬৩)

মীর কাশিম ছিলেন মীর জাফরের জামাতা ও ইংরেজ আমলে বাংলার নবাব। মীর কাসিমের রাজধানী ছিল মুঙ্গেরে

বক্সারের যুদ্ধ:

পলাশীর যুদ্ধে নবাবের পরাজয়ের পর মীর জাফর নবাব হিসেবে আরোহণ করে। কিন্তু ইংরেজরা তাকে সরিয়ে তার জামাতা মীর কাশিমকে ক্ষমতায় বসান। মীর কাশিম ইংরেজদের বাংলা থেকে হটাতে অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌলা ও দিল্লীর মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ (শাহ আলম) মিলে জোট বেঁধে ১৭৬৪ সালে বিহারের বক্সারের প্রান্তরে যুদ্ধ করেন। যুদ্ধে ইংরেজ বাহিনীর নেতৃত্ব দেন মেজর মনরো। যুদ্ধে মীর কাশিম জোটের পরাজয় হয়। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের কাছে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পরাজয় বাংলায় ইংরেজ শাসনের যে সূচনা করে, বক্সারের যুদ্ধের পরাজয়ের মাধ্যমে সে শাসনকাল আরো দীর্ঘস্থায়ীত্ব লাভ করে।

Coin Marketplace

STEEM 0.17
TRX 0.15
JST 0.028
BTC 57930.87
ETH 2362.47
USDT 1.00
SBD 2.36