গঙ্গা পেরোনোর প্রতিদিনের যাত্রা: এক অনন্য অভিজ্ঞতা
গঙ্গা পেরোনোর প্রতিদিনের যাত্রা: এক অনন্য অভিজ্ঞতা
প্রতিদিন সকাল শুরু হয় আমার এক প্রিয় অভ্যাস দিয়ে—ফেরী সার্ভিসে গঙ্গা পারাপার। এই ছোট্ট যাত্রাটা যেন দিনের সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ ও গভীর অনুভবের মুহূর্ত। শহরের কোলাহল থেকে একটু দূরে, ভোরের গঙ্গার ধারে দাঁড়িয়ে ফেরীর জন্য অপেক্ষা করার সময়টুকু এক অন্যরকম অনুভূতি এনে দেয়। যাত্রীদের কোলাহল, মাঝির হাঁক, গঙ্গার ঢেউয়ের শব্দ আর বাতাসে ভেসে আসা ধূপের গন্ধ—সব মিলিয়ে যেন এক জীবন্ত প্রার্থনার মতো লাগে।
ফেরীতে উঠলেই চোখে পড়ে গঙ্গার দু’পারের দুই ভিন্ন ছবি। একদিকে পুরনো কেল্লা বা ঘাটের ধ্বংসাবশেষ, অন্যদিকে আধুনিক শহরের উঁচু উঁচু অট্টালিকা। এই দুইয়ের মাঝে দাঁড়িয়ে আমি যেন সময়ের দুই প্রান্ত স্পর্শ করি। গঙ্গার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আমি হঠাৎ করে সময়ের বাইরে চলে যাই—ভুলে যাই আমার শিক্ষকতা, দায়িত্ব, ক্লাস, অফিস—শুধু থেকে যাই আমি আর আমার ভাবনারা।
সকালের প্রথম আলো যখন গঙ্গার জলে পড়ে, তখন মনে হয় যেন স্বয়ং সূর্য তার আলো দিয়ে জলকে আশীর্বাদ করছে। ঢেউগুলো তখন সোনালি হয়ে ওঠে, আর আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে সেই সৌন্দর্য গিলতে থাকি। কখনো মাঝির গলায় উঠে আসে কোন পুরনো বাংলা গান, যা শুনলে আমার ছোটবেলা কিংবা বাবার মুখটা মনে পড়ে যায়। এইসব ছোট ছোট মুহূর্ত একসাথে মিলে গড়ে তোলে আমার প্রতিদিনের 'আত্মিক পুনর্জন্ম'।
ফেরী শুধুই এক পরিবহণের মাধ্যম নয়, আমার কাছে এটি এক ধ্যানস্থ মঞ্চ। প্রতিদিনের এই ১০-১৫ মিনিটের যাত্রা আমার মনের ওপর এক গভীর প্রভাব ফেলে। সারাদিনের কাজের চাপ, ছাত্রদের প্রশ্ন, রিপোর্ট বানানো, ক্লাস নেওয়া—সবকিছুর আগে আমি যেন এখানেই নিজেকে প্রস্তুত করি। মাঝে মাঝে ফেরীতে দাঁড়িয়ে আমি গঙ্গার পাড়ে থাকা পুরনো দালানগুলো দেখে গল্প কল্পনা করি, ইতিহাসের টানাপড়েন চিন্তা করি, কিংবা পরের কবিতার পঙক্তি খুঁজে নিই।
কোনো কোনোদিন ঘন কুয়াশায় গঙ্গা ঢেকে যায়, ফেরীর গতি মন্থর হয়। কিন্তু সেই ধোঁয়াশার মধ্যেও একটা রহস্য থাকে, একটা অজানা সৌন্দর্য। আবার বর্ষার দিনে নদী ফুলে ওঠে, ঢেউ হেলিয়ে হেলিয়ে আসে ফেরীর গায়ে, তখন মনে হয় প্রকৃতি যেন নিজের রূপে মত্ত হয়ে উঠেছে।
এই রোজকার ফেরী যাত্রা আমাকে শিখিয়েছে ধৈর্য, ভালোবাসা, আর অন্তর্জগতের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন। শহরের কোলাহলের মাঝে এই গঙ্গা পেরোনো সময়টুকু যেন আমার নিজস্ব একটি উপাসনালয়, যেখানে আমি নিজেকে খুঁজে পাই, নতুন করে দিনটা শুরু করার প্রেরণা পাই।
তাই প্রতিদিন সকালে ফেরী করে গঙ্গা পেরোনোটা শুধু একটা যাতায়াত নয়, এটা এক নিঃশব্দ আরাধনা, এক নীরব আত্মসংলাপ—যা আমাকে প্রতি সকালে নতুন করে বাঁচতে শেখায়।
🙏 ধন্যবাদ 🙏
(১০% বেনিফিশিয়ারি প্রিয় লাজুক খ্যাঁককে)
--লেখক পরিচিতি--
কৌশিক চক্রবর্ত্তী। নিবাস পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলায়। পেশায় কারিগরি বিভাগের প্রশিক্ষক। নেশায় অক্ষরকর্মী। কলকাতায় লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের সাথে দীর্ঘদিন যুক্ত৷ কলকাতা থেকে প্রকাশিত কবিতার আলো পত্রিকার প্রধান সম্পাদক। দুই বাংলার বিভিন্ন প্রথম সারির পত্রিকা ও দৈনিকে নিয়মিত প্রকাশ হয় কবিতা ও প্রবন্ধ। প্রকাশিত বই সাতটি৷ তার মধ্যে গবেষণামূলক বই 'ফ্রেডরিক্স নগরের অলিতে গলিতে', 'সাহেবি কলকাতা ও তৎকালীন ছড়া' জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। সাহিত্যকর্মের জন্য আছে একাধিক পুরস্কার ও স্বীকৃতি। তার মধ্যে সুরজিত ও কবিতা ক্লাব সেরা কলমকার সম্মান,(২০১৮), কাব্যলোক ঋতুভিত্তিক কবিতায় প্রথম পুরস্কার (বাংলাদেশ), যুগসাগ্নিক সেরা কবি ১৪২৬, স্রোত তরুণ বঙ্গ প্রতিভা সম্মান (২০১৯), স্টোরিমিরর অথর অব দ্যা ইয়ার, ২০২১, কচিপাতা সাহিত্য সম্মান, ২০২১ তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
কমিউনিটি : আমার বাংলা ব্লগ
ধন্যবাদ জানাই আমার বাংলা ব্লগের সকল সদস্যবন্ধুদের৷ ভালো থাকুন, ভালো রাখুন।
https://x.com/KausikChak1234/status/1909982985157288409?t=u4di3gkb0XWbRjD_5F04zw&s=19
https://x.com/KausikChak1234/status/1909983510548660584?t=DGyGP0QGEv4NL1jge59gQA&s=19
https://x.com/KausikChak1234/status/1909984485371769151?t=Yqs2srN7-fWDdZ20YLRVtQ&s=19
https://x.com/KausikChak1234/status/1909985484316500341?t=M8MXH1Akl5chl5cMUSQDxg&s=19
https://x.com/KausikChak1234/status/1909985822452949145?t=o6TFQaH-t94kv20pwyDf9A&s=19
https://x.com/KausikChak1234/status/1909986440315809839?t=9OKk-Fk4vzbptVmmNlpDQw&s=19