সময় চলে যায় রেখে যায় স্মৃতি (তৃতীয় পর্ব )||

in আমার বাংলা ব্লগ2 years ago
  • ২২ ভাদ্র, ১৪২৯ বঙ্গাব্দ
  • ৬ সেপ্টেম্বর, ২০২২ খ্রিস্টাব্দ
  • ৯ সফর, ১৪৪৪ হিজরি
  • মঙ্গলবার
  • শরৎকাল

শরতে শুভ্রতার প্রতীক কাশফুলের শুভেচ্ছা জানিয়ে আজকে আপনাদের সামনে এসেছি আমার নতুন লেখা নিয়ে। আশা করছি জীবনের প্রত্যেকটি ঝামেলা একপাশে রেখে সৃষ্টিকর্তার অশেষ রহমতে আপনারা সবাই ভাল আছেন। আমিও আলহামদুলিল্লাহ আপনাদের ভালোবাসা এবং দোয়াতে বেশ ভালো আছি। আজকে সময় চলে যায় রেখে যায় স্মৃতি এর তৃতীয় পর্ব আপনাদের সামনে উপস্থাপন করব। প্রতিটা মানুষের জীবনে তার অতীতের কিছু না কিছু স্মৃতি থাকে যেগুলো তার পরবর্তী জীবনে মনের কোণে উঁকি দিয়ে বেড়ায়। আমার জীবনেও অতীতের এমন কিছু স্মৃতি রয়েছে যেগুলো মনে হলে মাঝে মাঝে মন ভালো লাগে এবং অনেক আবাগী হয়ে উঠি। জীবনের চলে যাওয়া সময়গুলো কে স্মৃতিময় করে রাখতে আমার এই লেখা, আশা করি আপনাদের সবার ভালো লাগবে।

sunset-3689760_960_720.webp
Source
বর্ষাকালে আমার আনন্দের মাত্রা একটু বেশি থাকত কারণ ছোটবেলার বর্ষাকালে আমার প্রতিটা দিনের আনন্দ ছিল ভিন্ন ভিন্ন। আমাদের স্থানীয় বাজারের সপ্তাহে দুই দিন হাট বসে শনি এবং বুধবার। তখন প্রত্যন্ত গ্রামের রাস্তা গুলো এখনকার মতো পাকা ছিল না, যা বর্ষা মৌসুমে প্রায় চলাচলের অযোগ্য হয়ে যেত। মানুষ চলাচলের জন্য ছোট খাল অথবা পানিতে পরিপূর্ণ ফসলের মাঠে নৌকা দিয়ে যাতায়াত করতো। স্থানীয় কৃষকেরা পাট এবং ধান আমাদের হাটে বিক্রি করার জন্য ছোট ছোট নৌকায় নিয়ে আসত। নৌকাগুলো আমাদের বাড়ির পাশে গাছের সাথে বেঁধে রাখত। ফসল বিক্রি শেষে তারা আবার নৌকায় করে বাড়িতে ফিরত। আমরাও সুযোগ বুঝে তিন চারজন একসাথে মিলে নৌকা নিয়ে ঘুরতে বের হতাম তাদেরকে না বলে। অনেক সময় এমন হয়েছে নৌকা চালাতে চালাতে মাঠের মধ্যভাগে চলে গিয়েছি, এরিমধ্যে ফসল বিক্রি করে নৌকার মালিক ঘাটে এসে দেখে তার নৌকা সেখানে নেই। এরপর শুরু হয় তার হাঁকডাক কে নিয়ে গেল নৌকা, তাড়াতাড়ি নিয়ে আস, দুষ্ট ছেলেমেয়ের দল, আমি কিন্তু বিচার দেবো এই ধরনের নানান কথা। আর এসব কথা শুনে মনে ভয় করতো, যদি বাবা-মার কাছে বিচার দেয় তাহলে আজকেও আবার উত্তম-মাধ্যম হবে। সে ভয়ে নৌকা ঘাটে আসার কিছু আগে আমার পানিতে লাফ দিয়ে পালাবার চেষ্টা করতাম যাতে আমাদের চিনতে না পারে।

বন্ধুরা সবাই মিলে ছোটবেলায় মাঝে মাঝে পরিকল্পনা করতাম মাঠ থেকে শাপলা এবং শালুক তুলে আনার জন্য। শালুক তুলে আনার পর তা দিয়ে আবার পিকনিক করতাম একসাথে। শালুক তোলার আনন্দটা ছিল অন্যরকম সবাই দল বেধে একসাথে কোমর পানিতে ডুবিয়ে ডুবিয়ে তুলতাম। যে বেশি বড় শালুক তুলতে পারত সে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যেত এবং বাকিরা সবাই তার দিকে তাকিয়ে আফসোস করতো আর খুঁজতে থাকতো। শালুক তোলা শেষ হলে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে সবাই মিলে শালুকগুলো এক জায়গায় করে বড় পাতিলের মধ্যে সিদ্ধ করতাম এবং ভাগ করে খেতাম।

lily-pads-1405945.jpg
Source
যেদিন আমাদের স্কুল বন্ধ থাকতো পাড়ার সব ছেলে মেয়েরা একসাথে পরিকল্পনা করে চড়ুইভাতির আয়োজন করতাম, যেটি আমার ছোটবেলার ঘটনাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি ঘটনা। বিশেষ করে এই আয়োজন নবান্নের সময় ধান কাটা শেষে মাঠের মধ্যে করা হতো। চড়ুইভাতির জন্য প্রয়োজনীয় চাল-ডাল এবং মসলা অনেক সময় ঘর থেকে চুরি করে নিয়ে যেতাম। সব বন্ধুদের বাড়ি থেকে আনা উপকরণগুলো প্রথমে এক জায়গায় করে রান্নার উদ্দেশ্যে বাড়ির পাশে মাঠের মধ্যে রওনা হতাম। কারো হাতে ইট, কারো হাতে পানির কলস, কারো হাতে রান্না করার প্রয়োজনীয় উপকরণ সমূহ নিয়ে চড়ুইভাতি করার মিশনে অংশগ্রহণ করতাম। বেশিরভাগ সময় চড়ুইভাতিতে খিচুড়ি রান্নার আয়োজন করা হতো। রান্নার কাজে সাহায্য করত আমাদের মেয়ে বন্ধুরা। বন্ধুদের মাঝে দায়িত্ব ভাগ করা থাকত, কারো থাকতো রান্নার জ্বালানি হিসেবে খড় সংগ্রহ করা, কারো থাকত আলু মরিচ পিঁয়াজ এগুলো কাটাকাটি করা,কারো থাকত ডাল চাল পানি দিয়ে পরিষ্কার করা, কারো থাকতো খাবার পানি সংগ্রহ করা। সবাই আনন্দের সাথে একটা উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করতাম সেটা হল রান্না শেষে সবাই একসাথে খাব। ইট দিয়ে প্রথমে তিন মাথাওয়ালা চুলা তৈরি করা হতো রান্নার জন্য, তারপর একে একে রান্না বসিয়ে দেয়া হতো চুলার উপরে। মাঝে মাঝে অনেক ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যেত। তুলনামূলক ছোট বন্ধুরা খড়-বিচালি বিছিয়ে পাশে বসে রান্না দেখত।

dessert-kids-1435082.jpg
Source
রান্না শেষ হওয়ার আগেই আমরা সংগ্রহ করতাম কলাপাতা যার দ্বারা তৈরি করতাম প্রাকৃতিক থালা। রান্না চলাকালীন সময় আমরা বিভিন্ন ধরনের খেলা খেলতাম যেমন, গোল্লাছুট, দাড়িয়াবান্ধা ,কানামাছি ইত্যাদি। আর কিছু বন্ধু গল্প করত টিভিতে অনুষ্ঠিত তখনকার দিনের প্রচারিত সিরিয়ালের চরিত্র ও কাহিনী নিয়ে। সবমিলিয়ে চমৎকার সময় পার করতাম সে সময়। যাইহোক রান্না শেষ হলে সবাই সারিবদ্ধ ভাবে কলাপাতা সামনে নিয়ে বসে যেতাম খাওয়ার উদ্দেশ্যে। অপেক্ষার পালা শেষ করে কলাপাতায় সবাইকে দেয়া হতো মজাদার খিচুড়ি। তৃপ্তি সহকারে খাবার খেতাম সারাদিনের কষ্টের ফল যেন সার্থক হল। খাওয়া শেষে সবাই হৈ হুল্লোড় করতে করতে আবার বাড়িতে ফিরতাম।

যে মাঠে কিছুদিন আগেও হাওরের মত অথৈ পানি ছিল সেই জায়গায় এখন ফসল কাটার ধুম লেগে গেছে অর্থাৎ নবান্ন এসে গেছে। অগ্রহায়ণ মাসে ফসলের মাঠে বিশেষ করে ধান কটার সময় চারিদিকে মাঠ যেন সোনালী বর্ণ ধারণ করে পাকা ফসলের রঙে। এ সময় বাবা আমাদের জমিতে ধান কাটার জন্য বাজার থেকে শ্রমিক নিয়ে আসতো। উঠান ভর্তি ফসল আর খড় দিয়ে ভরে যেত এবং বন্ধুরা মিলে লাফালাফি করতাম খড়ের মধ্যে। চারিদিক নতুন ধানের গন্ধ ছড়িয়ে থাকতো এবং ধান মাড়াইয়ের কাজ চলত প্রতি বাড়িতে বাড়িতে। নবান্নের সময় সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল নতুন ধানের চাল দিয়ে প্রতি বাড়িতে পায়েস এবং পিঠেপুলির আয়োজন। আমার বেশ মনে পড়ে আমার দাদি নতুন চাউলের পিঠা বানাতেন অনেক রাত অব্ধি, পিঠা বানানো শেষে সব বাড়িতে বাড়িতে পিঠা পৌঁছে দিতেন, যে সংস্কৃতি এখন বিলুপ্তপ্রায়।

kids-7426792_960_720.webp
Source
বিনোদনের জন্য আমাদের ছেলেবেলার অনেকটা সময় কেটেছে বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলা করে। মেয়েদের খেলার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল পুতুলের বিয়ে দিয়ে দাওয়াত খাওয়া,এক্কাদোক্কা বা কুতকুত খেলা,ওপেনটি বায়স্কোপ,পাঁচ গুটি বা কড়ি, ইচিং বিচিং খেলা ইত্যাদি। ছেলেদের খেলার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ডাংগুলি,ডাংগুলি খেলা যখন হত তখনও ক্রিকেট তেমনটা জনপ্রিয় ছিল না। হাডুডু খেলা যা এখনও গ্রামবাংলায় টিকে আছে। দাড়িয়াবান্ধা,গোল্লাছু্‌ট কানামাছি,গোলাপ-টগর,৪গুটি বা ১৬গুটি,মোরগ লড়াই ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য খেলা। ক্রিকেট ও ফুটবল বাদেও যেগুলো ছিল তখনকার ছেলেমেয়েদের কাছে তুমুল জনপ্রিয় খেলা।

বন্ধুরা আজকে এ পর্যন্ত, সময় চলে যায় রেখে যায় স্মৃতির পরবর্তী পর্বে আবার আপনাদের সামনে নতুন লেখা নিয়ে হাজির হব। সে পর্যন্ত সবার সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করছি,সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

Coin Marketplace

STEEM 0.20
TRX 0.16
JST 0.030
BTC 65897.19
ETH 2706.68
USDT 1.00
SBD 2.88