ছোট গল্প -- হিংস্র
[]হিংস্র[]
আব্দুল্লাহ আল মাসউদ
—————
ঘন জঙ্গল! নীরব-নিস্তব্ধ। কোন সারা-শব্দ নেই। পুরো জঙ্গল জুড়ে ঝিঁঝি পোকার ডাকের মত কির্ র্ র্ ঝির্ র্ র্ শব্দ শুধু। একটু পর পর একটা দু টা পাখি চিঁ চিঁ কুহু কুহু করে ডাকছে আবার থেমে যাচ্ছে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। দূর থেকে একটা বানর চিঁ চিঁ চিঁইইই করে ডেকে ওঠে। হঠাৎ একটি শিয়ালের অওওও ডাকে কেঁপে ওঠে বুশরা। হাতের চোখা লাঠিটা শক্ত করে ধরে। ভয়ে তার গলা শুকিয়ে যায়। একটু পানি পেলে গলাটা ভেজানো যেত।
পানির কলকল ধ্বনি ভেসে আসে তার কানে। ডান দিক থেকে আসছে শব্দটা। পানি না পেলে নির্ঘাত মরে যাবে সে। দু দিন যাবৎ গলায় পানি পড়ে নি। জঙ্গলের আজেবাজে ফল ফ্রুট খেয়ে আর কতক্ষণ? সে দিকে গেলে হয়ত বের হওয়ার কোন রাস্তাও পাওয়া যেতে পারে।
এগিয়ে যায় সে দিকে। কলকল ধ্বনিটা পষ্ট হচ্ছে। সে দ্রুত পায়ে এগোয়। হঠাতই থমকে দাঁড়ায় সে। গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে। কেউ একজন এদিকেই আসছে। অনেকগুলো পায়ের শব্দ। শব্দের ভিড় বাড়ছে। সেই জঙলিগুলো নয়ত? যারা হেনাকে উঠিয়ে নিয়ে গেছে। ভয়ে তার বুক কাঁপতে থাকে। হেনার সাথে ঘটা দৃশ্যটা চোখে ভাসতেই শরীরের রোম দাঁড়িয়ে যায় তার। কী নিষ্ঠুর বন্যগুলো। সে ভাবতে পারে না সে দৃশ্য। চোখের সামনে নিজের প্রিয় বান্ধবীকে কেউ এভাবে চিড়ে খেয়ে ফেললে কে-ই বা সেটা ভাবতে পারে?
ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখেছিল সে হেনার করুণ দৃশ্য। কীভাবে তারা জলজ্যান্ত হেনার তল পেটে বর্শাটা ঢুকিয়ে দেয়। একটা টান দিয়ে চিড়ে ফেলে তল পেট থেকে গলা পর্যন্ত। নাড়িভুড়ি বেরিয়ে আসে গলগল করে। একটা আর্তচিৎকার দিয়ে নীরব হয়ে যায় সে। হেনার আর্তনাদ দেখে তারও ভেতরটা ফেঁটে যাচ্ছিল। কিন্তু সে কাঁদে নি, শব্দ করে নি। শব্দ করা মানে নির্ঘাত মৃত্যু। জীবন নিয়ে পালানো যাবে না।
জঙ্গলের দক্ষিণে বন্য জন্তুর ভয়। সেখানে চার জন সাথি হারিয়ে এ দিকটায় এসেছিল। আর এ পারে বন্য মানুষখেকোর ভয়। এখানে হারাল দুই সাথি।
বুশরা কী করবে কিছুই ভেবে পাচ্ছে না। বাবা-মা'র কথা মনে পড়ছে খুব। এখানে শিকারে আসাটাই ভুল হয়েছে। কাঁদতেও পাড়ছে না সে। অধিক ভয়ে চোখে পানি আসে না। দূর থেকে একটা বিকট শিঙ্গা বাজানোর শব্দ ভেসে আসে। কতগুলো পাখি ডানা ঝাপটে ফরফর শব্দে ওড়ে যায়। শয়তানগুলোর বাঁশি। হয়ত আরেকটা শিকার পেয়েছে। হেনাকে ধরে নেয়ার পরও এমন বিকট একটা বাঁশি বাজিয়েছিল তারা।
পায়ের শব্দগুলো ধীরে ধীরে অন্য দিকে মোড় নিচ্ছে। মিলিয়ে যাচ্ছে বাতাসে। বুশরা উঁকি মেরে দেখে, আশপাশে কেউ নেই। পা টিপে টিপে এগিয়ে যায় সে। সূর্য ডুবিডুবি করছে। নদীর জলধ্বনি আরো পষ্ট হচ্ছে। সে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দেয়। শুকনো পাতায় মর্মমর শব্দ হচ্ছে। হা, ওই তো নদীটা দেখা যাচ্ছে। এ নদীতেই তো তারা এখানে এসেছিল। হা, ওইতো একটা বোট দেখা যাচ্ছে। বুশরা দৌড়ে যায় সে দিকে। তার চোখজোড়া চকচক করে ওঠে। ধরে প্রাণ ফিরে আসে। হাতের তীক্ষ্ণ ধারালো লাঠিটা ছুড়ে ফেলে দূরে। এক দৌড়ে সে ঝাঁপিয়ে পড়ে বোটে। ঠিক তখনই ঠাশ ঠাশ দু টা গুলির শব্দ ভেসে আসে কানে। কতগুলো বানর এক সাথে চিঁ চিঁ করে ওঠে। বুশরা চোখ তুলে তাকায় জঙ্গলের ওপরে। গুলির শব্দে ছোট বড় পাখিগুলো আকাশে ডানা মেলে দিয়েছে। সে বুঝতে পারে, বোটটা তাদেরই। শিকারে এসেছে। ভাসিয়ে দেয় সে ওটা।
এই প্রথম এই ভয়ঙ্কর জঙ্গলটা তার কাছে সুন্দর মনে হয়। তবে আফসুস হয় এই বোটওয়ালাদের জন্য। এক জনও বেঁচে ফিরতে পারবে না৷ যেমনটা ঘটেছিল বুশরাদের সঙ্গে। এভাবেই কেউ তাদের বোট নিয়ে পালিয়ে ছিল। তারা সাতজন আটকা পড়ে যায় জঙলায়। আর একের পর এক হিংস্র জন্তুর খাবার হতে থাকে সবাই। কেউ হয় হিংস্র মানুষের খাবার। গুলির শব্দে এতক্ষণে হয়ত শব্দোৎসের দিকে ছুটে আসছে মানুষখেকো শয়তানগুলো। ছুটে আসছে হিংস্র জন্তুগুলো!