ভালো সময়গুলো কেনো সবসময় থাকে না?

ভালো সময়গুলো কেনো সবসময় থাকে না—এই প্রশ্নটি মাঝে মাঝে আমাদের বড় করে তোলে, আবার কখনো কখনো খুব ছোট করে ফেলে দেয়। জীবনের নিরব সময়ে, একা ঘরে বসে কিংবা ব্যস্ত শহরের ট্রাফিকের মাঝেও এই চিন্তাটা হঠাৎ মাথায় আসে—যে সময়গুলো একদিন খুব আপন ছিল, যেখানে হাসি ছিল, নির্ভরতা ছিল, কাঁধে মাথা রাখার মতো কেউ ছিল, সেই সময়গুলো কোথায় চলে গেল? কেন সেসব সময়কে ধরে রাখা গেল না? ভালো সময় আসলে ঠিক নদীর ঢেউয়ের মতো। আসে, স্পর্শ করে, একটুখানি আনন্দ দেয় আর তারপর আবার সরে যায়, হারিয়ে যায় সময়ের প্রবাহে। আর আমরা দাঁড়িয়ে থাকি সেই শূন্যতায়, যেখানে একদিন ছিল অনাবিল সুখ। তখনই মনে হয়, যদি সময়টা থেমে থাকত, যদি সেই মানুষটা পাশে থাকত, যদি সেই দিনগুলো বারবার ফিরে আসত!

তবে জীবন তো কখনো থেমে থাকে না। সময় তার নিজস্ব গতিতে এগিয়ে চলে, আমাদের পছন্দ হোক বা না হোক। একদিন যে মানুষগুলো আমাদের আনন্দের উৎস ছিল, তারা হয়তো অন্য কোথাও ব্যস্ত। একদিন যে জায়গাটা ছিল নির্ভরতার আশ্রয়, আজ সেটাই হয়তো মনে হয় অচেনা। সময়ের এই পরিবর্তন আমাদের কষ্ট দেয়, কারণ আমরা আবেগ দিয়ে বাঁচি। আমাদের স্মৃতির ভেতরে সেই ভালো সময়গুলো বারবার ফিরে আসে। একটা গানের সুর, পুরোনো ছবির এলবাম, বা হঠাৎ কোনো চেনা গন্ধ—এসব কিছু আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যায় সেই দিনগুলোতে, যেগুলো আমরা হারাতে চাইনি। আর তখনই আবার প্রশ্নটা মাথায় ঘুরে—ভালো সময়গুলো সবসময় থাকলে কেমন হতো?

কিন্তু একটা সত্য হচ্ছে, ভালো সময়গুলো যদি সবসময় থাকত, তাহলে হয়তো আমরা তাদের কখনোই এত মূল্য দিতাম না। মানুষ হিসেবে আমরা অভ্যস্ত হয়ে যাই, যেটা প্রতিদিন পাই, তার গুরুত্ব আমাদের চোখে কমে যায়। একটানা সুখ আমাদের হয়তো অলস করে দিত, কৃতজ্ঞতা হারিয়ে ফেলতাম আমরা। তাই জীবন মাঝে মাঝে আমাদের চোখে জল আনে, ভালো সময় কেড়ে নিয়ে আমাদের শেখায়—সেই সময়গুলোর কী গুরুত্ব ছিল, কীভাবে আমরা সেটা আরো ভালোভাবে উপভোগ করতে পারতাম। তাই হয়তো ভালো সময়গুলো আসে, আবার যায়, আবার ফিরে আসে—একটা চক্রের মতো। এবং সেই চক্রটাই আমাদের বড় করে, অভিজ্ঞ করে, মানুষ করে তোলে।

জীবনে ভালো সময় যেমন আসে, খারাপ সময়ও আসে। কিন্তু খারাপ সময়গুলো আমাদের আরও সংবেদনশীল করে তোলে। সেই কষ্টের মধ্যেই আমরা বুঝি, কার ভালোবাসা নিঃস্বার্থ ছিল, কে শুধু সঙ্গে ছিল ভালো দিনগুলোতে, আর কে পাশে থেকেছে আঁধার সময়েও। ভালো সময়ের অস্থায়ীত্বই আমাদের সেই মানুষগুলোকে চিনতে শেখায়, আর একই সঙ্গে আমাদের শেখায় কৃতজ্ঞতা। আমরা বুঝি—যখন ভালো সময় আসে, তখন আমাদের হাসা উচিত, সময়টাকে অনুভব করা উচিত, কারণ তা চিরকাল থাকবে না।

তবে এটা ভুলে গেলে চলবে না, ভালো সময় সবসময় না থাকলেও, আবার ফিরে আসে। আজ যদি সময়টা খারাপ হয়, কাল হয়তো সূর্য উঠবে নতুন আলো নিয়ে। একটা ক্লান্ত সন্ধ্যার পরে যেমন শান্ত একটা সকাল আসে, তেমনি জীবনের খারাপ সময়ের পরে আসে নতুন সম্ভাবনা, নতুন হাসি। কেউ চলে গেলে নতুন কেউ আসে, কিছু হারিয়ে গেলে অন্য কিছু পাওয়া যায়। এই পৃথিবীটা এমনই—সব হারিয়ে গিয়েও আবার সব কিছু ফিরে পাওয়া যায়। শুধু আমাদের দরকার ধৈর্য, বিশ্বাস আর আশার আলোকে ধরে রাখা।

ভালো সময়ের সবচেয়ে সুন্দর দিক হলো—এটা আমাদের ভেতরে থেকে যায়। হয়তো মানুষ বদলে যায়, জায়গা বদলে যায়, কিন্তু সেই মুহূর্তগুলো আমাদের হৃদয়ের সবচেয়ে উষ্ণ জায়গায় জায়গা করে নেয়। সেখান থেকে কেউ কখনো তা কেড়ে নিতে পারে না। কখনো কোনো কষ্ট বা বাস্তবতা সেই স্মৃতিকে মুছে দিতে পারে না। তাই ভালো সময়কে ধরে রাখার একমাত্র উপায় হলো—তাকে গভীরভাবে অনুভব করা, সেই সময়টায় থাকা, মন থেকে উপভোগ করা। কারণ আমরা জানি, হয়তো এই মুহূর্তটা আর ফিরে আসবে না।

সুতরাং যখন ভালো সময় আসে, তখন দুশ্চিন্তা না করে, ভবিষ্যতের ভয় না পেয়ে—সেই সময়টাকে ভালোবাসা উচিত। মানুষকে আগলে রাখা উচিত, হাসিগুলোকে ধরে রাখা উচিত, কথা গুলোকে মূল্য দেওয়া উচিত। কারণ কিছু সময় পরে আমরা হয়তো কেবল স্মৃতিই ধরে রাখব। আর সেই স্মৃতিগুলোই একদিন আমাদের বাঁচিয়ে রাখবে।

ভালো সময় গুলো সবসময় না থাকলেও, তারা কখনো হারিয়ে যায় না। তারা থেকে যায়—মনের গহীনে, নিঃশ্বাসের ভেতর, কোনো পুরোনো চিঠির ভাঁজে, অথবা কোনো অলস বিকেলের চা-এর কাপে। সেই সময়গুলোই আমাদের জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। তাই জীবনের প্রতিটি ভালো মুহূর্তকে উপভোগ করো, ভালোবাসো, কারণ সেটা চিরকাল থাকবে না—কিন্তু তার স্মৃতি, তার উষ্ণতা তোমার সাথে সারাজীবন থাকবে।