এই মাসে এমন একটি রাত্র ( শবে কদর) রহিয়ছে যাহা হাজারো মাস হইতে উত্তম
হযরত সালমান ( রাযিঃ) বলেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শাবান মাসের শেষ তারিখে আমাদিগকে নসীহত করিয়াছেন যে, তোমাদের উপর এমন একটি মাস আসিতেছে, যাহা অত্যন্ত মর্যাদাশীল ও বরকতময় । এই মাসে এমন একটি রাত্র ( শবে কদর) রহিয়ছে যাহা হাজারো মাস হইতে উত্তম। আল্লাহ তায়ালা এই মাসে রোযা রাখাকে ফরজ করিয়াছেন এবং এই মাসের রাত্রগুলিতে নামায (অর্থাৎ, তারাবীহ) পড়াকে সওয়াবের কাজ কাজ বানাইয়াছেন। যে ব্যক্তি আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য এই মাসে কোন নফল এবাদত করিল, সে যেন রমযানের বাহিরে একটি ফরজ আদায় করিল। আর যে ব্যক্তি এই মাসে কোন ফরজ আদায় করিল সে যেন রমযানের বাহিরে সত্তরটি ফরজ আদায় করিল । ইহা ছবরের মাস আর ছবরের বিনিময়ে আল্লাহ তায়ালা জান্নাতে রাখিয়াছেন। ইহা মানুষের সহিত সহানুভূতির মাস। এই মাসে মুমিনের রিযিক বাড়াইয়া দেওয়া হয় । যে ব্যক্তি কোন রোযাদারকে উফতার করাইবে, ইহা তাহার জন্য গোনাহমাফী ও জাহান্নাম হইতে মুক্তির কারণ হইবে এবং সে রোযাদারের সমান সওয়াবের ভাগী হইবে। কিন্তু রোযাদার ব্যক্তির সওয়াবের মধ্যে কোন কম করা হইবে না। সাহাবায়ে কেরাম আরজ করিলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমাদের মধ্যে প্রত্যেকেই তো এমন সামর্থ্য রাখে না যে, রোযাদারকে ইফতার করাইতে পারে । হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফরমাইলেন, ( পেট ভর্তি করিয়া খাওওয়াইতে হইবে না ) এই সওয়াব তো আল্লাহ তায়ালা একটি খেজুর খাওয়াইয়ালে অথবা এক ঢোক পানি পান করাইলে অথবা এক চুমুক দুধ পান করাইলেও দান করিবেন । ইহা এমন মাস যে, ইহার প্রথম অংশে আল্লাহর রহমত নাযিল হয়, মধ্যের অংশে গোনাহ মাফ করা হয়ে এবং শেষ অংশে জাহান্নাম হইতে মুক্তি দেওয়া হয় । যে ব্যক্তি এই মাসে আপন গোলাম (ও কর্মচারী বা খাদেম) এর কাজের বোঝা হালকা করিয়া দেয়, আল্লাহ তায়ালা তাহাকে মাফ করিয়া দেন এবং জাহান্নামের আগুন হইতে মুক্তি দান করেন। এই মাসে চারটি কাজ বেশী করিতে থাক। তন্মধ্যে দুইটি কাজ আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি হাসিলের জন্য আর দুইটি কাজ এইরুপ যাহা না করিয়া তোমাদের উপায় নাই। প্রথম দুই কাজ যাহা দ্বারা আল্লাহ তায়ালাকে সন্তুষ্ট করিবে উহা এই যে, অধিক পরিমাণে কালেমায়ে তাইয়্যেবা পড়িবে এবং এস্তেগফার করিবে। আর দুইটি কাজ হইল, আল্লাহ তায়ালার নিকট জান্নাত পাওয়ার জন্য দোয়া করিবে এবং জাহান্নাম হইতে মুক্তির জন্য দোয়া করিবে। যে ব্যক্তি কোন রোযাদারকে পানি পান করাইবে, আল্লাহ তায়ালা (কেয়ামতের দিন) তাহাকে আমার হাউজে কাউসার হইতে এইরুপ পানি পান করাইবেন যাহার পর জান্নাতে প্রবেশ করা পর্যন্ত আর পিপাসা লাগিবে না। (তারগীবঃ ইবনে খুযাইমাহ, বাইহাকী, ইবনে হিব্বান)
ফায়দাঃ উক্ত হাদীসের কোন কোন বর্ণনাকারী সম্পর্কে মুহাদ্দিসগণ কিছুটা বিরুপ মন্তব্য করিলেও
প্রথমতঃ ফযীলত সম্পর্কীয় হাদীসের ব্যাপারে ঐটুকু সন্তব্য সহনীয় । দ্বিতীয়তঃ এই হাদীসে বর্ণিত অধিকাংশ বিষয়বস্তু অন্যান্য হাদীস দ্বারা সমর্থিত। উল্লেখিত হাদীস দ্বারা কয়েকটি বিষয় জানা যায়-
প্রথম বিষয়ঃ নবী করীম সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযান মাসের বিশেষ এহতেমাম করিয়াছেন, যে কারণে তিনি রমযানের পূর্বে শাবান মাসের শেষ তারিখে ইহার গুরুত্বের উপর বিশেষভাবে নসীহত করিয়াছেন এবং লোকদিগকে সতর্ক করিয় দিয়াছেন যে , রমযানুল মুবারকের একটি মুহূর্তও যেন নষ্ট না হয় বা অবহেলার মধ্যে কাটিয়া না যায়। এই নসীহতের মধ্যে তিনি পূরা মাসের ফযীলত বয়ান করিয়া আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি বিশেষভাবে সকলের মনোযোগ আকর্ষণ করিয়াছেন । তন্মধ্যে প্রথম হইল, শবে কদর । এই শবে কদর প্রকৃতপক্ষে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি রাত্র ( ইহার বিস্তারিত বিবরণ দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে প্রথকভাবে আসিতেছে।) অতঃপর তিনি এরশাদ ফরমাইয়াছেন যে, আল্লাহ তায়ালা রমযান মাসের রোযা ফরজ করিয়াছেন । ইহা দ্বারা প্রমানিত হয় যে, তারাবীকে নিজের দিকে সম্বন্ধ করিয়া বলিয়াছেন যে, তারাবীহকে আমি সুন্নত করিয়াছি, ইহার অর্থ হইল, গুরুত্ব দেওয়া। কেননা হুযুর সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইহার প্রতি অনেক বেশী গুরুত্ব দিতেন। এই কারণেই সকল ইমাম ইহার সুন্নত হওয়ার ব্যাপারে একমত । ’বুরহান’ কিতাবে আছে, একমাত্র রাফেজী সম্প্রদায় ছাড়া এই নামাযকে আর কেহ অস্বীকার করে না । হযরত মাওলানা আবদুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (রহঃ) ’মা ছাবাতা বিস-সুন্নাহ’ কিতাবে কোন কোন ফেকার কিতাবের উদ্ধৃতি দিয়া লিখিয়াছেন যে, কোন শহর বা এলাকার লোকেরা যদি তারাবীর নামায ছাড়িয়া দেয়, তবে ইহা ছাড়িয়া দেওয়ার কারণে মুসলমান শাসনকর্তা তাহাদের সহিত লড়াই করিয়া তাহাদিগকে পড়িতে বাধ্য করিবেন। এইখানে বিশেষভাবে একটি বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখিতে হইবে যে, অনেকেরই ধারণা যে, তাড়াহুড় করিয়া আট দশ দিনে কুরআন খতম শুনিয়া লইবে অতঃপর ছুটি । ইহা খেয়াল রাখিবার বিষয় যে, এইখানে ভিন্ন ভিন্ন দুইটি সুন্নত রহিয়াছে- একটি হইল পুরা কুরআন শরীফ তারাবীতে পড়া বা শোনা। আর দ্বিতীয়টি হইল পুরা রমযান মাস তারাবীহ পড়া । সুতরাং এমতাবস্থায় একটি সুন্নতের উপর আমল হইল আর অন্য সুন্নতটি বাদ পড়িয়া গেল । অবশ্য যে সমস্ত লোকের রমযান মাসে সফর ইত্যাদি কিংবা অন্য কোন কারণে এক এলাকায় থাকিয়া তারাবীর নামায আদায় করা মুশকিল হয় তাহাদের জন্য উত্তম হইল , রমযানের শুরুর দিকেই কয়েক দিনে তারাবীর নামাযের মধ্যে পুরা কুরআন শরীফ শুনিয়া লইবেন। যাহাতে কুরআন শরীফ অসম্পূর্ণ থাকিয়া না যায়। অতঃপর যেখানে সময় সুযোগ হইবে সেখানে তারাবীহ পড়িয়া লইবেন। এইভাবে করিলে কুরআন শরীফে খতমও অসম্পূর্ণ থাকিবে না এবং নিজের কাজ-কর্মেরও কোন ক্ষতি হইবে না ।
হুযূর সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম রোযা ও তারাবীর আলোচনার পর অন্যান্য ফরজ ও নফল এবাদতসমুহের এহতেমাম করিবার প্রতি মনোযোগ আকর্ষন করিয়া বলিয়াছেন যে, এই মাসে একটি ফরজের সওয়াব অন্যান্য মাসের সত্তরটি ফরজের সমান এবং একটি ফরজের সওয়াব অন্যান্য মাসের সত্তরটি ফরজের সমান। এইখানে আমাদের নিজ নিজ এবাদতসমূহের প্রতিও একটু চিন্তা করিয়া দেখা উচিত যে, এই মোবারক মাসে আমরা ফরজ এবাদতগুলির কতটুকু এহতেমাম করিয়া থাকি এবং নফল এবাদত আমরা কতটুকু বাড়াইয়া দেই। ফরজ আদায়ের ব্যাপারে আমাদের এহতেমামের অবস্থা তো এই যে, সেহরী খাওয়ার পর যে ঘুমাইয় যাওয়া হয় ইহাতে অধিকাংশ সময় ফজরের নামায কাজা হইয়া যায়। আর তা না হইলে অন্ততঃ জামাতে নামায আদায় তো অধিকাংশ লোকেরই ছুটিয়া যায়। এইভাবে যেন আমরা সেহরী খাওয়ার শোকরিয়া আদায় করিলাম যে, সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ফরজ কে একেবারে কাজা করিয়া দিলাম । অথবা উহাকে অসম্পূর্ণ করিয়া দিলাম। কেননা শরীয়তের মূলনীতিবিদগণ জামাত ছাড়া নামায আদায়কে অসম্পূরর্ণ বলিয়াছেন। আর হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো এক হাদীসে এরশাদ ফরমাইয়াছেন- যাহারা মসজিদের নিকটে থাকে তাহাদের নামায মসজিদ (অর্থাৎ জামাত) ছাড়া (যেন) আদায়ই হয় না । ‘মাজাহিরে হক ‘ কিতাবে আছে, যে ব্যক্তি বিনা ওজরে জামাত ছাড়া নামায পড়ে তাহার জিম্মা হইতে ফরজ তো আদায় হইয়া যায় কিন্তু সে নামাযের সওয়াব পায় না। এইভাবে আরেক নামায মাগরিবের জামাতও অনেকের ইফতারের দরুন ছুটিয়া যায় – প্রথম রাকাত বা তাকবীরে উলার তো প্রশ্নই উঠেনা। আবার অনেকেই তারাবীর বাহানায় এশার জামাত ওয়াক্তের আগেই পড়িয়া লয়। ইহা তো হইল রমযান মুবারকে আমাদের নামাযের অবস্থা, যে নামায সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ফরজ। অর্থাৎ এক ফরজ (রোযা) পালন করিতে গিয়া উহার বদলে তিন ফরজ অর্থাৎ তিন ওয়াক্ত নামায বরবাদ করা হইল। এই তিন ওয়াক্ত তো প্রায়ই নষ্ট হইয়া থাকে। আর যোহরের নামায (কায়লূলা অর্থাৎ) দুপুরের বিশ্রামের খাতিরে এবং আছরের জামাত ইফতারীর সামান খরিদ করিবা পিছনে যে কোরবানী হইয়া যায় তাহা তো চোখের সামনে দেখা গিয়াছে। এইভাবে অন্যান্য ফরজ এবাদতের বিষয় নিজেই চিন্তা করিয়া দেখুন যে, রমযানের মুবারক মাসে সেইগুলির কতটুকু এহতেমাম করা হয় । যখন ফরজ এবাদতগুলিরই এই অবস্থা তখন নফল এবাদতের তো আর প্রশ্নই উঠে না। এশরাক ও চাশতের নামায তো রমযানের ঘুমের জন্যই উৎসর্গ হইয়া যায় । আওয়াবীন নামাযের এহতেমাম কিভাবে হইবে যখন এইমাত্র রোযা খোলা হইল আবার একটু পরেই তারাবীহ আসিতেছে। আর তাহাজ্জুদ নামাযের সময় তো একেবারে সেহরী খাওয়ার সময়ই। কাজেই নফল এবাদতের সুযোগ কোথায়? কিন্তু এই সবকিছু অবহেলা এবং আমল না করার বাহানা মাত্র। ”তুমি নিজেই যদি কাজ করিতে না চাও, তবে ইহার জন্য হাজারো যুক্তি খাড়া করিতে পার।” আল্লাহ তায়ালার কত বান্দা এমন রহিয়াছেন, যাহাদের জন্য এই সময়ের ভিতরেই সবকিছু করিবার সুযোগ হইয়া যায়। আমার মুরুব্বী হযরত মাওলানা খলীল আহমদ (রহঃ) কে একাধিক রমযানে দেখিয়াছি যে, স্বাস্থ্যগত দুর্বলতা ও বার্ধক্য সত্বে, মাগরিবের পর নফলের মধ্যে সোয়া পারা পড়িতেন অথবা শুনাইতেন। অতপর আধা ঘন্টার মধ্যেই খানাপিনা ইত্যাদি জরুরত হইতে ফারেগ হইয়া হিন্দুস্থানে অবস্থান কালে প্রায় দুই সোয়া দুই ঘন্টা তারাবীর নামাযে ব্যয় করিতেন। আর মদীনা মুনাওয়ারায় অবস্থান কালে এশা ও তারাবীর নামাযে প্রায় তিন ঘন্টা লাগিয়া যাইত। ইহার পর তিনি মৌসুমের তারতম্য হিসাবে দুই অথবা তিন ঘন্টা আরাম করিয়া তাহাজ্জুদ নামাযে তেলাওয়াত করিতেন এবং ফজরের ওয়াক্ত হওয়ার আধা ঘন্টা আগে সেহরী খাইতেন । সেহরীর পর ফজরের নামায পর্যন্ত কখনও মুখস্থ তেলাওয়াত করিতেন, আর কখনও ওজীফা ও যিকির-আযকারে মশগুল থাকিতেন। সকালে আলো পরিষ্কার হইয়া গেলে ফজরের নামায পড়িয়া এশরাক পর্যন্ত মুরাকাবা করিতেন । এশরাকের পর প্রায় এক ঘন্টা আরাম করিতেন। ইহার পর হইতে প্রায় বারটা পর্যন্ত এবং গ্রীষ্মকালে একটা প্রর্যন্ত ’বযলুল-মাজহূদ’ কিতাব লিখিতেন এবং চিঠিপত্র দেখিতেন ও জবাব লিখাইতেন। অতঃপর যোহরের নামায পর্যন্ত আরাম করিতেন । যোহরের নামাযের পর হইতে আছর পর্যন্ত তেলাওয়াত করিতেন এবং উপস্থিত লোকদের সহিত কথাবার্তাও বলিতেন। ‘বযলুল মাজহূদ’ কিতাব লেখা শেষ হইবার পর সকালের কিছু সময় তেলাওয়াতে ও বিভিন্ন কিতাব পড়িয়া কাটাইতেন । এই সময় প্রায়ই ’বযলুল-মাজহূদ’ ও ’ওয়াফাউল- ওয়াফা’ কিতাব দুইখানা পড়িতেন। রমযান মুবারকে তাঁহার মামূলাত বা নিয়মিত আমলের বিশেষ কোন সময়েও ছিল; সারা বৎসর তিনি এইসব আমলের এহতেমাম করিতেন। অবশ্য নামাযের রাকাতগুলি রমযান মাসে আরও ভিন্ন ও খাছ মামূলাতে ছিল, যেগুলির পুরাপুরি অনুসরণ করা সকলের জন্য সহজ নয়। শায়খুল হিন্দ হযরত মাওলানা মাহমূদুল হাসান (রহঃ) তারাবীর পর হইতে ফজর পর্যন্ত সারারাত্র নফল নামাযে মশগুল থাকিতেন এবং একের পর এক কয়েকজন হাফেজে কুরআনের পিছনে কুরআন মজীদ শুনিতে থাকিতেন। হযরত মাওলানা শাহ আবদুর রহীম রায়পূরী (রহঃ) এর দরবারে তো পূরা রমযান মাস দিন- রাত্র কেবল তেলাওয়াতই চলিতে থাকিত । এই সময় ডাক-যোগাযোগ ও চিঠিপত্রের আদান-প্রদান বন্ধ থাকিত। ‘কাহারও সহিত সাক্ষাৎ করাও পছন্দ করিতেন না । কোন কোন খাছ খাদেমকে শুধু এতটুকু অনুমতি দেওয়া ছিল যে, তারাবীর পর যতটুকু সময় তিনি দুই একপেয়ালা রং চা পান করিবেন তখন তাহারা সাক্ষাৎ করিয়া যাইবে। আল্লাহওয়ালাদের অভ্যাস ও মামুলাতসমূহ মামুলী দৃষ্টিতে পড়িয়া নেওয়া বা দু’ একটি মুখরোচক কথা বলিয়া দেওয়ার জন্য লিখা হয় না বরং , এইজন্য লিখা হয় যেন নিজ নিজ হিম্মত অনুযায়ী তাঁহাদের অনুসরন করা হয় এবং এইসব মামূলাত পূরা করিবার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করা হয় । কেননা, আল্লাহওয়ালাদের প্রত্যেকেরই তরীকা ও নিয়ম- পদ্ধতি নিজ নিজ বৈশিষ্ট্যের কারণে একটি অপরটি হইতে উত্তম। যাহারা দুনিয়াবী ঝামেলা হইতে মুক্ত তাহাদের জন্য কত চমৎকার সুযোগ যে, দীর্ঘ এগারটি মাস বৃথা কাটাইয়া দেওয়ার পর একটি মাত্র মাস আল্লাহর এবাদতে প্রাণপণ চেষ্টায় লাগিয়া যাইবে। যাহারা চাকুরীজীবী; সকাল দশটা হইত চারটা পর্যন্ত অফিসে থাকিতে বাধ্য, তাহারা ফজর হইতে দশটা পর্যন্ত অন্ততঃ রমযান মাসটি যদি তেলাওয়াতের মধ্যে কাটাইয়া দেন তবে এক মাসের জন্য ইহা এমন কি কঠিন কাজ! নিজের দুনিয়াবী কাজের জন্য তো অফিসের বহিরে অবশ্য সময় করিয়াই লওয়া হয় ।
(তাহা হইলে দ্বীনের জন্য ও এবাদতের জন্য সময় বাহির করিতে কি মুশকিল হইব।) যাহারা কৃষিজীবী তাহারা তো কাহারও অধীনস্থ নহেন এবং সময় পরিবর্তন করার ব্যাপারেও তাহাদের কোন বাধা নাই। এমনকি ক্ষেত-খামারে বসিয়াও তাহারা কুরআন তেলাওয়াত করিতে পারেন। আর যাহারা তেজারত ও ব্যবসা – বানিজ্য রহিয়াছেন, তাহাদের জন্য তো রমযান মাসে দোকানদারীর সময় একটু কম করিয়া নেওয়া মোটেও কঠিন নয় । অথবা দোকানে বসিয়াই ব্যবসার সাথে সাথে কুরআন তেলাওয়াতের কাজও করি করিয়া নিবেন। কেননা, আল্লাহ তায়ালার পবিত্র কালামের সাথে এই মুবারক মাসের বড় বেশী খাছ সম্পর্কে রহিয়াছে। এই কারণেই আল্লাহ তায়ালার সব কয়টি কিতাব সাধারণতঃ এই মাসেই নাযিল হইয়াছ। যেমন পবিত্র কুরআন লাওহে মাহফূজ হইতে দুনিয়ার আসমানে সম্পুর্ণত এই মাসেই নাজিল হইয়াছে। সেখানে হইতে প্রয়োজন মত অল্প অল্প করিয়া তেইশ বৎসরে দুনিয়াতে নাযিল হইয়াছে। ইহা ছাড়া হযরত ইবরাহীম (আঃ) এর সহীফাসমূহ এই মাসেই পহেলা তারিখে অথবা তেসরা (অর্থাৎ তিন) তরিখে নাযিল হইয়াছে। হযরত দাউদ (আঃ) কে ১৮ ই রমযানে অথবা ১২ আ রমযানে যাবূর কিতাব দেওয়া হইয়াছে। হযরত মূসা (আঃ) কে ৬ই রমযানে তাওরাত কিতাব দেওয়া হইয়াছে। হযরত ঈসা (আঃ) কে ১২ অথবা ১৩ই রমযানে ইঞ্জীল দেওয়া হইয়াছে । ইহাতে বুঝা যায় যে, আল্লাহর কালামের সহিত এই মাসের বিশেষ সম্পর্ক রহিয়াছে । এই কারনেই এই মাসে বেশী বেশী কুরআন তেলাওয়াতের কথা বর্ণিত হইয়াছে এবং বুযুর্গ মাশায়েখগণ ইহাকে নিজেদের আদর্শ ও নিয়মিত আমল বানাইয়া লইয়াছেন। হযরত জিবরাঈল (আঃ) প্রতি বৎসর রমযান মাসে সম্পূর্ণ কুরআনশরীফ নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লামকে শুনাইতেন। কোন কোন রেওয়ায়াতে আসিয়াছে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হইতে শুনিতেছেন।
হাফেজদের দুই দুইজন মিলিয়া কুরআন শরীফ ’দাওর’ করার যে নিয়ম চালু আছে, উপরোক্ত দুই হাদীস মিলাইয়া ওলামায়ে কেরাম এই নিয়মকে মুস্তাহাব কলিয়াছেন । মোট কথা, যতবেশী সম্ভব কুরআন তেলাওয়াতের বিশেষ এহতেমাম করিবে। আর তেলাওয়াতের পর যে সময় বাঁচিয়া যায় উহাও নষ্ট করা ঠিক হইবে না । কেননা, হযরতনবী করীম সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই হাদীসে শেষ অংশে চারটি জিনিসের প্রতি বিশেষভাবে মনোযোগ আকর্ষন করিয়াছেন; এই মাসে এই কাজগুলি বেশী বেশী পরিমাণে করিবার হুকুম করিয়াছেন। কাজগুলি হইল- কালেমা তাইয়্যিবাহ, এস্তেগফার, জান্নাত হাসিল করার ও জাহান্নাম হইতে বাঁচার দোয়া করা । কাজেই যতটুকু সময় পাওয়া যায় উহাকে এই চার আমলের মধ্যে খরচ করা নিজের জন্য পরম সৌভাগ্য মনে করিব। এরুপ করার দ্বারাই হযরত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীসের প্রতি ভক্তি ও কদর করা হইয়াছে। বলিয়া প্রতীয়মান হইবে। আর ইহা এমন কি কঠিন ব্যাপার যে, নিজের দুনিয়াবী কাজে মশগুল থাকিয়াও জবানে দুরূদ শরীফ ও কালেমায়ে তাইয়্যেবা পড়িতে থাকিবে। কাল কিয়ামতের দিন এই কথা বলিবার যেন মুখ থাকে-
অর্থাৎ, যদিও আমি জামানার অত্যাচারে জর্জরিত ছিলাম, তবুও তোমার স্মরণ হইতে (হে আল্লাহ! একেবারে ) গাফেল থাকি নাই। অতঃপর হযরত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই মাসের কিছু বৈশিষ্ট্য ও আদবের কথা এরশাদ করিয়াছেন। প্রথমতঃ ইহা ছবরের মাস। অর্থাৎ রোযা রাখার কারণে যদি কিছু কষ্ট হয়, তবে এই কষ্ট খুশী মনে সহ্য করা চাই। ধর-মার হাঁক-ডাক যেন না হয়, যেমন গরমের দিনের রোযায় অনেককেই এইরূপ করিতে দেখা যায়। এমনিভাবে যদি কখনও সেহরী না খাওয়া হইয়া যায়। তদ্রুপ রাত্রে তারাবীতে যদি কষ্ট হয় খুশী মনে উহা সহ্য করা চাই। ইহাকে আপদ বা মুসীবত মনে করিবে না; এইরূপ মনে করা খুবই মারাক্তক মাহরূমী ও বঞ্চনার আলামত। যেখানে আমরা সামান্য দুনিয়াবী স্বার্থ উদ্ধার করিবার জন্য খানাপিনা, আরাম –আয়েশ সবই ছড়িয়া দিতে পারি, সেখানে আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির মোকাবিলায় এইসব বস্তুর কি মূল্য থাকিতে পারে? অতপরঃ এরশাদ হইয়াছে যে, ইহা সহানুভূতির মাস। অর্থাৎ গরীব-মিসকীনদের প্রতি দয়া ও সদ্ব্যবহার করার মাস । নিজের ইফতারীর জন্য যদি দশ রকমের জিনিস তৈয়ার করিয়া থাকি, তবে গরীবের জন্য তো অন্ততঃ দুই চার রকমের হওয়া উচিত। আসল নিয়ম তো ছিল তাহাদেকে ভালোটাই দিয়া দেওয়া; তা না হইলে অন্ততঃ সমান করা। কাজেই যতখানি হিম্মত হয় নিজের সেহরী ও ইফতারীতে গরীবদেরও একটি অংশ অবশ্যই রাখা উচিত । সাহাবায়ে কেরাম (রাযিঃ) উম্মতের জন্য তাহাদের আমলের সুপ্রশস্ত রাজপথ খোলা রহিয়াছে; উহাকে অনুসরণ করিয়া চলিলেই হইবে। ’ঈছার’ অর্থাৎ অন্যেকে প্রধান্য দেওয়া ; নিজের উপর অন্যকে আগে বাড়াইয়া দেওয়া, অন্যের প্রতি সহমর্মিতা করা – এইসব ক্ষেত্রে সাহাবায়ে কেরামের মত মহান ব্যক্তিদের অনুসরণ করার জন্যও সাহসী মানুষের দরকার । শত শত হাজার হাজার ঘটনা তাঁহাদের এমন আছে যেগুলি শুনিয়া কেবল আশ্চার্য হইতে হয়। উদাহরণ স্বরূপ একটি ঘটনা লিখিতেছি- হযরত আবূ জাহম (রাযিঃ) বলেন, ইয়ারমুকের যুদ্ধে আমার চাচাত ভাইয়ের সন্ধানে বাহির হইলাম এবং এই মনে করিয়া এক মশক পানিও সঙ্গে লইলাম যে, যদি তাঁহার জীবনের শেষ নিঃশ্বাসও বাকী থাকে, তবে তাঁহাকে পানি পান করাইয়া পানি চাহিলেন। এমন সময় সামনের দিক হইতে আরেকজন আহত ব্যক্তি আহ করিয়া উঠিলেন। তখন আমার চাচাত ভাই নিজে পানি পান না করিয়া সেই ব্যক্তিকে পানি পান করাইতে ইশারা করিলেন। তাহার নিকট গিয়া জিজ্ঞাসা করিয়া জানিতে পারিলাম তিনিও পিপাসা পিপাসার্ত এবং পানি চাহিতেছেন। এমন সময় তাহার পার্শ্বের আরেক ব্যক্তি ইশারায় পানি চাহিলেন। তখন দ্বিতীয় ব্যক্তিও পানি পান না করিয়া ঐ (তৃতীয়) ব্যক্তির নিকট যাইতে ইশারা করিলেন। আমি এই শেষ ব্যক্তির নিকট পৌঁছিয়াই দেখিতে পাইলাম তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করিয়াছেন। ফিরিয়া দ্বিতীয় ব্যক্তির নিকট আসিলাম । দেখিলাম তিনিও শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করিয়াছেন। অতঃপর ফিরিয়া চাচাত ভাইয়ের নিকট পৌঁছিলাম। এইখানেও আসিয়া দেখিতে পাইলাম, তিনিও শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করিয়াছেন্ এই ছিল আমাদের পূর্বপুরুষদের স্বার্থ-ত্যাগ ও অন্যেকে নিজের উপর প্রধ্যান্য দেওয়ার নমুনা। নিজেরা পিপাসায় কাতর হইয়া জীবন দিয়া দিলেন; তবু অপরিচিত ভাইয়ের আগে পানি পান করা পছন্দ করিলেন না । আল্লাহ তাঁহাদের উপর রাজী হইয়া যান, তাঁহাদেরকে খুশী করুন এবং আমাদেরকে তাহাদের অনুসরণ করার তাওফীক দান করুন, আমীন। ’রূহুল বয়ান’ কিতাবে আল্লামা সুয়ূতী (রহঃ) এর ‘জামে সগীর’ এবং আল্লামা সাখাবী (রহঃ) এর ‘মাকাসেদ’ কিতাবদ্বয়ের বরাত দিয়া হযরত ইবনে ওমর (রাযিঃ) এর সূত্রে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এরশাদ বর্ণনা করা হইয়াছে যে, আমার উম্মতের মধ্যে সব সময় পাঁচশত বাছাই করা বুযুর্গ বান্দা এবং চল্লিশজন আবদাল থাকেন। তাঁহাদের মধ্যে কেহ ইন্তেকাল করিলে তখনই অন্য একজন তাহার স্থলাভিষিক্ত হইয়া যান। সাহাবায়ে কেরাম আরজ করিলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এই সকল লোকের বিশেষ আমলসমূহ কি কি? হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ ফরমাইলেন, তাহারা জুলুমকারীদেরকে মাফ করিয়া দেন, দুর্ব্যবহারকারীদের সাথেও তাহারা সদ্ব্যবহার করেন এবং আল্লাহর দেওয়া রিযিকের দ্বারা তাহারা মানুষের সঙ্গে দয়া ও সহানুভূতির আচরণ করিয়া থাকেন। উপরোক্ত কিতাবে আরেক হাদীস হইতে বর্ণনা করা হইয়াছে যে, যে ব্যক্তি ক্ষুধার্তকে রুটি খাওয়াইবে, বস্ত্রহীনকে কাপড় পরাইবে অথবা মুসাফিরকে রাত্রিযাপনের জন্য জায়গা দিবে আল্লাহ তায়ালা কিয়ামতের ভয়াবহ পরিস্থিতিতে তাহাকে আশ্রয় দান করিবেন । ইয়াহইয়া বারমাকী (রহঃ) সুফিয়ান সাওরী (রহঃ) এর জন্য প্রতি মাসে একহাজার দেরহাম খরচ করিতেন। সুফিয়ান সাওরী (রহঃ) সেজদায় এই বলিয়া দোয়া করিতেন- হে আল্লাহ! ইয়াহইয়া আমার দুনিয়ার প্রয়োজন মিটাইয়াছে, তুমি মেহেরবানী করিয়া তাহার আখেরাতের প্রয়োজন মিটাইয়া দাও। ইহাহইয়া বারমাকী (রহঃ) এর ইন্তেকালের পর লোকেরা তাহাকে স্বপ্ন দেখিল। তাহার হাল –অবস্থা জানিতে চাহিলে তিনি বলিলেন, সুফিয়ান সাওরীর দোয়ার বদওলতে বামার মাগেফেরাত হইয়া গিয়াছে। অতঃপর হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্যকে ইফতার করাইবার ফযীলত বর্ণনা করিয়াছেন। অন্য হাদীসে আছে, যে ব্যক্তি হালাল কামাই দ্বারা রমযান মাসে কাহাকেও ইফতার করায়, তাহার উপর রমযানের রাত্রসমূহে ফেরেশতারা রহমত পাঠাইতে থাকেন এবং শবে কদরে হযরত জিবরাঈল (আঃ) যাহার সহিত মোসাফাহা করেন, তাহার দিলে নম্রতা পয়দা হয় এবং তাহার চক্ষু হইতে অশ্রু ঝরিতে থাকে। হাম্মাদ ইবনে সালামা (রহঃ) বিখ্যাত মুহাদ্দিস ছিলেন; তিনি প্রতিদিন পঞ্চাশজন রোযাদারকে ইফতার করাইতেন। ইফতারের ফযীলত বর্ণনা করিবার পর এরশাদ ফরমাইয়াছেন, এই মাসের প্রথম অংশ রহমত; অর্থাৎ এই অংশের আল্লাহ তায়ালার নেয়ামত ও পুরস্কার আগাইয়া আসিতে থাকে এবং আল্লাহ তায়ালার নেয়ামত ও পুরুস্কার আগাইয়া আসিতে থাকে এবং আল্লাহ তায়ালার নেয়ামত ও পুরস্কার আগাইয়া আসিতে থাকে। এবং আল্লাহ তায়ালার এই ব্যাপক রহমত সাধারণভাবে সকল মুসলমানের জন্য হইয়া থাকে। অতঃপর যাহারা এই রহমতের বর্ষণ আরও বাড়াইয়া দেওয়া হয়-
অর্থাৎ তোমরা শোকর করিলে অবশ্যই আমি (নেয়ামত ও পুরস্কার) বাড়াইয়া দিব। (সূরা ইবরাহীম, আয়াতঃ৭) এই মাসের মাঝের অংশ হইতে মাগফেরাত অর্থাৎ গোনাহমাফী শুরু হইয়া যায় । কারণ, রোযার কিছু অংশ অতিবাহিত হইয়াছ; উহার বদলা ও সম্মান স্বরূপ মাগফেরাত শুরু হেইয়া যায় । আর এই মাসের শেষ অংশে তো আগুন হইতে মুক্তির সুসংবাদ বর্ণিত হইয়াছ। রমযানকে তিন ভাগে ভাগ করা হইয়াছে, যেমন উপরে বর্ণিত হাদীস হইতে জানা গিয়াছ। অধম বান্দার মতে রহমত, মাগফেরাত ও জাহান্নাম হইতে মুক্তি- এই তিন অংশের মধ্যে পার্থক্য এই যে, মানুষ তিন প্রকারের হইয়া থাকে- এক, ঐ সমস্ত লোক যাহাদের উপর গোনাহের বোঝা নাই; এই সমস্ত লোকের জন্য তো রমযানের শুরু হইতেই রহমত এবং নেওয়ামত ও পুরস্কারের বৃষ্টি বর্ষণ শুরু হইয়া যায় । দ্বিতীয় প্রকার ঐ সমস্ত লোক যাহারা মামুলী গোনাহগার; তাহাদের জন্য রমযানের কিছু অংশ রোযা রাখিবার পর এই রোযার বরকতে ও বদলায় মাগফেরাত হয় । আর তৃতীয় প্রকার ঐ সমস্ত লোক যাহারা বেশী গোনাহগার; তাহাদের জন্য রমযানের বেশীর ভাগ রোযা রাখিবার পর জাহান্নাম হইতে মুক্তি হইতেই তাহাদের গোনাহ মাফ হইয়াছিল তাহাদের জন্য যে কি পরিমাণ আল্লাহর রহমতের স্তূপ লাগিয়া যাইবে, উহা বলার অপেক্ষা রাখেনা । অতঃপর হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও একটি জিনিসের প্রতি উৎসাহ প্রদান করিয়াছেন । উহা হইল এই যে, যাহারা মালিক বা মনিব অর্থাৎ যাহাদের অধীনে শ্রমিক কর্মচারী কাজ করিয়া থাকে্ তাহারা যেন এই মাসে কর্মচারীদের কাজ হালকা করিয়া দেন। কেননা, তাহারাও তো রোযাদার; আর রোযা অবস্থায় কাজ বেশী হইলে রোযা রাখা কঠিন হয় । অবশ্য যদি কাজের পরিমাণ বেশী হয় তবে শুধু রমযান মাসে এক-আধজন কর্মচারী সাময়িকভাবে বাড়াইয়া নিলে কোন ক্ষতি নাই। কিন্তু ইহা তখনই করা হইবে যখন কর্মচারীগণও রোযাদার হয় । রোযাদার না হইলে তাহাদের জন্য তো রমযান মাস ও অন্যান্য মাস এক বরাবর। আর যে মালিক নিজেই রোযা রাখে না ; বেহায়া মুখে রোযাদার কর্মচারীদের দ্বারা কাজ নেয় এবং নামায- রোযার কারণে কাজে একটু শিথিলতা হইলে অকথ্য বর্ষণশুরু করিয়া দেয় তাহাদের জুলুম ও নির্লজ্জতার কথা আর কি বলার আছে! অর্থাৎ জালেমরা অতিসত্বর জানিতে পারিবে-তাহারা কোন ভয়াবহ স্থানের দিকে অগ্রসর হইয়াছে অর্থাৎ জাহান্নামের দিকে । (সূরা শ ‘আরা , আয়াতঃ ২২৭)
অতঃপর নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযান মাসে চারটি কাজ বেশী বেশী করার হুকুম করিয়াছেন। প্রথমতঃ কালেমায়ে শাহাদত। অনেক হাদীসে এই কলেমায়ে শাহাদতকে সর্বশ্রেষ্ঠ যিকির বলা হইয়াছ। মিশকাত শরীফে হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রাযিঃ) হইতে বর্ণিত হইয়াছে যে, হযরত মূসা (আঃ) একবার আল্লাহ তায়ালার নিকট আরজ করিলেন, হে আল্লাহ! আপনি আমাকে এমন একটি দোয়াবলিয়া দিন যাহার দ্বারা আমি আপনাকে স্বরন করিতে করিব এবং দোয়া করিব। আল্লাহ তায়ালার দরবার হইতে লা ইলাহা আল্লল্লাহ- এর কথা বলিয়া দেওয়া হইল । হযরত মূসা (আঃ) আরজ করিলেন, হে আল্লাহ! এই কালেমা তো আপনার সকল বান্দাই পড়িয়া থাকে; আমি তো এমন একটি দোয়া বা যিকির চাই, যাহা শুধু আমার জন্যই খাছ হইবে। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ ফরমাইলেন, হে মূসা ! আমাকে ব্যতীত সাত আসমান ও উহার আবাদকারী সমস্ত ফেরেশতা এবং সাত যমীনকে যদি এক পাল্লায় রাখা হয় আর অপর পাল্লায় কালেমা তাইয়্যেবাকে রাখা হয় তবে কালেমা তাইয়্যেবার পাল্লাই ভারী হইয়া যাইবে। এক হাদীসে আছে, যে ব্যক্তি এখলাসের সহিত এই কালেমা পড়ে, তৎক্ষণাৎ তাহার জন্য আসমানের দরজাসমূহ খূলিয়া যায় এবং আরশ পর্যন্ত এই কালেমা পৌঁছিতে কোন বাধা থাকে না; তবে ইহার পাঠাকারীকে কবীরা গোনাহসমূহ হইতে বাঁচিয়া থাকিতে হইবে। আল্লাহ তায়ালার চিরাচরিত আদত ও নিয়ম হইল যে, সাধারণ প্রয়োজনীয় জিনিসসমূহ তিনি প্রচুর পরিমাণে দিয়া থাকেন এবং ব্যাপক করিয়া থাকেন। গভীর চিন্তা করিলে দেখা যায়ে যে, দুনিয়াতে যে জিনিসের প্রয়োজন যত বেশী সেই জিনিসকে আল্লাহ তায়ালা ততই ব্যাপক করিয়া দিয়াছেন। যেমন পানি একটি ব্যাপক প্রয়োজনীয় জিনিস; আল্লাহ তায়ালা অসীম সহমতে ইহাকে কত ব্যাপক করিয়া দিয়াছেন! অথচ ‘কিমিয়া’ (মাটি, তামা ইত্যাদি কম মূল্যের পদার্থকে স্বর্ণ বানাইবার প্রক্রিয়া) এর মত অনর্থক ও বেকার বিষয়ক কত দুষ্প্রাপ্র করিয়া রাখিয়াছেন। এমনি ভাবে কালেমায়ে তাইয়্যেবা হইল সর্বশ্রেষ্ঠ যিকির- বহু হাদীস দ্বারা এই কথা জানা যায় যে, সমস্ত যিকির – আযকারের উপর কালেমা তাইয়্যেবার প্রাধান্য রহিয়াছে; যাহাতে কেহই মাহরূম না থাকে। এতদসত্বেও যদি কেহ মাহরূম থাকে তবে ইহা তাহারই দুর্ভাগ্য । মোটকথা, বহু হাদীসে কালেমা তাইয়্যেবার ফযীলতে বর্ণিত হইয়াছে; কিতাব সংক্ষিপ্ত করার জন্য সেইগুলি উল্লেখ করা হইল না । দ্বিতীয় কাজ যাহা রমযান মাসে বেশী পরিমাণে করিবার জন্য হুকুম করা হেইয়াছে, তাহা হইল , এস্তেগফার অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালর নিকট গোনাহের জন্য ক্ষমা চাওয়া । বহু হাদীসে এস্তেগফারেরও অনেক ফযীলত বর্ণিত হইয়াছে । এক হাদীসে আছে-’যে ব্যক্তি বেশী পরিমাণে এস্তেগফার করিবে আল্লাহ তায়ালা যে কোন অভাব ও সংকটের সময় তাহার জন্য রাস্তা খুলিয়া দিবেন, যে কোন দুঃখ ও দুশ্চিন্তা দূর করিয়া দিবেন এবং তাহার জন্য এমন রুজি- রোজগারের ব্যবস্থা করিয়া দিবেন যাহা সে কল্পনাও করিতে পারে না।’ আরেক হাদীসে বর্ণিত হেইয়াছে যে, মানুষ মাত্রই গোনাহগার; তবে গোনাহগারদের মধ্যে উত্তম হইল ঐ ব্যক্তি যে তওবা করিতে থাকে।’ এক হাদীসে আছে- ‘মানুষ যখন গোনাহ করে তখন একটি কালো বিন্দু তাহার দিলের মধ্যে লাগিয়া যায়। যদি সে ঐ গোনাহ হইতে তওবা করে তবে উহা ধুইয়া পরিস্কার হইয়া যায়; নতুবা বাকী থাকিয়া যায়।’ অতঃপর হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুইটি জিনিস চাহিবার জন্য হুকুম করিয়াছেন, যে দুইটি জিনিস ছাড়া কোন উপায় নাই। একটি হইল, জান্নাত পাওয়ার দোয়া আর দ্বিতীয়টি হইল, জাহান্নাম হইতে বাঁচিবার দোয়া। আল্লাহ তায়ালা দয়া করিয়া আমাদের সকলকে উহা দান করুন আমীন।
Go here https://steemit.com/@a-a-a to get your post resteemed to over 72,000 followers.