আপনি কি উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ খান? এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলো আপনার জন্য অপরিহার্য!
উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশনকে বলা হয় নীরব ঘাতক, কারণ এটি প্রাথমিকভাবে কোনো সুস্পষ্ট লক্ষণ ছাড়াই শরীরের বিভিন্ন অঙ্গকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। চিকিৎসা না করলে এটি হৃদপিণ্ড, যকৃত, চোখ এবং মস্তিষ্কের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। হার্ট অ্যাটাক, কিডনি ফেইলর বা ক্রনিক কিডনি ডিজিজ, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ এবং দৃষ্টিশক্তি হারানোর মতো মারাত্মক পরিস্থিতির জন্য উচ্চ রক্তচাপ অনেকাংশে দায়ী। তাই উচ্চ রক্তচাপ শনাক্ত হলে জীবনযাপনের পরিবর্তনের পাশাপাশি ওষুধ গ্রহণও গুরুত্বপূর্ণ। তবে অ্যান্টিহাইপারটেনসিভ ওষুধ নিয়ে অনেকের মনে নানা প্রশ্ন থাকে, যেমন—ওষুধ কখন খেতে হবে, সারা জীবন ওষুধ খেতে হবে কি না, খাবারের আগে বা পরে ওষুধ নিতে হবে, এবং ভুলে গেলে কী করা উচিত। আসুন, এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করি।
উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ কখন শুরু করতে হয়
উচ্চ রক্তচাপ শরীরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে, তাই এটি শনাক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ শুরু করা প্রয়োজন। অনেকে চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন পাওয়ার পরেও মনে করেন কিছুদিন অপেক্ষা করে ওষুধ শুরু করব। আবার কেউ কেউ রক্তচাপ বেশি মনে হলে বা মাথাব্যথা, ঘাড়ব্যথা, কিংবা খারাপ লাগলে ফার্মেসি থেকে যেকোনো একটি ওষুধ নিয়ে খেয়ে নেন। এটি কখনোই করা উচিত নয়, কারণ রক্তচাপের ওষুধ প্রতিটি ব্যক্তির জন্য ভিন্ন হতে পারে। চিকিৎসক রক্তচাপের কারণ, ব্যক্তির শারীরিক ইতিহাস, পারিবারিক অবস্থা এবং অন্য কোনো রোগ রয়েছে কি না, এসব বিবেচনা করে সঠিক ওষুধ নির্ধারণ করেন। সুতরাং না বুঝে হঠাৎ করে ওষুধ গ্রহণ করলে তা উপকারের পরিবর্তে ক্ষতি করতে পারে।
আপনার ওষুধের ধরন সম্পর্কে জানুন
বিভিন্ন ধরনের উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ বিভিন্ন উপায়ে কাজ করে। কিছু সাধারণ ধরনের অন্তর্ভুক্ত:
1. মূত্রবর্ধক: এগুলি আপনার শরীরকে প্রস্রাবের মাধ্যমে অতিরিক্ত লবণ এবং জল অপসারণ করতে সহায়তা করে। রাতে বাথরুমে যাওয়া এড়াতে প্রায়ই সকালে মূত্রবর্ধক গ্রহণ করা হয়।
2. এসিই ইনহিবিটরস এবং এআরবি: এগুলি রক্তনালীগুলিকে শিথিল করে, আপনার হার্টের উপর চাপ কমায়।
3. বিটা-ব্লকার: এগুলি আপনার হৃদস্পন্দনকে ধীর করে, রক্তচাপ কমায়।
4. ক্যালসিয়াম চ্যানেল ব্লকার: এগুলি ক্যালসিয়ামকে হৃদপিণ্ড এবং রক্তনালীর কোষে প্রবেশ করতে বাধা দেয়, রক্তনালীগুলিকে শিথিল করতে সাহায্য করে।
আপনার ওষুধ কীভাবে কাজ করে তা বোঝা আপনাকে আপনার অবস্থা আরও ভালভাবে পরিচালনা করতে এবং সম্ভাব্য পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া এড়াতে সহায়তা করে।
অনিয়মিত হলে বা ভুলে গেলে কী করবেন
অনেকে মাঝে মাঝে উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ খেতে ভুলে যান। যদি একবেলা ওষুধ খেতে ভুলে যান, তবে যখনই মনে পড়বে, তখন ওষুধ খেয়ে নিতে হবে। তবে ওষুধ ভুলে যাওয়াটা অভ্যাসে পরিণত করা উচিত নয়। উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে ওষুধ প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে এবং নির্দিষ্ট মাত্রায় খাওয়া অত্যন্ত জরুরি। কারণ, রক্তচাপের ওঠানামা শরীরের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। তাই প্রতিদিন নিয়মিতভাবে একই সময়ে ওষুধ খাওয়াই উত্তম।
উচ্চ রক্তচাপের ঔষধ কি সারা জীবন খেতে হবে ?
হাইপারটেনশনের রোগীদের সাধারণত সবচেয়ে বেশি যে প্রশ্নটি থাকে, তা হলো—সারা জীবন কি ওষুধ খেতে হবে? এ কারণেই অনেকেই ওষুধ শুরু করতে দ্বিধা করেন। উচ্চ রক্তচাপ শনাক্ত হলে ওষুধের মাধ্যমে তা নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়। সময়ের সাথে সাথে চিকিৎসক ওষুধের ডোজ বা মাত্রা কমাতে বা বাড়াতে পারেন। তবে রোগী নিজে কখনোই ওষুধের মাত্রা পরিবর্তন বা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেবেন না। চিকিৎসকই নির্ধারণ করবেন ওষুধের ডোজ কমানো, বাড়ানো বা অন্য কোনো ওষুধে পরিবর্তন করা প্রয়োজন কিনা।
উচ্চ রক্তচাপের ঔষধ খাওয়ার জন্য ভালো সময়
কিছু অ্যান্টিহাইপারটেনসিভ ওষুধ রয়েছে, যেগুলো শরীর থেকে অতিরিক্ত পানি ও লবণ প্রস্রাবের মাধ্যমে বের করে দেয়। এ ধরনের ওষুধ সাধারণত সকালে সেবন করা ভালো, যাতে দিনভর প্রস্রাবের মাধ্যমে শরীর থেকে এই অতিরিক্ত তরল অপসারিত হতে পারে। আবার, কিছু ওষুধ আছে যেগুলোর প্রথম ডোজ নেওয়ার পর রক্তচাপ হঠাৎ করে কমে যেতে পারে (ফার্স্ট ডোজ হাইপোটেনশন), তাই এই ধরনের ওষুধ সাধারণত রাতে খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়, যাতে ঘুমের মধ্যে শরীরের চাপ সামলে নিতে পারে।
একটি স্বাস্থ্যকর জীবনধারা গ্রহণ করুন
রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য একা ওষুধ সবসময় যথেষ্ট নয়। সর্বোত্তম ফলাফলের জন্য একটি স্বাস্থ্যকর জীবনধারার সাথে আপনার চিকিত্সার যোগ করুন। এর মধ্যে রয়েছে:
1. লবণ খাওয়া কমানো : উচ্চ সোডিয়ামের মাত্রা রক্তচাপ বাড়াতে পারে।
2. একটি স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখা: ওজন হ্রাস, প্রয়োজন হলে, রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে।
3. নিয়মিত শারীরিক ক্রিয়াকলাপ: সপ্তাহের বেশিরভাগ দিন কমপক্ষে 30 মিনিটের ব্যায়ামের লক্ষ্য রাখুন।
4. অ্যালকোহল সেবন সীমিত করা এবং ধূমপান ত্যাগ করা: উভয় অভ্যাসই উচ্চ রক্তচাপে অবদান রাখতে পারে।
5. স্ট্রেস পরিচালনা : দীর্ঘস্থায়ী চাপ রক্তচাপকে বাড়িয়ে তুলতে পারে, তাই গভীর শ্বাস বা ধ্যানের মতো শিথিলকরণ কৌশলগুলি অনুশীলন করুন।
খাবারের সঙ্গে কি ধরনের সম্পর্ক
উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ সাধারণত খাবারের আগে বা পরে নেওয়ার নির্দিষ্ট কোনো নিয়ম নেই। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময় মেনে ওষুধ সেবন করা। যদি কেউ সন্ধ্যা সাতটায় ওষুধ খান, তাহলে চেষ্টা করতে হবে প্রতিদিন একই সময়ে, অর্থাৎ সন্ধ্যা সাতটায় ওষুধ খাওয়ার জন্য। সময় মেনে ওষুধ খাওয়া রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়ক।
আপনার ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্টগুলি এড়িয়ে যাবেন না
সফল রক্তচাপ ব্যবস্থাপনার জন্য আপনার স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীর সাথে নিয়মিত চেক-আপ করা অপরিহার্য। আপনার ডাক্তার আপনার অগ্রগতি নিরীক্ষণ করবেন, প্রয়োজনে ডোজ সামঞ্জস্য করবেন এবং কোন সম্ভাব্য পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া পরীক্ষা করবেন। এমনকি যদি আপনি ভাল বোধ করেন, পর্যায়ক্রমিক রক্তচাপ পরিমাপ এবং পরামর্শগুলি সমস্যাগুলিকে তাড়াতাড়ি ধরতে সাহায্য করে, আপনার ওষুধ কার্যকরভাবে কাজ করে চলেছে তা নিশ্চিত করে।
নিয়মিত ফলোআপ কখন করতে হবে
অনেকেই একবার উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ শুরু করার পর আর ফলোআপ করান না, যা উচিত নয়। অন্যান্য ক্রনিক রোগের মতো, উচ্চ রক্তচাপের রোগীকেও সবসময় চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকতে হবে। ওষুধের মাত্রা পরিবর্তন, নতুন ওষুধ যোগ করা, কিংবা কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হচ্ছে কি না, সেগুলো নিরীক্ষা করা জরুরি। ভালো থাকলেও নিয়মিত রক্তচাপ মাপা এবং চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত, যাতে ওষুধের কার্যকারিতা এবং স্বাস্থ্য পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রাখা যায়।
উপসংহার
হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক এবং কিডনি রোগের মতো গুরুতর স্বাস্থ্য জটিলতা প্রতিরোধে ওষুধের মাধ্যমে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করা একটি অপরিহার্য পদক্ষেপ। একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ রুটিন অনুসরণ করে, আপনার স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীর সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগে থাকার এবং একটি স্বাস্থ্যকর জীবনধারার নেতৃত্ব দিয়ে, আপনি আপনার রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন এবং একটি স্বাস্থ্যকর, দীর্ঘ জীবনযাপন করতে পারেন।