মেস বাড়িতেই আমার গণেশ চতুর্দশীর আয়োজন

in আমার বাংলা ব্লগ2 years ago

ওম গণ গণপতয়ে নমো নমঃ

সকাল থেকে মেজাজটা কেমন যেন খাঁ খাঁ করছে। সেই মেজাজ নিয়েই সব রকম কাজ করছিলাম ।সেই মেজাজ নিয়েই মেস বাড়ির সামনে দিয়ে ঝিলের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ইউনিভার্সিটির দিকে রওনা হলাম। মাথায় কোন চিন্তাই কাজ করছিল না ।শুধু কাজ করছিল গানের কিছু লাইন। কানে ছিল হেডফোন । বাসে উঠতে গিয়ে একবার পড়ে যেতে ধরলাম।আসলে আমি ওঠার আগেই বাস ছেড়ে দিয়েছিল ।

20220831_194217.jpg

তবে আমি কেন জানিনা ঘাবড়ে যাইনি ।যান্ত্রিক সমাজের সাথে সাথে যান্ত্রিক বাসের যান্ত্রিক মানুষগুলোর সাথে সাথে আমিও যেন একটা যান্ত্রিক শরীর বহন করছিলাম। তারপর অক্লান্ত পরিশ্রম। পরিশ্রমটা মাথার মেজাজের অর্থাৎ পড়াশোনা। প্রথম ক্লাস টাই ফাঁকি দিয়েছি ।একদম লাস্ট বেঞ্চে বসে ছিলাম। স্যার পড়াচ্ছিল আর এদিকে আমি লাস্ট বেঞ্চে বসে বসে কিছুই না ।ফোন ঘাটছিলাম ।স্যারের পড়ানো আমার একদম পছন্দ নয় ।কি করব।

20220831_194154.jpg

সুমনা ম্যামের ক্লাসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লিপিকা পড়তে গিয়ে চোখে জল চলে আসলো ।নিজেকে আমরা ক্লাসের সকলে যেন রবীন্দ্রনাথের লেখার ভাঁজে ভাঁজে খুঁজে পাচ্ছিলাম ।নিজের অনুভূতিগুলো যেন লিপিকায় জ্বলজ্বল করছিল । পরপর তিনটে ক্লাস দুর্দান্ত ছিল।

তারপর কিছুক্ষণ ধরে ইউনিয়ন রুমে বকবক হল টিচার্স ডে নিয়ে ।সেইসময় দুটো মানুষ আমার থেকে হাতছাড়া হয়ে গেল। দুজন মানুষের ভীষণ খিদে পাওয়ায় তারা মেস বাড়ি র উদ্দেশ্যে রওনা হল ।আসলে প্রত্যেকদিন আমি আনাহারা আর হাবিবা একসাথে বাড়ি ফিরি। একা একা ফিরতে আমার একদমই ভালো লাগেনা ।

20220831_194148.jpg

একটা সময় ছিল গল্প করতে করতে বাড়ি ফিরতাম। সময়ের সাথে সাথে পাশে হাঁটতে থাকা মানুষগুলো পরিবর্তন হয়ে যায়। একই রাস্তা থেকে যায় ,আশেপাশের বিল্ডিং গুলো একই রকম থেকে যায় ।ঝিলের পাশের গোলাপি রঙের বাড়িটা গোলাপি রঙেই থেকে যায়। কিন্তু দিনশেষে আমরা সবাই চলছি । আর পাশের মানুষ গুলো বদলে যাচ্ছে।সময়ের সাথে সাথে মেনে নিতে হচ্ছে সবকিছু। এই গোটা দুনিয়ার কাছে যেন আমরা একটা ছেলে খেলার পুতুলের মত।

20220831_193716.jpg

যাই হোক এইসব কথা বাদ দিই। এবার আমার পাগলামিটা এখান থেকে শুরু হলো। রাস্তায় আস্তে আস্তে দুটো গণেশ পূজা দেখেছি ।আর সেটা দেখার পরে স্বাভাবিকভাবেই আমার মাথায় ভূত চাপলো ।আমার তো খেয়ালই ছিল না আজকে গণেশ চতুর্দশী। তার ওপর মেসের যে কজন সবাই আমার ধর্মের নয় ।তাই এই নিয়ে ঘটাও কারোর ছিল না। আমি এখানে সেরকম ভাবে কোথায় কি পাওয়া যায় কিছুই চিনি না।

মিষ্টির দোকানে ঢুকে প্রথমে লাডুর খোঁজ করলাম। লাড্ডু নেই কিন্তু মোদক ছিল ।গণেশ ঠাকুর নাকি মোদক খেতে খুব ভালোবাসে,মা বলে। তারপর খুঁজে খুঁজে লাড্ডুর দোকানে গিয়ে কিনে ফেললাম। এসব যখন ভাবছি আমার মেসের পাশেই আমার এক ক্লাসের বন্ধুর মেস,ওর নাম সৌভিক ।

কিছুক্ষণ আগে ইউনিয়ন রুমে বকবক করার সময় সৌভিক ওখানে ছিল। সাধারণত খুব পরিচিত তিন্ জনকেই হাঁক দিয়ে ডাকি। এরা কেও না থাকায় ফোন দিয়ে কোন কাজে লাগাতে পারছি না। তাই অবশেষে মাথায় আসলো সৌভিক ।

20220831_193859.jpg

ও বেশ ভালো।আমি একবার বলতেই সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে আমাকে জোগাড় করে দিল মাটির প্রদীপ, চাঁদোয়া , পলতে এই টুকিটাকি কিছু জিনিস, যা সাধারণত পুজো করতে লাগে ।তারপর এখন ফুল কোথায় পাবো? এই নিয়ে আমার মাথা তো ব্যথা হয়ে যায়। ভীষণ অসহায় অবস্থা । সৌভিক অনেক বাজারে গিয়েও ফুল কোথাও পায় না ।সব জায়গাতেই পূজো হচ্ছে। বেচারাকে আমি রক্ষে দিলাম। বললাম ছেড়ে দে। যা আছে সেটা দিয়ে চালিয়ে নেব।

20220831_193905.jpg

এদিকে মেসে আমার গোমরা মুখের উপর কারোর কোন নজরই নেই ।তারা যে যার মতো হুল্লোড় করছে, আমার রুমে গণেশ পুজো হবে এই নেমন্তন্ন সব জায়গায় আমি ছড়িয়ে দিয়েছি। কিন্তু তাদের গনেশ পূজার কোন হিড়িকি নেই ।তারা কেউ আইসক্রিম খাচ্ছে। কেউ আবার ফলের জুস খাচ্ছে। কেউ আবার লাড্ডু টা কখন পেটের মধ্যে যাবে, সেটা চিন্তা করছে। এসব দেখার সাথে সাথে আমার মাথাটা গেল বি গ্রে।

দু চারবার ঝাপট মারলাম অর্থাৎ এই পাগলীগুলোকে ।কিন্তু পাগলি গুলো তো পাগলী। পাগলি কী আমার কথা শোনে !! এই পাগলিদের মাঝে একটি মানুষ হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতেও আমার ভীষণ পরিমাণে খারাপ লাগে। ভগবানকে ডাকতাম আমিও যদি পাগলী হতাম।

20220831_194203.jpg

যাই হোক আমার একটা ছোট্ট আলমারি রয়েছে ।আর আলমারির উপর রাখা রয়েছে আমার একটা ছোট্ট গনেশ ঠাকুর আর একটা জগদ্ধাত্রী ঠাকুরের ছবি ।সাধারণত আমি শক্তিতে বিশ্বাস করি ।ঠাকুর দেবতা ধর্মের ব্যাপারে আমার কোন বাঁচ বিচার নেই, আর তর্ক নেই। আমি কখনো ধর্মকে যাচাই করি না ,আমার মতে ধর্ম হচ্ছে মানুষের বিশ্বাস ।এক একটা মানুষ যেভাবে একটা শক্তিকে বিশ্বাস করে, আসলে আমরা শেষ পথে শেষ যাত্রায় একজন মানুষ। আমাদের এ পৃথিবীতে মিশে যেতে হয়। আমরা একই পৃথিবীর একই ছাদের তলার ছোট ছোট খেলনা পাতি আর কিছুই না।

যাই হোক সেই শুভশক্তির আরাধনা করতেই চারিদিকটা সুন্দর করে সাজাচ্ছিলাম ।সাজাতে সাজাতে ফুলটা তো বেচারা অসহায় অবস্থায় কোথায় যে পড়ে আছে, তা আমি জানতাম না। বাড়ির কাকিমাকে একবার ইচ্ছা হলো জিজ্ঞেস করার যে তার কাছে ফুল আছে কিনা ।দেখলাম কাকিমা বাড়ি নেই ।মনটা খারাপ হয়ে গেল ।তখন আবার গেলাম ।আর আমার মনকে খুশি করতে হয়তো আমার মনের ভেতরে যে পজেটিভ শক্তি ছিল সেই শক্তিই আমার হাতে এক ব্যাগ ফুল তুলসী পাতা ,বেলপাতা সব পৌঁছে দিলো।

20220831_194738.jpg

আমার আর কিছু বাকি থাকল না। তারপর আমার মনটা ভরে উঠলো । আমি সত্যিই বিশ্বাস করি এই কারণেই যে আমরা আসলে যা মন থেকে চাই তা আমরা অবশ্যই পাই। শুধু চেষ্টা করতে হবে। আমরা যদি হাত-পা গুটিয়েই বসে থাকি আর বলি আমি চাকরি পাব, তাহলে তো বড় । এসব কথা অনেকেরই ফেলনা মনে হতে পারে, কিন্তু আমি বিশ্বাস করি মন থেকে যেটা আমরা চাই ,সেটা আমরা পাই আর একটা ব্যাপার সবসময় পজিটিভ ভাবতে হবে। শুভ চিন্তা করতে হবে। সমস্ত দুশ্চিন্তাকে বাইরে রেখে শুভ দিকটাকে প্রথমে তুলে ধরতে হবে।

প্রথমে প্রদীপ জ্বাললাম। চারিদিকটা সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়ে পুজো করা হলো। নিজের মতো করেই মন্ত্র যেটুকুনি জানতাম আমার কানের মধ্যে ছোট বেলা থেকে যা মন্ত্র এসেছে , সেগুলোই পাঠ করে ধুপ আরতি করে, প্রদীপ আরতি করে পুজো সমাপ্ত হলো। তারপর এখন আমার বান্ধবী আমার কাছে প্রসাদ চায় ,কিন্তু প্রসাদ তো আমি দেবো না। মা বলে পুজো করার পর কিছুক্ষণ দরজা বন্ধ রাখতে।

সবাইকে দূর হ, দূর হ বলে আমি বের করলাম ঘর থেকে।কিছুক্ষণ ছিলাম ঘর থেকে বাইরে । তারপরে প্রসাদ তুলতে আসলাম ।প্রসাদ বিলি করতে বসলাম ।যারা প্রসাদের জন্য বসেছিল তারা রীতিমতো হামলা করল প্রসাদের প্লেটের উপর। সেই দৃশ্য আমি জন্মে ভুলবো না ।

20220831_194747.jpg

এই যে আমার অনুভূতিমেস বাড়িতে প্রথম গণেশ চতুর্দশী আয়োজন। আমাকে প্রথম কথা খুবই আনন্দ দিয়েছিল। কারণ বাড়িতে তো আমরা সবকিছু হাতের কাছে পাই। কিন্তু নিজে থেকে খুঁজে খুঁজে কষ্ট করে কোন কিছু আদায় করা একটা আলাদাই যেন একটা মজা রয়েছে। আর তার ওপর কিছু পাগলিদের সাথে গণেশ চতুর্দশী সেলিব্রেট করছি ।কথাটা আরেকবার বলতে বাধ্য হচ্ছি, মুহূর্তটাকে সত্যিই অনেক স্মৃতি বহুল করে তোলে ।তারপরে প্রসাদ খাওয়া হলো।

গণেশ ঠাকুর এখন আমার আলমারির উপরে বসে আছে। মেস বাড়ির কাকিমাকে এখন প্রসাদ দিতে যেতে হবে, তাই আপাতত এখানেই গল্প শেষ করছি ।বকবকানি নিয়ে পরের দিন আবার হাজির হব। আপনারা সকলে ভালো থাকুন। আর আশেপাশের মানুষকে ভালো থাকতে সাহায্য করুন।

@isha.ish

Sort:  
 2 years ago 

গণেশ বাবার জয় হোক।আপনি মেসে থেকে পুজা করছেন বিষয়টা অনেক ভাল লাগল।

 2 years ago 

আসলে ভালোবাসা জড়িত সমস্ত কাজ যেখানেই থাকি না কেন করা হয়ে যায়।

 2 years ago 

বেশ ভালো গুছিয়ে উপস্থাপন করেছেন, লাইনগুলো পড়ছিলাম আর নিজের মধ্যে কিছু অনুভব করছিলাম, সত্যিই আশেপাশের সব কিছুই আগের মতোই রয়ে যায়, শুধু পরিবর্তন হয়ে যায় পাশে থাকা মানুষগুলো।

 2 years ago 

ঠিক ঠিক!

 2 years ago 

আপনি মেস বাড়িতে নিজেই এত সুন্দর একটি গনেশ পুজার আয়োজন করেছেন দেখে ভাল লাগছে। আপনার ইচ্ছা শক্তিই আপনাকে সাহায্য করেছে। আপনার সাজানো সুন্দর হয়েছে। ধন্যবাদ আপু।

 2 years ago 

একদম পজিটিভ ভাবতে হবে সব সময়।

 2 years ago 

ইচ্ছাশক্তি থাকলে অনেক কিছু করা সম্ভব। এই ইচ্ছা শক্তির কারণে কঠিন থেকে কঠিনতম কাজও সহজ মনে হয়। আপনার জন্য অনেক অনেক শুভকামনা ও ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি। মিস বাড়িতে এ ধরনের একটি আয়োজন সম্পাদন করার জন্য।

 2 years ago 

অনেক ধন্যবাদ।

 2 years ago 

ওম গণ গণপতয়ে নমো নমঃ
দিদি নমস্কার
দিদি বেশি মেজাজ খারাপ করবে না তাহলে গনেশ ঠাকুর রাগ করবে ৷
যাই হোক আপনি মেস বাড়িতে গনেশ পুজো করেছেন ৷আমাদেরও এই দিকেও পুজো করেছে ৷তবে যারা ব্যবসা করে দোকান আছে ৷তারা গনেশ দেবের পুজা করে বেশি ৷
ধন্যবাদ দিদি নমস্কার

 2 years ago 

আমিও ব্যবসা করি।

 2 years ago 

আমি যতদূর পর্যন্ত জানি, যে কোন পূজা করার আগে গণেশের পূজা করতে হয় এটা কি সত্য??

 2 years ago 

ঠিক বলেছেন। হিন্দু ধর্ম মতে এটাই সত্য যে, সব পুজো করার আগে গণেশ বন্দনা আগে করতে হয়।

Coin Marketplace

STEEM 0.20
TRX 0.16
JST 0.030
BTC 65792.18
ETH 2695.80
USDT 1.00
SBD 2.90