অন্তরালে
মানুষের ভিতরে কি চলে, তা আসলে বাহির থেকে দেখে বোঝা বড্ড মুশকিল। হাজারো সমস্যা নিয়ে অনেকে হাসি মুখে ভালো থাকার চেষ্টা করে। আমি মনেকরি, মানুষের মতো সেরা অভিনেতা আর কেউ হতে পারে না।
মমিন সাহেব আমার সিনিয়র কলিগ। বর্তমানে শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজে মাইক্রোবায়োলজির সহকারী প্রফেসর হিসেবে নিযুক্ত আছেন। আমি যখন এই মফস্বলের হাসপাতালে অনারারি মেডিকেল অফিসার হিসেবে নিযুক্ত ছিলাম ঠিক সেই সময় থেকেই তার সঙ্গে আমার এটা সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।
দীর্ঘ এক বছরের মত তার সঙ্গে আমি ইমারজেন্সি ডিউটি করেছিলাম। ভদ্রলোক আসলে চাইলেই মেডিকেলের শিক্ষকতার পেশা না করে, বাহিরে প্র্যাকটিস করেই বেশ ভালো ক্যারিয়ার গড়তে পারতো, তবে শিক্ষকতার প্রতি তার দুর্বলতা বেশ আগে থেকেই ছিল। তাই সেই লক্ষ্যেই পরবর্তীতে এই মফস্বল থেকে বদলি হয়ে বগুড়া মেডিকেলে যোগদান করেন।
যদিও আমি মেডিকেল প্রফেশন ইস্তফা দিয়েছি প্রায় অনেক দিন হচ্ছে, তবে তারপরেও বাস্তবিক জীবনে পুরনো কলিগদের সঙ্গে কিছুটা সম্পর্ক আছে। গিন্নি কয়েকদিন থেকে ভীষণ মাথাব্যথায় ভুগছিল। আমি আসলে অসুখ-বিসুখের সমস্যায় পড়লেই মমিন সাহেবের সঙ্গে টুকটাক যোগাযোগ করে নেই।
সেদিন যখন সন্ধ্যের পরে তার এখানকার বাসায় গিয়েছিলাম। প্রতিদিন এই মফস্বল থেকেই ভদ্রলোক বগুড়া যাতায়াত করে। এই কষ্ট লাঘবের জন্য একসময় সিদ্ধান্তই নিয়েছিল বগুড়াতে ফ্ল্যাট কিনবে। যেমন চিন্তাধারা ছিল, সেই ভাবনায় এগিয়ে গিয়ে একসময় সবেমাত্র রেডি ফ্ল্যাট কিনেছিল। ভেবেই বসেছিল, এই রোজকার যাতায়াতের কষ্ট মনে হয় লাঘব হবে। তবে ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়নি।
সন্ধ্যেবেলার দিকে তার বাসায় গিয়ে যখন তার সঙ্গে যোগাযোগ করলাম, তখন আমি তার এই ব্যাপারগুলো কিছুই জানতাম না। আমি তো গিয়ে স্বার্থপরের মত নিজের সমস্যা নিয়ে হাজির হয়েছি। তারপরেও ভদ্রলোক আমার সমস্যার কথা শুনে, আমার গিন্নির অবস্থা বুঝে কিছু ওষুধ লিখে দিল আর বলল ঠিকমত ঘুমানোর জন্য এবং চোখের ডাক্তার দেখিয়ে নেওয়ার জন্য।
তার আসলে বাহ্যিক অবস্থা দেখে বোঝার কোন উপায় নেই যে, তার মনের ভিতরে কি চলছে। মানুষ কিভাবে নিজেকে এত শক্ত করে, হাজারো সমস্যা নিয়ে সকলের সামনে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করে, হয়তো সেটা তাকে না দেখলে আমি জানতেই পারতাম না।
বাসায় এসে যখন সোশ্যাল মিডিয়ার নিউজ ফিডটা ঘাঁটাঘাঁটি করার চেষ্টা করছি, তখনই দেখলাম মমিন সাহেব চারদিন আগে স্ট্যাটাস দিয়েছিল, সে আসলে স্বেচ্ছায় তার সবেমাত্র কেনা রেডি ফ্ল্যাটটি বিক্রি করে দিতে চায়। কারণ হিসেবে যেটা লিখেছে, তা পড়ে রীতিমতো আমি মর্মাহত হয়েছি। সমসাময়িক সময়ে তার বাবা-মা দুজনেই মারা গিয়েছে এবং সে ভীষণ আর্থিক সমস্যায় পড়ে গিয়েছে । শেষ যেবার তার সঙ্গে, তার বাবা-মার অসুস্থতার ব্যাপার নিয়ে কথা হয়েছিল তাও সেটা বহুদিন আগে। এমনিতেই তারা বয়স্ক মানুষ ছিল, তার ভিতরে দুরারোগ্য ব্যাধি ক্যান্সার আক্রমণ করেছিল তার বাবা-মা উভয়ের শরীরেই।
সে নিজে এত বড় মেডিকেল কলেজের প্রফেসর হয়েও, তারপরেও তার বাবা-মা দুজনকে নিয়েই দেশ-বিদেশ বহু ছোটাছুটি ও অর্থ খরচ করেছে চিকিৎসার জন্য। তবে তার বাবা-মার শেষ পরিণতি অনেকটা করুণ ছিল, মৃত্যুর কাছে মমিন সাহেবের ছোটাছুটির পর্ব থেমে গিয়েছিল।
এই ঘটনা মাত্র কয়েকদিন আগের, অথচ আমি সেভাবে খেয়াল করতে পারিনি। তারপরও আজ সন্ধ্যাতে যখন তার কাছ থেকে, আমার গিন্নির জন্য ওষুধপত্র লিখে নিয়ে আসলাম, তখনো ভদ্রলোক আমাকে কিছুই বুঝতে দিলো না। তার ভিতরে যে এত ঝুট ঝামেলা চলছে, তারপরও সে হাসি মুখে আমার সঙ্গে কথা বলেছিল।
বড্ড অপরাধবোধ, নিজের ভিতরে কাজ করছিল। নিউজটা দেখার পরপরই তাকে আবারও মুঠোফোনে ফোন দেওয়ার চেষ্টা করলাম এবং সেই সময় আসলে কি বলবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না, শেষমেষ তাকে বলেই ফেললাম, তার সোশ্যাল মিডিয়ার স্ট্যাটাসটা সম্পর্কে। সেই সময়েও সে আমাকে হাসিমুখেই বলছিল, আসলে বাবা-মার চিকিৎসা বাবদে অনেকগুলো পয়সা খরচা হয়ে গিয়েছে, অনেক আত্মীয়-স্বজনের কাছে ধার-দেনাও হয়ে গিয়েছে, তাই অবশেষে ফ্ল্যাট বিক্রির সিদ্ধান্তটা নিয়েছি।
যদি কখনো আবার সময় সুযোগ হয়, তাহলে না হয় পরবর্তীতে আবারো ফ্ল্যাট কিনে নেব। তবে আপাতত আত্মীয় স্বজনের ধার-দেনা থেকে মুক্তি হতে চাই । এমন কথার পরিপ্রেক্ষিতে আসলে কি জবাব দিতে হয়, তা আমার জানা নেই। তবে চুপচাপ কথাগুলো শুনে, ফোনটা রেখে দিলাম।
ডিসকর্ড লিংক
https://discord.gg/VtARrTn6ht
250 SP | 500 SP | 1000 SP | 2000 SP | 5000 SP |
VOTE @bangla.witness as witness
OR
<center><sub>Posted using [SteemPro Mobile](https://play.google.com/store/apps/details?id=com.steempro.mobile)</sub></center>
https://twitter.com/sharifShuvo11/status/1697183623685009522?t=iQLZ-wbX_EHu4zF6HvJn7g&s=19
আমি মনে করি প্রতিটি মানুষ প্রতিনিয়ত কমবেশি অভিনয় করে থাকে। আমরা যখন কাউকে জিজ্ঞেস করি ভালো আছে কিনা,প্রতিত্তোরে খারাপ থাকলেও বলে যে ভালো আছি। আসলে না বলে উপায়ও নেই। কারণ খারাপ লাগার কারণ কাছের মানুষের সাথেও শেয়ার করা যায় না এখন। কারণ একে তো সবাই সবার মতো ব্যস্ত,আর দ্বিতীয়ত খারাপ লাগার কারণ বললে অনেক সময় সেটাকে দুর্বলতা হিসেবে চিহ্নিত করে। পরবর্তীতে নিজের ই ক্ষতি হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এমনটাই হচ্ছে বর্তমানে। তবে মমিন সাহেবের ব্যাপারটা জেনে খুব খারাপ লাগলো। এতো শখ করে ফ্ল্যাট কিনলেন, কিন্তু দেনার জন্য বিক্রি করতে হচ্ছে। এতো কিছু করেও মা বাবাকে বাঁচাতে পারলেন না। এতো কষ্ট মনের মধ্যে চাপা রেখে আপনার সাথে কতো সুন্দর ভাবে কথাবার্তা বললেন। যাইহোক মমিন সাহেবের জন্য অনেক অনেক দোয়া এবং শুভকামনা রইল।
আসলে মমিন সাহেবের ব্যাপারটা ছিল বেশ হৃদয়স্পর্শী।
আসলে মানুষের জীবনে কখন কার কি ঘটে যায় সেটা বুঝা বেশ মুশকিল। যেমন আপনার সিনিয়র কলিগ মমিন ভাইয়ের হয়েছে। সেটা যে কারো হতে পারে যে কোন সময়। অনেক ছোটাছুটি করলেন জীবনকে একটি ভালো পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। এবং শেষ মেষ উনার আশা পূর্ণ হল। সুন্দর ফ্ল্যাট কিনলো কিন্তু সেই ফ্ল্যাট রাখতে পারলো না। কিন্তু কে জানতো এমন একটি ঘটনা ঘটবে। এক সাথে বাবা-মা দুজনে মরণ ব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে চলে গেলেন। মানুষের বাহ্যিক অবস্থা দেখে বুঝা যায় না মানুষ কোন অবস্থায় আছে। অনেক দুঃখজনক একটি ঘটনা শেয়ার করলে খুবই খারাপ লাগলো পড়ে।
আসলেই আপু কখনকার জীবনে কি ঘটে যাবে তা বোঝা বড্ড মুশকিল। ধন্যবাদ আপনার সাবলীল মন্তব্যের জন্য।