সংকটের ছয় মাস: রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে ষড়যন্ত্র চলছে
আজ ফেব্রুয়ারি রোহিঙ্গা সংকটের ছয় মাস পূর্ণ হলো। মিয়ানমার সেনাবাহিনী, বিজিপি ও বৌদ্ধ উগ্রপন্থীদের নিপীড়ন-নির্যাতন, হত্যা-লুটপাটের মুখে রোহিঙ্গারা দলে দলে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশের উখিয়া-টেকনাফে আশ্রয় নেয়। গত ছয় মাসে প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা বসতি গাড়ে ওই এলাকায়। এর আগে থেকে সেখানে বিভিন্ন শিবিরে অবস্থান করছে আরও প্রায় তিন লাখ রোহিঙ্গা।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে পালিযে আসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মানবতার মা হিসেবে আখ্যায়িত হয়েছেন। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের জন্য তিনি বিশ্বের সব রাষ্ট্রের কাছে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টির জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। বিদেশি দাতাসংস্থার পাশাপাশি বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকেও খাদ্য, ওষুধ, পানি সরবরাহ দিয়ে মানবতার সেবা করে আসছে। মিয়ানমার-বাংলাদেশের সাথে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে ঢাকায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এ ছাড়া মিয়ানমারের নেপিডোতে বাংলাদেশ-মিয়ানমার পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে আলোচনায় সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে।
চুক্তি অনুযায়ী গত ২২ জানুয়ারি প্রথম দফায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন করার কথা থাকলেও ধূম্রজালে আটকা পড়ে তা। মিয়ানমার ২০ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ-মিয়ানমার শূন্য রেখার কোনারপাড়া এলাকায় অবস্থান করা ৬ হাজারের বেশি রোহিঙ্গাকে ফেরত নেওয়ার কথা বললে কিছু কিছু রোহিঙ্গা রাতের আঁধারে ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়ে যায়। তাদের আশঙ্কা, মিয়ানমারে প্রত্যাবাসিত হলে সেখানে তাদের বাস্তুভিটা, খেতখামার, জায়গা-জমি ফিরে পাবে না বরং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দিন কাটাতে হবে। এ ভয়ে উখিয়া-টেকনাফে অবস্থানরত ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা ভীতসন্ত্রস্ত।
কুতুপালং ক্যাম্পের ডাক্তার জাফর আলম জানান, তারা জানেন না মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে দফায় দফায় বৈঠক হওয়ার পরও কেন এখনো রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের কোনো হদিস নেই। তার মতে, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কাজ বাধাগ্রস্ত করতে ষড়যন্ত্র চলছে। বাংলাদেশে রোহিঙ্গা সমস্যা জিইয়ে রাখতে শুরু হয়েছে স্বার্থান্বেষী মহলের অপতৎপরতা।
গত বছরের ২৪ আগস্ট মিয়ানমারের রাজ্য রাখাইনে পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর প্রায় ৩০টি ক্যাম্পে সন্ত্রাসি হামলা হয় বলে দাবি করে সে দেশের সরকার। এতে এক সেনাসহ ডজন খানেক পুলিশ নিহত হয়। এ সময় সংঘর্ষে ২১ জন সন্ত্রাসী নিহত হয় বলে খবর প্রকাশিত হয়।
ওই হামলার জন্য আরসা নামের এক সংগঠনকে দায়ী করে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ। হামলার ঘটনাকে পুঁজি করে ওই মাসেই নতুন করে রোহিঙ্গা নিধন শুরু করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। এতে যোগ দেয় রাখাইনের স্থানীয় উগ্রপন্থী মগ বৌদ্ধরা। অভিযোগ ওঠে তাদেরই সহায়তায় চালানো হয় খুন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ। শত শত রাখাইন গ্রামের রোহিঙ্গা বাড়িঘর নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়।
নজিরবিহীন এই নিধনযজ্ঞকে ‘জাতিগত নিধন’ আখ্যায়িত করে জাতিসংঘ। হামলার ভয়াবহতা থেকে প্রাণ বাঁচাতে গত কয়েক মাসে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা।
আন্তর্জাতিক চাপের মুখে রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে বাংলাদেশের সঙ্গে একটি চুক্তি সম্পন্ন হলেও তা কার্যকর করা নিয়ে গড়িমসি করছে মিয়ানমার। ১৬ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, তালিকা থেকে সাড়ে ছয় হাজার রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নিতে ২৯ ফেব্রুয়ারি প্রাথমিক পদক্ষেপ নেবে মিয়ানমার। কিন্তু এর বিপরীতে মিয়ানমারের মন্ত্রী ড. উইন মিয়াত জানান, খতিয়ে দেখা হবে যে তারা আদৌ মিয়ানমারে বাস করতো কি না এবং কোনও সহিংস কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল কি না।
সরকার রোহিঙ্গাদের নিরাপদে স্বদেশে ফেরত পাঠাতে কূটনৈতিক আলোচনাসহ বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে চলছে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের দুটি সংগঠন ও কয়েকটি এনজিও প্রত্যাবাসন বিরোধী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। ষড়যন্ত্রকারীদের নানা অপতৎপরতায় স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যেও দেখা দিয়েছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। সীমান্ত এলাকার অধিবাসীরা জানান, আন্তর্জাতিক চাপে পড়ে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার ব্যাপারে সব সময় ষড়যন্ত্রের ফাঁদ ফাদছেন।
তা ছাড়া স্বার্থান্বেষী কতিপয় এনজিও এই সুযোগ কাজে লাগাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। রোহিঙ্গারা তাৎক্ষণিকভাবে বিভিন্ন সময়ে মিয়ানমারে ফেরত যাবে না বলে ক্যাম্পের অলিগলিতে বিক্ষোভ মিছিলও করেছে। তাদের একমাত্র দাবি জায়গা-জমি, ঘরবাড়ি, নাগরিক অধিকার, মৌলিক অধিকার ও তাদের চলাফেরাসহ পূর্ণ স্বাধীনতা না দিলে তারা মিয়ানমারে ফিরে যেতে রাজি নয় বলে বালুখালী ক্যাম্পের হেডমাঝি আবু তাহের জানান। তারা আরো বলেন, তারা মিয়ানমারে গিয়ে মগ সেনাদের হাতে প্রাণ না দিয়ে এখানে মরতে রাজি।
রোহিঙ্গাদের সংকট বিশ্বের এক মানবিক সমস্যা। রাখাইন রাজ্যের অভ্যন্তরীণ এ সমস্যাটি বাংলাদেশের জন্য বড় ধরনের বোঝা। অতীতেও দেখা গেছে, মিয়ানমারের সরকারি বাহিনী রোহিঙ্গাদের মাতৃভূমি থেকে বিতাড়ন করে বাংলাদেশে ঠেলে দিতে বারবার চেষ্টা চালিয়েছে। দেশ স্বাধীনের পর অন্তত পাঁচবার রোহিঙ্গারা এদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। তবে অতীতের চেয়ে এবার অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের সংখ্যা বহুগুণ বেশি। ইতোপূর্বে প্রত্যাবাসনে ফাঁকি দিয়ে অনেক রোহিঙ্গা থেকে গেছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। কৌশলে তারা দীর্ঘদিন এদেশে বসবাস করলেও কোনো সময় বাংলাদেশ সরকারের পক্ষাবলম্বন করেনি।
নিজেদের স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে মরিয়া রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠী প্রত্যাবাসনবিরোধী কর্মকাণ্ড চালিয়েছে। এবারও ওই পুরনো রোহিঙ্গা ক্যাডাররা প্রত্যাবাসনের সিদ্ধান্ত বিরোধী কর্মতৎপরতায় লিপ্ত রয়েছে বলে জানান বালুখালী ১ নং ক্যাম্পের লালু মাঝি।
এদিকে যার কারণে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, উগ্রবাদ, সীমান্ত নিরাপত্তা নিয়ে নানাবিধ সমস্যা নিরসনের লক্ষ্যে পুলিশ, বিজিবি, কোস্টগার্ডসহ আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার লোকজন রোহিঙ্গাদের ওপর নজর রাখছে। তবুও গত ১ মাসে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বিভিন্ন শিবিরে উগ্রপন্থী রোহিঙ্গাদের কারণে চারজন খুন হয়েছে এবং র্যাব-৭ কক্সবাজার বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করেছে।
টেকনাফ ও উখিয়ায় আশ্রিত নতুন ও পুরনো মিলে ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। জানা গেছে, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র সংগঠন আল-ইয়াকিন (আরসা), আরএসও এবং একাধিক এনজিও প্রতিনিধি নিজ নিজ অবস্থান থেকে রোহিঙ্গা সমস্যা জিইয়ে রাখার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। চিহ্নিত তিনটি গ্রুপ নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য পরিকল্পনা নিয়ে গোপনে নানা ষড়যন্ত্রের কলকাঠি নাড়ছে।
এদিকে এ সমস্যা ঘিরে উখিয়া ও টেকনাফের বিপুল জনগোষ্ঠী ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে বলে জানান স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা নুরুল হক। পালংখালী ইউপি চেয়ারম্যান ও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটির সদস্য সচিব এম গফুর উদ্দিন চৌধুরী জানান, রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঠেলে দিতে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও দেশটির বিদ্রোহী গ্রুপ আরসার সন্ত্রাসীদের মধ্যে যোগসাজশ রয়েছে। এ ছাড়া রোহিঙ্গাদের সেবায় নিয়োজিত কিছু ভিনদেশী এনজিও সংস্থার লোকজন রোহিঙ্গাদের উস্কানি দিয়ে প্রত্যাবসনবিরোধী কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছে।
লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে ঠেলে দিয়ে মিয়ানমার সেনাবাহিনী যেমন উল্লসিত, তেমনি রাখাইনে ঘটনা সৃষ্টিকারী রোহিঙ্গাদের বিদ্রোহী জঙ্গি সংগঠন আরসার সন্ত্রাসীরাও একেবারে চুপচাপ। পর্দার আড়ালে চলে গেছে আরসার ক্যাডাররা। এ জন্য রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গাদের বিতাড়নে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও আরসার মধ্যে গোপন আঁতাত থাকতে পারে বলে মত প্রকাশ করেছেন তারা।
আরএসওর যেসব ক্যাডার আরসায় যোগ দিয়েছে, তাদের সঙ্গে পুরনো রোহিঙ্গা নেতাদের যোগাযোগের বিষয়টিও উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না। তারা আরও বলেন, ১৯৮২ সালে রোহিঙ্গাদের নাকরিকত্ব কেড়ে নেয়ার আইন করার পর থেকে দেশটিতে রোহিঙ্গা শূন্য করার সুযোগ খুঁজছিল মিয়ানমার সেনাবাহিনী।
আন্তর্জাতিক চাপের মুখে না পড়ার লক্ষ্যে আল-ইয়াকিনকে (আরসা) হাতে নেয় মিয়ানমার। তাদের সেই উদ্দেশ্য সফল হয়েছে বলে মনে করছে বিভিন্ন মহল। তাই রাখাইন থেকে ঠেলে দেয়া লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে সহজে ফিরিয়ে নিতে চাইবে না মিয়ানমার। আশ্রিত রোহিঙ্গারাও এনজিও এবং আরএসওর উস্কানিতে স্বদেশে ফিরে যেতে আগ্রহী হবে না। বিশ্বের চাপে পড়ে কিছু রোহিঙ্গা ফেরত নিলেও মাঝপথে বিভিন্ন টালবাহানা শুরু করতে পারে মিয়ানমার। এ জন্য বাংলাদেশের ওয়ার্কিং গ্রুপকে কঠোর হওয়ার এবং প্রত্যাবাসনের সুবিধার্থে সীমান্ত এলাকা থেকে সরিয়ে রোহিঙ্গাদের ঠেঙ্গারচর-ভাসানচরে স্থানান্তর করার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয় লোকজন।
বাংলাদেশ-মিয়ানমারের মধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন চুক্তি হলেও উখিয়া-টেকনাফ ও নাইক্ষ্যংছড়ির সীমান্ত দিয়ে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ এখনো চলছে। বিপুল পরিমাণ রোহিঙ্গা আসার কারণে রোহিঙ্গাদের সেবার নামে কর্মতৎপরতা শুরু করে শতাধিক এনজিও সংস্থা। তারা উপজেলা প্রশাসনের সাথে সমন্বয় না রেখে রোহিঙ্গা শিবিরে কাজ করে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে চিহ্নিত কিছু এনজিও রোহিঙ্গাদের নামে বিদেশি ফান্ড এনে ইচ্ছেমতো খরচ করছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। ওই এনজিও কর্মীরা রোহিঙ্গাদের স্বদেশে প্রত্যাবাসন না হওয়ার জন্য বিভিন্ন ষড়যন্ত্র শুরু করেছে।
টেকনাফ ও উখিয়ায় ১২টি অস্থায়ী ক্যাম্পে ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গার আগমনে অত্যন্ত খুশি পুরনো রোহিঙ্গা নেতারা। ২ নং ক্যাম্পের ফয়েজ মাঝি জানান, মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের খাদ্য, স্বাস্থ্যসেবা, পানি, চাল-ডাল, কাপড়-চোপড় সবকিছু দিয়ে তাদের উৎসাহ দিয়ে রেখেছে বাংলাদেশ সরকার। ফলে কর্মহীন রোহিঙ্গারা দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কবে হবে এ নিয়ে তারা আপাতত ভাবছেন না।
(ঢাকাটাইমস/২৫ফেব্রুয়ারি/মোআ)