‘উঠোন’ তুমি কার কথায় নাচো?

in #busy6 years ago

ব্যাট-বলের সমস্যাগুলো হয়তো কোচ-বিশেষজ্ঞদের সাহায্যে ক্রিকেটাররা কাটিয়ে উঠতে চেষ্টা করবেন। কিন্তু মিরপুর শেরেবাংলা এবং চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামের ডিমেরিট পয়েন্ট গলার কাঁটা হয়ে থাকবে আগামী পাঁচ বছরব্যাট-বলের সমস্যাগুলো হয়তো কোচ-বিশেষজ্ঞদের সাহায্যে ক্রিকেটাররা কাটিয়ে উঠতে চেষ্টা করবেন। কিন্তু মিরপুর শেরেবাংলা এবং চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামের ডিমেরিট পয়েন্ট গলার কাঁটা হয়ে থাকবে আগামী পাঁচ বছর

দুশ্চিন্তার নতুন নাম মাঠ
শ্রীলঙ্কা সিরিজে ক্রিকেটীয় ব্যর্থতা।
এর সঙ্গে এবার যোগ হয়েছে ক্রিকেট মাঠ নিয়ে দুশ্চিন্তাও। 

নাচতে না জানলে উঠোন বাঁকা। তবে নাচে গোলমাল, নাকি আসলে উঠোনই এবড়োখেবড়ো, তা নিয়ে তর্কটা চিরকালীন। নাচুনে বলে, উঠোন বাঁকা বলেই পা-টা তার তাল মিলিয়ে পড়েনি। সমালোচকেরা বলেন, আরে ধুর, নাচ জানলে তো! খামোখা উঠোনের দোষ।

গত বছরের অস্ট্রেলিয়া সিরিজ এবং এবারের শ্রীলঙ্কা সিরিজ বাংলাদেশের দুই মূল আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ভেন্যু নিয়ে তুলে দিয়েছে সেই বিতর্ক। কোচ, খেলোয়াড়, এমনকি ম্যাচ কর্মকর্তারাও বলছেন, বাঁকা ছিল ‘উঠোন’। পাল্টা মত টেকনিক্যাল ডিরেক্টর খালেদ মাহমুদের। উইকেট ঠিকই ছিল। বাংলাদেশ দলই নাকি খেলতে পারেনি।

আসলে দুটি মতই ঠিক। উইকেটে সমস্যা তো ছিলই, তবে বাংলাদেশও পারেনি সামর্থ্য অনুযায়ী খেলতে। ভিনদেশি কন্ডিশনে শ্রীলঙ্কা যদি পারে এমন উইকেটের সঙ্গে মানিয়ে নিতে, বাংলাদেশ কেন পারেনি!

চট্টগ্রাম টেস্টে জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামের উইকেট ব্যাটিংবান্ধব তো বটেই, আসলে ছিল ব্যাটিং-স্বর্গ। পাঁচ দিনে ২৪ জন ব্যাটসম্যান আউট হয়েছেন, রান হয়েছে ১৫৩৩। ম্যাচ রেফারি ডেভিড বুন উপসংহার টেনেছেন, উইকেটে বোলারদের জন্য কিছুই ছিল না। এটি টেস্টের উপযোগী নয়। আইসিসির সিনিয়র ক্রিকেট পরিচালনা-প্রধানকে পাঠানো রিপোর্টে তিনি উইকেট সম্পর্কে মন্তব্য করলেন, ‘বিলো অ্যাভারেজ’ (গড়পড়তা মানের নিচে) বলে। আর তাতে গত ১ জানুয়ারি থেকে চালু হওয়া আইসিসির পিচ ও আউটফিল্ড পর্যবেক্ষণ নীতির আওতায় এ মাঠের নামের পাশে বসে গেল একটি নেতিবাচক (ডিমেরিট) পয়েন্ট।

ঢাকা টেস্টে আবার উল্টো ঘটনা। আড়াই দিনেই খেলা শেষ! ম্যাচ রেফারির এবার পুরো বিপরীত কারণে মনে হয়েছে, এই উইকেটও তো ‘বিলো অ্যাভারেজ’! একটি নেতিবাচক পয়েন্ট জোটে বাংলাদেশের ক্রিকেট-তীর্থ মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের ‘কপালে’ও। অবশ্য আইসিসি নিয়মটা আরেকটু আগে চালু করলে বিপদে পড়তে হতো গত আগস্ট মাসেই। অল্প বৃষ্টিতেই ভারী হয়ে যাওয়া বাদামি আউটফিল্ডকে মানসম্মত মনে হয়নি অস্ট্রেলিয়া সিরিজের ম্যাচ রেফারি জেফ ক্রোর কাছে। শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের আউটফিল্ডকে বলেছিলেন ‘পুওর’ (বাজে)। তখন শুধু মন্তব্যই করা যেত, নেতিবাচক পয়েন্ট দেওয়ার নিয়ম ছিল না। থাকলে এই মুহূর্তে শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের নেতিবাচক পয়েন্ট হতো ৩।

নতুন নিয়ম অনুযায়ী আউটফিল্ড ‘পুওর’ হলে স্টেডিয়ামের নামের পাশে বসে ২টি নেতিবাচক পয়েন্ট। এভাবে আউটফিল্ড ও উইকেটের নেতিবাচক পয়েন্ট ৫ বছরের মধ্যে ৫ হয়ে গেলে শাস্তি হিসেবে ওই মাঠে পরবর্তী ১২ মাস কোনো আন্তর্জাতিক ম্যাচ হতে পারবে না। নেতিবাচক পয়েন্ট ১০ হয়ে গেলে এই নিষেধাজ্ঞা হয় ২৪ মাসের।

শ্রীলঙ্কা সিরিজের ক্রিকেটীয় ব্যর্থতার পাশাপাশি বাংলাদেশের ক্রিকেটে মাঠ নিয়ে দুশ্চিন্তাও তাই এখন সমান্তরালে প্রবাহিত হচ্ছে। ব্যাট-বলের সমস্যাগুলো হয়তো কোচ-বিশেষজ্ঞদের সাহায্যে ক্রিকেটাররা কাটিয়ে উঠতে চেষ্টা করবেন। কিন্তু দুই স্টেডিয়ামেরই একটি করে নেতিবাচক পয়েন্ট যে গলার কাঁটা হয়ে থাকবে আগামী পাঁচটি বছর!

২০১১ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের আয়োজন প্রশংসিত হওয়ার অন্যতম কারণ ছিল ভেন্যুগুলোর সুযোগ-সুবিধা। মাঠ-উইকেট নিয়ে অন্তত প্রশ্ন ছিল না। ২০১৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপও এসব নিয়ে অভিযোগের সুযোগ দেয়নি। হঠাৎ কী এমন হয়ে গেল যে দেশের প্রধান দুটি ভেন্যুই পড়ে গেল আইসিসির অনুসন্ধানী দৃষ্টিসীমায়!

সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে এ সম্পর্কে কিছুটা ধারণা মিলেছে। ঘরের মাঠের খেলায় মাত্রাতিরিক্ত উইকেট-নির্ভরতা, উইকেট কেমন হবে সেটা নিয়ে খেলোয়াড়, কোচ, টেকনিক্যাল ডিরেক্টর, এমনকি বিসিবির শীর্ষ কর্মকর্তাদেরও মাথা ঘামানো এবং কিউরেটরদের ওপর থাকা প্রবল চাপকেই সাম্প্রতিক বিব্রতকর পরিস্থিতির অন্যতম কারণ মনে করছেন তাঁরা।

খেলার আগে এখানে উইকেটই হয়ে যায় ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’! খেলা শেষেও সেটির রেশ থেকে যায়। উইকেট প্রত্যাশা অনুযায়ী আচরণ করলে প্রকাশ্য প্রশংসায় ভাসেন কিউরেটররা। উল্টোটা হলে তাঁদের দাঁড়াতে হয় কাঠগড়ায়। আইসিসি জেনে খুশি হতে পারে যে উইকেট মনমতো না হলে কিউরেটরকে অলিখিত নেতিবাচক পয়েন্ট দেওয়ার চল তাদের নিয়মের অনেক আগে থেকেই আছে বাংলাদেশের ক্রিকেটে। কিন্তু এবার কাকে নেতিবাচক পয়েন্ট দেবে বিসিবি? ত্রিদেশীয় এবং শ্রীলঙ্কা সিরিজের উইকেট বানানোর ‘রেসিপি’ এত বেশি মানুষ মিলে ঠিক করেছেন যে বাজে উইকেটের দায়টা নির্দিষ্ট কাউকে দেওয়া যাচ্ছে না। কিউরেটর, টিম ম্যানেজমেন্ট, সিনিয়র খেলোয়াড়, বোর্ড কর্মকর্তা—কে নন!

শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে চট্টগ্রাম টেস্টে যে টিম ম্যানেজমেন্ট স্পিনিং উইকেট চেয়েছিল, সেটি বাংলাদেশ দলের স্পিননির্ভর একাদশ দেখেই অনুমান করা গেছে। তবে গুঞ্জন আছে, টিম ম্যানেজমেন্টের নির্দেশনার বাইরে কিউরেটরের কাছে কোনো কোনো ব্যাটসম্যানের অনুরোধ ছিল উইকেট যেন ব্যাটিং সহায়ক হয়। টিম ম্যানেজমেন্ট ও ব্যাটসম্যানদের ইচ্ছার সমন্বয় করতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত বানানো উইকেট পুরোপুরিই ব্যাটসম্যানদের পক্ষে গেছে! ম্যাচ রেফারির পর্যবেক্ষণে যেটির মান ‘বিলো অ্যাভারেজ’।

ঢাকায়ও স্পিন উইকেটই চেয়েছিল বাংলাদেশ টিম ম্যানেজমেন্ট। আর যেহেতু শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে খেলা, শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের শ্রীলঙ্কান কিউরেটর গামিনি ডি সিলভার ওপর ছিল কড়া দৃষ্টি। সে জন্য গামিনিরও আবার প্রমাণের ছিল, বাড়ি শ্রীলঙ্কা হলেও মাসে সাড়ে ৫ হাজার ডলার বেতন দেওয়া কর্তৃপক্ষের প্রতি আনুগত্যও তাঁর কম নেই। টিম ম্যানেজমেন্টের নির্দেশনা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে চেষ্টা করেছেন কিউরেটর এবং সেটি করতে গিয়েই সম্ভবত স্পিন-বিষ একটু বেশি ঢেলে দিলেন উইকেটে। পরিণতি প্রথম দিন থেকেই উইকেটে ফাটল, বড় বড় টার্ন, আড়াই দিনে টেস্টের সমাপ্তি এবং ‘বিলো অ্যাভারেজ’ তকমা গায়ে নিয়ে শেরেবাংলা স্টেডিয়ামেরও একটি নেতিবাচক পয়েন্ট অর্জন।

একটা সময় ছিল খেলার আগে উইকেট নিয়ে সরাসরি কথা বলতেন না কোচ-খেলোয়াড়েরা। স্বাগতিক দলের উইকেটকে নিজেদের পক্ষে রাখার চেষ্টা নিয়ে প্রকাশ্যে আলোচনা ক্রিকেটীয় রীতিবিরোধী ধরা হতো, শিষ্টাচারবহির্ভূত তো বটেই। এখনো অন্য সব দেশই রীতিটি মানে, ব্যতিক্রম কেবল বাংলাদেশ। সিরিজের আগে থেকে এখানে উইকেট প্রায় কেন্দ্রীয় চরিত্র হয়ে ওঠে। যেন খেলোয়াড়দের হাতে কিছু নেই, উইকেটই সব। এ নিয়ে খেলোয়াড়-কর্মকর্তারা সংবাদমাধ্যমে গনগনে মন্তব্য করেন। এবারই যেমন সিরিজের মাঝখানে টিম ম্যানেজমেন্টের এক সদস্য প্রকাশ্যে বলেছেন, ‘কিউরেটরকে দোষ দেওয়ার কিছু নেই। আমরা যে রকম উইকেট চেয়েছি, উনি তো সে রকমই দিয়েছেন।’ আইসিসি একটু সচেতন হলে এসব বক্তব্য আচরণবিধি ভঙ্গের দায়ে পড়বে।

বাংলাদেশে ব্যাপারটা এমন যে ঘরের মাঠে খেলা মানেই উইকেটকে বাগে রাখার পূর্ণ অধিকার! এটা ঠিক, স্বাগতিক হওয়ার এই সুবিধা সব দেশই কিছু না কিছু নেয়। কিন্তু বাংলাদেশের মতো এত প্রকাশ্যে কোথাও নয়। উইকেটের ওপর এতটা নির্ভরশীল দলও আর কোনোটা আছে বলে মনে হয় না।

নানা মুনির নানা মতেরই পরিণতি দেশের প্রধান দুটি আন্তর্জাতিক ভেন্যুর উইকেট প্রশ্নবিদ্ধ হওয়া। এবার কি সবাই বুঝবেন, উইকেটে খোঁচাখুঁচিটা আসলে কিউরেটরেরই কাজ এবং সবাই মিলে নাক না গলিয়ে তাঁকেই সেটি করতে দেওয়া উচিত? তাতে অন্তত ভুলত্রুটি হলে জবাবদিহি চাওয়ার একটা লোক থাকবে। ‘উঠোন’ কার কথায় বাঁকা হলো, সেটি খুঁজতে গিয়ে লোকারণ্যে হারিয়ে যেতে হবে না।

Coin Marketplace

STEEM 0.20
TRX 0.13
JST 0.029
BTC 67130.22
ETH 3466.74
USDT 1.00
SBD 2.73