জীবন্ত প্রাণীকে করে দেয় পাথর......আজও রহস্যে ভরা তানজানিয়ার ‘খুনি হ্রদ’
নীল আকাশের দিকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে ‘মাউন্টেন অফ গড’। তার বুকে একটি হ্রদ। টলটলে জল, শান্ত, নিশ্চুপ হ্রদটির নাম লেক ন্যাট্রন বা নেট্রন। জনমানবহীন নৈসর্গিক রূপ মন ভোলাবে অনেকেরই। কিন্তু গা শিউরে উঠবে পরক্ষণেই। যেন সাক্ষাৎ যমপুরী। সরাসরি মৃত্যু নেই, কিন্তু মৃত্যুর চেয়েও ভয়ঙ্কর শাস্তি আছে। অনেকটা রূপকথার গল্পের মতো, সুন্দর অথচ ভয়ঙ্কর। তানজানিয়ার এই হ্রদটি এখনও রহস্যময়। গেলেই দেখা যাবে হ্রদের ধারে সারে সারে পড়ে রয়েছে পাথরের পশুপাখির মূর্তি। দেখে মনে হবে কোনও ভাস্করের নিখুঁত ভাস্কর্য। কোনও খামতি নেই, সযত্নে তৈরি করা হয়েছে বাদুড়, মাছরাঙা, রাজহাঁস, ঈগলের মতো অনেক নাম না জানা প্রাণীর মূর্তি। অবশ্য, মূর্তি বলা ভুল হবে, যেন জীবন্ত জীবাশ্ম, আবার মমিও বলা যায়।
Natron কথাটি মিশরীয় মমি করণ থেকে এসেছে এটি একটি emulsifying প্রক্রিয়া ব্যবহৃত হত। নাম natron শব্দটি নাইট্রোনের শব্দ থেকে আসে, যা মিশর থেকে সোডিয়াম বাইকারবোটের সমার্থক শব্দ হিসাবে আবির্ভূত হয়। Natron 1680 এর ফ্রেঞ্চ শব্দ থেকে এসেছে যা সরাসরি আরবী ভাষার নটরন থেকে উদ্ভূত হয়েছিল। পরেরটি গ্রিক এর নাইট্রোনের থেকে ছিল।
যা Na হিসাবে পরিচিত, নাট্রন এ তিনটি উপায়ে মমি সংরক্ষণ :
1.মাংসের আর্দ্রতা ক্রমশই ব্যাকটেরিয়া বৃদ্ধির বিকাশ ঘটায়।
2.Degreased - আর্দ্রতা-ভরা চর্বি কোষ সরানো।
3.একটি মাইক্রোবাইল নিরোধক হিসাবে পরিবেশিত।
সবচেয়ে বিপজ্জনক সমস্যা হল, এই হ্রদে পাখিগুলিকে নামতে হয় না। এর উপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময়ই হ্রদের জলে পড়ে যায় তারা। কীভাবে? জলের পরিবর্তে লাভা থাকায়, সূর্যের রশ্মি হ্রদ থেকে বেশি পরিমাণ প্রতিফলিত হয়। ফলে পাখিগুলি যখন উপর দিয়ে উড়ে যায় তখন তাদের চোখ ধাঁধিয়ে যায়। তীব্র আলোর ঝলকানিতে বিভ্রান্ত হয়ে হ্রদেই পড়ে যায় বাদুড় বা পাখিগুলি। পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই অনেক পাখির মৃত্যু হয়। কেউ যদি অতি কষ্টে ডাঙায় উঠেও পড়ে, তাঁর কষ্ট আরও বাড়ে। লেকের জলের সোডা আর নুন লেগে যায় পাখি বা প্রাণীটির শরীরে। যা শুকোনোর সঙ্গে সঙ্গে শরীরে কামড়ে ধরতে থাকে। আস্তে আস্তে পাথরে পরিণত হয় ওই লবন আর সোডা। একসময় পাখিগুলির শরীর পূর্ণাঙ্গ চুনাপাথরের মূর্তির রূপ নেয়।
আফ্রিকায় ছবি তুলতে গিয়েছিলেন বিখ্যাত ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফার নিক ব্রান্ডট। আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে ছবি তুলে, তানজানিয়ায় এলেন Mountain of God বা Ol Doinyo Lengai পাহাড়ের এর ছবি তুলতে। এই পাহাড়টি একটি সক্রিয় আগেয়গিরি। যেটি মূলত ‘নাইট্রোকার্বোনেট’ লাভার উদ্গীরণ ঘটায়। আগেয়গিরির ওপর থেকেই তাঁর চোখে পড়ল একটি সুবিশাল হ্রদ। হ্রদের জলের অদ্ভুত রঙ তাঁকে টানল। পাহাড় থেকে নেমে মন্ত্রমুগ্ধের মত এগিয়ে চললেন হ্রদটির দিকে।হ্রদের কাছে পৌঁছে, তীর ধরে হাঁটতে গিয়ে দেখলেন, হ্রদের তীর বরাবর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য পাখি আর বাদুড়ের স্ট্যাচু। কারা যেন স্ট্যাচুগুলি নিঁখুতভাবে তৈরি করে, অবহেলায় ফেলে দিয়ে গেছে হ্রদের ধারে। স্ট্যাচুগুলি বেশ ভারি। একটি পাখির স্ট্যাচুকে হাতে তুলে খুঁটিয়ে দেখতে গিয়ে তাঁর মেরুদন্ড বরাবর যেন একটা হিমশীতল স্রোত বয়ে গেল। এগুলি স্ট্যাচু নয়। জীবন্ত অবস্থায় পাথর হয়ে যাওয়া প্রাণীগুলির মমি। হাতের জিপিএস ডিভাইস জানান দিচ্ছে খুনি হ্রদটার নাম লেক নেট্রন।
ফটোগ্রাফার নিক ব্রান্ডটের ঘোর কাটলে তীর বরাবর হাটঁতে শুরু করেন আবার। ছবি তোলেন বিভিন্ন পাখির, এদের মধ্যে আছে মেছো ইগল, মাছরাঙা, চড়াই, রাজহাঁস ও আরও কত শত নাম না জানা পাখি। এই হ্রদের জল ছুঁয়েছিল তারা। ছোঁয়ার সঙ্গে সঙ্গে জীবন্ত অবস্থাতেই পাথর হয়ে গেছে। পুরাণের অহল্যার মত।প্রত্যেকটি প্রাণীর দেহ নিখুঁতভাবে চুনাপাথরে জমে গেছে। মনে হবে, প্রকৃতির কর্মশালায়, কোনও ভাস্কর পাথর খোদাই করে স্ট্যাচুগুলি বানিয়েছেন। নিক ব্রান্ডট পাথর হয়ে যাওয়া বিভিন্ন পাখি ও বাদুড়দের শরীর, গাছের ডালে বসিয়ে ছবি তোলেন। যেন তারা জীবিত।
নিক তাঁর বইয়ে এ প্রসঙ্গে লিখেছিলেন, “আমি ওদের পেয়ে আবার কয়েক মিনিটের জন্য জীবন্ত করতে চেয়েছিলাম। ওরা হ্রদটির পাশের গাছের ডালে বা পাথরে যেভাবে বসে থাকত, সেভাবেই ওদের বসিয়ে দিয়েছিলাম। ছবি তুলেছিলাম। ক্যামেরার ভিউ-ফাইন্ডারে ওদের আশ্চর্য রকমের জীবন্ত লাগছিল। নিকের তোলা এই ছবিগুলি বিশ্ব জুড়ে সাড়া ফেলে alive again in death শিরোনামে।
অগভীর নেট্রন লেকটি দৈর্ঘে ৫৭ কিমি ও প্রস্থে ২২ কিমি। জলের গভীরতা মাত্র ১০ ফুট। মধ্য কেনিয়া থেকে তানজানিয়ায় ঢুকে পড়া দক্ষিণ Ewaso Ng’iro নদীর জল, নেট্রন হ্রদে এসে পড়ে। এছাড়াও লেকে জল আসে খনিজ পদার্থে ভরপুর আশেপাশের বিভিন্ন উষ্ণপ্রস্রবণ থেকে। বছরের বেশিরভাগ সময় লেকের জলের তাপমাত্রা থাকে ৬০ ডিগ্রী সেলসিয়াস।
প্রচুর সোডিয়াম ও কার্বোনেট যুক্ত ট্র্যাকাইট লাভা দিয়ে প্লিসটোসিন যুগে তৈরি হয়েছে নেট্রন হ্রদের তলদেশ। ফলে লেকের জল অস্বাভাবিক ক্ষারধর্মী। হ্রদটির জল দ্রুত বাষ্পীভূত হয়ে যায় বলে, হ্রদের তরলে পড়ে থাকে ঘন natron (sodium carbonate decahydrate) এবং trona (sodium sesquicarbonate dihydrate)।লেকের জলে ক্ষারের মাত্রা যত বাড়ে, তত বংশবৃদ্ধি হয় লবণগ্রাহী সায়ানোব্যাকটেরিয়ার। এই ব্যাকটেরিয়ার শরীরে থাকা লাল রঞ্জক পদার্থের জন্য লেকের জল হয় রক্ত লাল। পাড়ের দিকে জলের রঙ হয় হালকা গোলাপি।কেউ জানে না বা দেখেনি কীভাবে এই প্রাণীগুলি জীবন্ত স্ট্যাচু হয়ে গেছে। কিন্তু অনুমান করা হচ্ছে, সূর্যের রশ্মি হ্রদের জল থেকে আয়নার মত প্রতিফলিত হয়েছে। লেকের ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় পাখিদের চোখে লেক থেকে ঠিকরে আসা সূর্যরশ্মি পড়েছিল। চোখ ধাঁধিয়ে গিয়ে বা বিভ্রান্ত হয়ে লেকের জলে আছড়ে পড়েছিল পাখি ও বাদুড়গুলি। লেকের জলে থাকা সোডা আর নুন প্রাণীগুলির শরীরে লেগে যায়।বেশিরভাগ পাখি জলে আছড়ে পড়বার সঙ্গে সঙ্গে মারা যায়। কোনও কোনও পাখি ও বাদুড় অতিকষ্টে হ্রদের জল থেকে পাড়ের ফিরে আসে। কিন্তু ভিজে শরীর যত শুকায়, তাদের শরীর কামড়ে ধরতে থাকে সোডা আর নুন। এক সময় জীবন্ত অবস্থাতেই প্রাণীগুলি স্ট্যাচুতে পরিণত হয়, মর্মান্তিক মৃত্যু যন্ত্রণা অনুভব করতে করতে।
কিন্তু অবাক হওয়ার মত আরেকটি ঘটনা ঘটে এখানেই। পূর্ব আফ্রিকার লেসার ফ্লেমিঙ্গোদের সবচেয়ে বড় এক প্রজনন ক্ষেত্র এই লেক ন্যাট্রন। প্রায় ২৫ লক্ষ লেসার ফ্লেমিঙ্গো হ্রদটিকে ঘিরে বাস করে। কারণ এই লেকের অগভীর জলে মেলে প্রচুর স্পিরুলিনা ( নীলাভ-সবুজ শৈবাল)। এই শৈবাল খেয়ে বেঁচে থাকে এবং বংশবৃদ্ধি করে, পৃথিবীর অনান্য জায়গায় বিপন্ন হয়ে পড়া লেসার ফ্লেমিঙ্গোরা।লেসার ফ্লেমিঙ্গোরা তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য লেক ন্যাট্রনকে বেছে নিয়েছে। কারণ, এই লেক ন্যাট্রনের খুনি চরিত্র ও চরম আবহাওয়া অনান্য শিকারী পশুপাখিদের লেকটি থেকে দূরে রাখে। ফলে লেসার ফ্লেমিঙ্গোরা নিশ্চিন্তে বংশবৃদ্ধি করে এবং শাবকেরা নিরাপদে থাকে।এই হ্রদের অগভীর জলে পাওয়া যায় প্রচুর নীলাভ-সবুজ শৈবাল ।যা খেয়েই তারা বেঁচে থাকে এবং বংশবৃদ্ধি করে।
ন্যাট্রন লেকের জলে খুব বেশি ফ্লেমিঙ্গোদের জমাট দেহ খুঁজে পাওয়া যায় নি। তাই মনে করা হচ্ছে লেক ন্যাট্রনের খুনে চরিত্রটা তাদের জানা। তাই তারা লেকটির অগভীর জলে ঘুরে বেড়ায়। আর লেসার ফ্লেমিঙ্গোদের লম্বা লম্বা পা তাদের দেহকে জল থেকে অনেকটা ওপরে রাখে। ফলে হ্রদের জলে থাকা সোডা আর নুন মিলে, ফ্লেমিঙ্গো স্ট্যাচু খুব বেশি বানাতে পারেনি।জলের রাসায়ণিক বিক্রিয়ায় জন্ম নেয় সায়োনোব্যাকটিরিয়া নামে অণুজীব । এই অণুজীবের শরীরে লাল রঞ্জক থাকে । ফলে হ্রদের জলে লাল আভার সৃষ্টি হয় ।(লেখা তথ্য সূত্র থেকে নেওয়া)
তথ্যসূত্র: https://www.thewall.in/feature-a-deadly-alkaline-lake-in.../
https://www.sangbadpratidin.in/.../lake-natron-in.../amp/
https://www.bangladeshtoday.net/%E0%A6%B0%E0%A6%B9%E0%A6.../
https://www.dailynayadiganta.com/.../%E0%A6%AD%E0%A7%9F...
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Lake_Natron
https://www.anandabazar.com/.../natron-the-mysterious...
https://api.nationalgeographic.com/.../131003-calcified...
ছবি: Google search