যে মানুষটি নীরবে পাশে থাকে, তাকেই আমরা সবচেয়ে বেশি অবহেলা করি ।
আজ- ২৬ ই মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, শীতকাল ।
আসসালামু-আলাইকুম। আদাব - নমস্কার। মাতৃভাষা বাংলা ব্লগিং এর একমাত্র কমিউনিটি আমার বাংলা ব্লগ এর ভারতীয় এবং বাংলাদেশী সদস্যগণ, আশা করি সবাই ভাল আছেন।
আমরা জীবনে অনেক মানুষের সঙ্গে চলি, কথা বলি, সময় কাটাই। কারো সঙ্গে খুব বেশি আবেগ জড়িয়ে যায়, আবার কাউকে খুব কাছের ভাবি শুধুই প্রয়োজনের খাতিরে। কিন্তু খেয়াল করলে দেখব, আমাদের জীবনে এমন কিছু মানুষ থাকে যারা কখনো নিজের গুরুত্ব বোঝায় না, মুখ ফুটে কিছু চায় না, অথচ সবসময় নিঃশব্দে পাশে থাকে—ভালো সময়েও, খারাপ সময়েও। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এই নীরব সঙ্গীদের আমরা সবচেয়ে বেশি অবহেলা করি।
এই অবহেলা হয়ত ইচ্ছাকৃত নয়। বরং তাদের নিঃশব্দ উপস্থিতি আমাদের এতটাই স্বাভাবিক হয়ে যায় যে আমরা ধরে নিই—তারা তো থাকবেই। তারা তো অভিযোগ করে না, অভিযোগ করলে মন খারাপ করে না, তাই হয়তো আমরা তাদের অনুভূতির মূল্য দেই না। অথচ তারাই আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় আশ্রয় হয়ে থাকে—মা, বাবা, ভাই, বন্ধু, জীবনসঙ্গী, এমনকি কোনো সহকর্মী, যারা সবসময় নিঃশব্দে আমাদের পাশে থাকে, কিছু না বলেই।
ধরুন, একজন মা। প্রতিদিন তার সন্তানকে খেয়াল রাখেন, খাওয়ান, স্কুলে পাঠান, তার ভালো-মন্দ দেখেন—কোনো প্রশংসা আশা করেন না, কোনো দাবি রাখেন না। আমরা শুধু সেই দিনটাতেই তাকে অনুভব করি যেদিন সে অসুস্থ হয়ে পড়ে। তখনই টের পাই, তার নীরব ভালোবাসা কতটা অমূল্য ছিল। আবার ধরুন, কোনো পুরোনো বন্ধু, যে প্রতিটি কঠিন মুহূর্তে পাশে থেকেছে, কিন্তু নতুন সম্পর্ক বা জীবনের ব্যস্ততায় আমরা ধীরে ধীরে তার থেকে দূরে সরে গেছি। সেও কখনো কিছু বলেনি, শুধু চুপচাপ অপেক্ষা করেছে—আমরা বুঝব কি না, জানি না।
মানুষের স্বভাবই এমন—যারা জোরে ভালোবাসে, প্রকাশ করে, চাহিদা দেখায়, তারা বেশি দৃষ্টিগোচর হয়। কিন্তু যারা নীরবে ভালোবাসে, চাহিদাহীন ভালোবাসায় আমাদের আগলে রাখে, তারা যেন ছায়ার মতো থেকে যায়। আর এই ছায়াগুলোই জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান অংশ। কারণ তারা থাকেন যখন অন্য কেউ থাকে না, তারা বোঝেন যখন আর কেউ বোঝে না, তারা সহ্য করেন—আমাদের রাগ, অভিমান, অবহেলা—কিছু না বলেই।
কিন্তু একটা সময় আসে, যখন এই মানুষগুলোও ক্লান্ত হয়ে পড়ে। তারা মুখে কিছু বলে না, কিন্তু মনের গভীরে কষ্ট জমে। একসময় তারা সরে যায়, হয়তো একদম চুপিচুপি, আমাদের অজান্তেই। তখন আমরা টের পাই, এই শূন্যতা ভরানোর মতো কেউ আর নেই। তখনই বোঝা যায়, যাকে আমরা সবচেয়ে অবহেলা করেছি, সেও ছিল সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ।
জীবন বড় অদ্ভুত—এটা সবসময় আমাদের শেখায়, কিন্তু অনেক সময় খুব দেরি করে শেখায়। তখন আর সময় থাকে না, মানুষটাও আর পাশে থাকে না। তখন শুধু আফসোস থেকেই যায়—"যদি আরেকটু বোঝাতে পারতাম আমি কতোটা কৃতজ্ঞ", "যদি আরও একটু সময় দিতাম", "যদি একটিবার বলতাম, তুমি থাকাটা আমার কাছে কতো গুরুত্বপূর্ণ।"
এই লেখার পাঠকদের কাছে একটাই অনুরোধ—ভালোবাসা মানে শুধু বিশেষ দিনে ফুল দেওয়া, সামাজিক মাধ্যমে ছবি দেওয়া নয়। ভালোবাসা মানে প্রতিদিন তাকে মনে করিয়ে দেওয়া যে, "তোমার উপস্থিতি আমার জীবনে অমূল্য।" যিনি চুপচাপ পাশে থাকেন, তার দিকে একটু বেশি মনোযোগ দিন। সময় দিন, অনুভব করুন, কথায় না হলেও আচরণে তার গুরুত্ব বোঝান। কারণ তারা কোনোদিন কিছু বলবে না, কিন্তু হারিয়ে গেলে কষ্টটা বোঝা যায় গভীরভাবে।
যে মানুষটি নীরবে পাশে থাকে, সে ভালোবাসে নিঃশর্তভাবে। সে চায় না কিছু, শুধু আমাদের হাসিমুখ দেখেই খুশি হয়। অথচ আমরা সেই হাসিমুখের পেছনের ক্লান্তি দেখি না। আমরা সেই মানুষটির আত্মত্যাগের গল্প শুনি না, কারণ সে নিজেই তা কখনো বলেনি। সে হয়তো চুপচাপ আমাদের ভুলগুলো ক্ষমা করে দিয়েছে, আমাদের উদাসীনতাকে স্বাভাবিক ভাবে নিয়েছে। কিন্তু ভালোবাসারও একটা সীমা থাকে। যদি বারবার অবহেলা করা হয়, তাহলে সেই নীরব ভালোবাসাটাও একদিন মুখ ফিরিয়ে নেয়।
তাই যতদিন পাশে আছে, যতদিন হাতে হাত রাখা যায়, ততদিন তাদের গুরুত্ব বুঝে গড়ে তুলুন সম্পর্কের বন্ধন। কারণ একবার যদি হাত ছেড়ে যায়, ভালোবাসার মানুষটা দূরে চলে যায়, তখন আর কিছুই করার থাকে না। শুধু চোখের কোণটা ভিজে থাকে, আর হৃদয়ের ভেতরে একটা দুঃখ জমে থাকে—যেটা সময়েও মুছে ফেলা যায় না।