আমার শিক্ষকতা জীবনের কিছু অনন্য অভিজ্ঞতা

in আমার বাংলা ব্লগlast month

আমার শিক্ষকতা জীবন। কিছু কথা


☘️☘️☘️☘️☘️☘️☘️☘️☘️☘️☘️☘️


IMG_20240724_083607_239.jpg

আপনারা অনেকেই হয়ত জানেন যে আমি একটি বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যুক্ত আছি। তাই আজ আপনাদের সাথে সেই অভিজ্ঞতার কিছু মনের কথা শেয়ার করব বলে ভাবলাম। আমার চোখে দেখা বিভিন্ন জায়গা, অলিগলি, অথবা দ্রষ্টব্যের ছবি এবং ইতিহাস আপনাদের সামনে যে তুলে আনি তা আপনারা এতদিনে জেনে গেছেন। কিন্তু এর মধ্যে মনে করলাম নিজের কর্মক্ষেত্র নিয়ে দু-চার কথা বলা বড় প্রয়োজন। আসলে যারা স্কুল শিক্ষক, তাদের কাছে অর্থনৈতিক বিষয়টির উপর কোথাও যেন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে মূল্যবোধের দিকটাই। বাবাও শিক্ষক থাকার সুবাদে ছেলেবেলা থেকেই বারংবার শুনে এসেছি শিক্ষকতা এক এমন পেশা যেখানে নিজের স্বার্থের অনেক উপরে থাকে ছাত্র-ছাত্রীদের স্বার্থ। পড়াতে গেলে নিজেকে ইস্পাত কঠিন হতে হয় প্রথমে। মনের মধ্যে যতই পীড়া, বেদনা বা আবেগ নাড়া দিয়ে যাক আপনাকে, বিদ্যালয়ে পৌঁছে সেইটুকু প্রকাশ করবার অবকাশ থাকে না কখনো৷ এই জায়গাতেই কর্পোরেট অফিসের সঙ্গে পার্থক্য হয়ে যায় শিক্ষকতার। একজন শিক্ষক আসলে সমাজের একটি মানদন্ড। তাই বিদ্যালয় এর ওই চেনা গন্ডিটুকুর বাইরেও নিজের জীবনযাত্রার প্রতিও অনেক যত্নশীল এবং সাবধান হতে হয় প্রতিটি শিক্ষককে। কারণ যে ছাত্রদের দিকে আপনি আঙুল তুলবেন প্রতিনিয়ত, সেই আঙুলের দায় আপনি কতটা বহন করছেন তা বিচার করা বড় প্রয়োজন। আমার তো মনে হয় শিক্ষকতা এক বিচারকের ভূমিকা। প্রতিটি ছাত্রছাত্রী যখন তীক্ষ্ণ নজরে আপনার দিকে তাকিয়ে থাকবে প্রতিনিয়ত, তখন আপনার জীবনেও চলে আসবে এক অত্যাবশ্যক পরিবর্তন। এতদিন শিক্ষকতা করতে করতে নিজের প্রতিটি পদক্ষেপের প্রতিও যেন সাবধান হয়ে গেছি অনেকটা। তাই প্রতিদিন প্রতিটি মুহূর্ত মনে হয় আমি রয়েছি হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীর তীক্ষ্ণ বলয়ের মধ্যে। তবে চিরকালই এই পরিবেশ উপভোগ করেছি আমি। কখনো মনে হয়নি নিজেকে স্বাধীন করতে শিক্ষকতা ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যাই। আসলে আমার মনে হয় শিক্ষক তারাই হতে পারেন, যারা নিজের জীবনের স্বার্থটুকুর আগে বসাতে পারেন অন্যের স্বার্থকে।

IMG_20240208_115847_047.jpgIMG_20240208_113051_083.jpg

ছাত্রছাত্রীদের সাথে কিছু মুহূর্ত

আমার বিদ্যালয়ে অসংখ্য ছাত্র প্রতিদিন দেখা হলেই 'গুড মর্নিং' বলে দিনটি শুরু করে দেয় আমার। আবার কেউ কেউ 'গুড মর্নিং' বলেই হাতে ঘড়ির দিকে তাকায় যে ঘড়ির কাঁটা বারোর ঘর পেরিয়ে গেল কিনা। অর্থাৎ এই সময়ের পর তাদের 'গুড মর্নিং' পরিবর্তন হয়ে যায় 'গুড আফটারনুন স্যার'এ৷ কচিকাঁচা ছাত্র-ছাত্রীদের মুখে এই দৈনন্দিন শুভেচ্ছা বার্তা আমার প্রতিদিনের একান্ত সঙ্গী। স্কুল শুরু হওয়ার আগে প্রার্থনা সভায় দেশের জাতীয় সংগীত গেয়ে শুরু হয় প্রতিদিনের কাজকর্ম ও পঠন পাঠন। স্কুলে পেশাগতভাবে ইংরেজি মাধ্যমে পড়ানো এবং কথোপকথনের সূত্রে বেশ কিছুটা সময় এই বিদেশী ভাষার সঙ্গে কাটে আমার সময়। কিন্তু বুকে মাতৃভাষাকে লালন করে পেশাগত কারণে মুখে ইংরেজি ভাষার ব্যবহার আমি বেশ উপভোগই করি। আসলে বিভিন্ন ভাষা জানতে আমার ভালো লাগে বরাবরই। বিভিন্ন বই এবং ইন্টারনেট ঘেঁটে কখনো ফরাসি ভাষা আবার কখনো ফ্রেঞ্চ ভাষার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করি নিয়ম করে। যেদিন প্রথম জেনেছিলাম ফরাসি ভাষায় শুভেচ্ছা বার্তা বিনিময় কালে "কা সা ভিয়েঁ" বলতে হয়, অথবা মানুষের সঙ্গে মানুষের কথোপকথনের পরে "বিএনভিনিউ" বলে শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করতে হয়, সেদিন থেকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম এই ভাষাটিকেও। আর ইংরেজি ভাষা তো ভারতবর্ষের একমাত্র অফিসিয়াল ভাষা। যদিও এই বিশাল দেশে সংবিধান অনুযায়ী বাইশটি ভাষার সমান মর্যাদা। তবু সব রকম সরকারি বেসরকারি কাজে ব্যবহার করা হয় ইংরেজি ভাষাকেই। তাই ভারতবর্ষে কাজ করে খেতে হলে ইংরেজি ভাষা জানা আজ আবশ্যক হয়ে পড়েছে। সে ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিকভাবেই আমরা আমাদের স্কুলে ইংরেজি ভাষাকে অগ্রাধিকার দিই ছাত্র-ছাত্রীদের সুবিধার্থে। কিন্তু বাংলা ভাষার গুরুত্ব বোঝাতেও আমরা বদ্ধপরিকর। আমরা বিদ্যালয়ে পালন করি একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠান। গেয়ে উঠি, "আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি?" এছাড়াও পয়লা বৈশাখ অথবা রবীন্দ্র জয়ন্তীর দিনে আমরা সমবেত কন্ঠে ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে গেয়ে উঠি বাংলা গান। এভাবেই সবকিছু নিয়ে কেটে যায় আমার শিক্ষক জীবনের প্রতিটি দিন। এই দিনগুলোয় সব সময় মনে হয় হাজার ছাত্র ছাত্রী আমার আপন সন্তান। যখন দেখি তারা মনের কথাগুলো উজাড় করে এসে জানায় আমায়, তখন মনে হয় সার্থক এই শিক্ষক জীবন। এই জীবনটুকুর জন্যই হয়তো জন্মেছিলাম এই জীবনে।

IMG_20240125_133450_916.jpgIMG_20240125_105608_834.jpg

স্কুলের বার্ষিক স্পোর্টস ডে তে

বিদ্যালয়ে পড়ানোর সূত্রে অসংখ্য শৈশব ও কৈশোর জীবনকে খুব কাছ থেকে দেখতে পাই প্রতিদিন। পরিচিত হতে পারি বর্তমানে কিশোর জীবনের সমস্যাগুলির সাথে। যতটা পারি নিজের মতো করে পাশে থাকতে চেষ্টা করি তাদের। জীবন কতটা কঠিন এবং বাস্তবধর্মী তা বোঝানোই শিক্ষকতার মূল উপজীব্য বিষয় বলে মনে হয়েছে বরাবর। তাদের মানসিক ও শারীরিক সমস্যার প্রতিটি বিষয়ে খুব স্পর্শকাতর ভাবে সামলাতে হয়েছে প্রতিদিন।
আমার কাছে শিক্ষকতা যেন এক নতুন জীবন। যবে থেকে শপথ পাঠ করে এই পেশায় প্রবেশ করেছি, সেই দিন থেকেই অগ্নিশুদ্ধির মত জীবন বদলে গেছে একটু একটু করে। আজ প্রয়োজন অপ্রয়োজনে ছাত্র-ছাত্রীদের শাসন করলেও, দিনের শেষে তাদের হাসিমুখটা যেন এ জীবনের সম্পদ বলে মনে হয়। তাদের সঙ্গে নিয়ে কখনো টেকনিক্যাল ক্লাব চালানো, আবার কখনো হাউস ইভেন্ট পরিচালনা করা, বা প্রাকটিক্যাল ক্লাসে প্রযুক্তিগত কোন বিষয়ে লেকচার দেওয়া, সব সময়ই এক বিশেষ অনুভূতির জন্ম দেয়। এ যেন এক চির প্রশ্রয়। কোনদিন কোন বিষয়ে মন খারাপ হলেও কিভাবে জানো আমার ছাত্রছাত্রীরা জেনে যায় সেই গোপন খবর। তারা কাছে এসে হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করে, "স্যার, আপনি ভালো আছেন?"

IMG_20240724_083543_802.jpg

অ্যাসেম্বলি

এই কিছুদিন আগের কথা। সেদিন ছিল আমার জন্মদিন। একজন ছাত্র এসে আমাকে প্রায় হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল তাদের ক্লাসে। আমি তো যারপরনায় বিরক্ত। কেন হঠাৎ বিনা কারণে তাদের ক্লাসে যাব বুঝে উঠতে পারলাম না। কিন্তু আমার জন্য অপেক্ষা করছিল চমক। ক্লাসে ঢুকতেই তারা আমার সামনে এগিয়ে দিল একটি বিশাল কেক। যাতে আমার নাম সমেত জন্মদিনের উল্লেখ করা রয়েছে। এই চমক সত্যিই চমকে দিয়েছিল আমাকে। তাদের আন্তরিকতায় অবাক হয়ে চোখে জমেছিল আনন্দাশ্রু।
এভাবেই প্রতিদিন আমার ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে পড়াশোনার আলোচনা, প্রজেক্টের আলোচনা, খেলাধুলার কথা এবং তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারে আলোচনা করতে করতে কেটে যায় নিজের মত। একটার পর একটা দিন আমাকে আরো একাত্ম করে তাদের জীবনের সাথে। কিন্তু প্রতি বছর এমন এক একটি দল চলে যায় বিদ্যালয় এর গণ্ডি পেরিয়ে। আর রেখে যায় কিছু পুরনো স্মৃতি এবং ফেলে যাওয়া পঠন-পাঠনের চিহ্ন। এরপর যখন রাস্তায় মুখোমুখি হওয়ার পর কেউ দ্রুত ছুটে এসে পা ছুঁতে চায়, তখন তাদের পিঠে হাত রেখে বলতে ইচ্ছে করে - কিরে, যা শিখিয়েছিলাম কাজে লাগাচ্ছিস তো?

IMG_20240201_085205_413.jpgIMG_20240201_084327_038.jpg

ছাত্রছাত্রীরা

ব্যাস এটুকুই আমার শিক্ষক জীবনের প্রাপ্তি। প্রতিদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে এই প্রাপ্তিগুলো জমিয়েই ফিরে আসি ঘরে। আবার প্রস্তুত হই আরো একটি দিনের নিখুঁত কাঠামো নির্মাণ করতে। এভাবেই প্রতিটি দিন কাটে আমার এবং প্রতিটি সকাল শিখিয়ে দেয় নতুন সংকল্পের সহজ পথটুকু বেছে নিতে।


(৫% বেনিফিশিয়ারি এবিবি স্কুলকে এবং ১০% বেনিফিশিয়ারি প্রিয় লাজুক খ্যাঁককে)


Banner_New.png


new.gif

1720541518267-removebg-preview.png


--লেখক পরিচিতি--

IMG_20240303_181107_644.jpg

কৌশিক চক্রবর্ত্তী। নিবাস পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলায়। পেশায় কারিগরি বিভাগের প্রশিক্ষক। নেশায় অক্ষরকর্মী। কলকাতায় লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের সাথে দীর্ঘদিন যুক্ত৷ কলকাতা থেকে প্রকাশিত কবিতার আলো পত্রিকার সহ সম্পাদক। দুই বাংলার বিভিন্ন প্রথম সারির পত্রিকা ও দৈনিকে নিয়মিত প্রকাশ হয় কবিতা ও প্রবন্ধ। প্রকাশিত বই সাতটি৷ তার মধ্যে গবেষণামূলক বই 'ফ্রেডরিক্স নগরের অলিতে গলিতে', 'সাহেবি কলকাতা ও তৎকালীন ছড়া' জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। সাহিত্যকর্মের জন্য আছে একাধিক পুরস্কার ও স্বীকৃতি। তার মধ্যে সুরজিত ও কবিতা ক্লাব সেরা কলমকার সম্মান,(২০১৮), কাব্যলোক ঋতুভিত্তিক কবিতায় প্রথম পুরস্কার (বাংলাদেশ), যুগসাগ্নিক সেরা কবি ১৪২৬, স্রোত তরুণ বঙ্গ প্রতিভা সম্মান (২০১৯), স্টোরিমিরর অথর অব দ্যা ইয়ার, ২০২১, কচিপাতা সাহিত্য সম্মান, ২০২১ তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য।



কমিউনিটি : আমার বাংলা ব্লগ

ধন্যবাদ জানাই আমার বাংলা ব্লগের সকল সদস্যবন্ধুদের৷ ভালো থাকুন, ভালো রাখুন।


Sort:  

Upvoted! Thank you for supporting witness @jswit.

Coin Marketplace

STEEM 0.16
TRX 0.16
JST 0.031
BTC 58861.70
ETH 2499.51
USDT 1.00
SBD 2.48