ডেথ ক্লিয়ারেন্স

in আমার বাংলা ব্লগ10 months ago

home-5094603_1280.jpg
source

এইতো বছর পাঁচেক আগে, হোসেন সাহেব সেবার হঠাৎই ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে গিয়েছিল। মোটামুটি একপ্রকার টাকার জোরেই দুটো বছর আরো বেশি সময় বেঁচে ছিলেন।

দেশ-বিদেশ পাড়ি দিয়ে ঘুরে ঘুরে ক্রমাগত ক্যান্সারের কেমোথেরাপি গুলো প্রতিনিয়ত নিচ্ছিল, যেহেতু চেম্বারের সামনে দিয়ে প্রতিনিয়ত যাতায়াত করতো, তাই প্রতিবারই তাকে টুকটাক দেখার সুযোগ হত। সেই সময়টাতে তাকে যতবার দেখেছি, ততবারই মনে হচ্ছিল অনেকটা শারীরিকভাবে দুর্বল। তাও ভদ্রলোক চেষ্টা করেছিলেন তার উপর অর্পিত দায়িত্ব গুলো ঠিকঠাক মতো করার জন্য।

প্রচন্ড সাহসিকতার মানসিকতার মানুষ ছিলেন, তাই হয়তো ক্যান্সার পুরো শরীরে ছড়িয়ে যাওয়ার পরেও ধুঁকে ধুঁকে যেন বেঁচে ছিলেন। তিনি বুঝতে পারতেন, মৃত্যু তাকে যেকোনো সময় ঘায়েল করে ফেলবে। তারপরেও নিজের শুভাকাঙ্ক্ষী ও প্রিয়জনদের কথা ভাবতেন। মাঝে মাঝেই সোশ্যাল মিডিয়াতে নিজের অনুভূতির কথা ব্যক্ত করতেন।

তবে আফসোস যে মানুষটা একটা সময় সকলের কেন্দ্রবিন্দু হয়েছিলেন তাকেও একটা সময়ের পরে গিয়ে ধীরে ধীরে সবাই ভুলে যাতে লাগলো এবং শেষ সময়ে তার সঙ্গে অনেকে যোগাযোগও কমিয়েও দিয়েছিল। হয়তো এটাই পৃথিবীর নিয়ম। যে যত জনপ্রিয় তার বাহিরের জীবনে হয়তো সে ততটাই নিঃস্ব তার একান্তই ব্যক্তিগত জীবনে।

সুস্থ সবল মানুষটা ধীরে ধীরেই ক্যান্সার ধরা পড়ার পর থেকে যেন মলিন হয়ে যাচ্ছিল। মাঝে মাঝে শুনছিলাম হোসেন সাহেব খেতে পারছে না, তার ঠিকঠাক ঘুম হচ্ছে না এবং তার শারীরিক নানা রকম জটিলতা। যেহেতু একদম প্রতিবেশী ছিলাম, তাই খবরগুলো কানে আসতো।

মৃত্যু প্রত্যেকেরই হবে আজ অথবা কাল, তবে কার মৃত্যুতে কত মানুষ কিভাবে শোক প্রকাশ করবে সেটাই হয়তো মুখ্য বিষয়। এজন্যই বলে হয়তো মানুষ বাঁচে তার কর্মের মধ্যে। লোকটাকে নিয়ে আমি অহেতুক মন্তব্য করতে চাই না, তবে তার মৃত্যুর একদম শেষ সময়ে আমি তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম। বলা যায়, অনেকটা নিজে পর্যবেক্ষণ করে তার পরিবারের লোকজনকে অবশেষে জানিয়ে দিয়েছিলাম সে আর বেঁচে নেই।

এই এলাকাটাতে সাতশো পরিবারের বসবাস আর তখন আমি একদম নবীন চিকিৎসক। একটা মানুষের ডেথ ক্লিয়ারেন্স করা কিছুটা জটিলতা সম্পন্ন ব্যাপার। আজ আমার সেই কথাটাই মনে পড়ছে, পাঁচ বছর আগে ঠিক এই দিনটাতেই হঠাৎই হোসেন সাহেবের ক্রমাগত শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। কেমো নিতে নিতে শরীরের অবস্থাটাই নাজুক হয়ে গিয়েছিল, যেন কঙ্কাল শরীর বিছানার সঙ্গে লেগে আছে।

শেষ সাত দিন ধরে তিনি মুখে কিছুই খেতে পারেনি, নাকের একপাশে তখনো নল লাগানোই ছিল আর দুহাতে ক্যানুলা। সবকিছুই শিরায় প্রবেশ করিয়ে অনেকটা বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা। তবে দীর্ঘদিন বেঁচে ছিল এটা ঠিক, তবে সুস্থ হতে পারেনি।

রাসেল ভাই আমাকে সেদিন কোনরকমে দুপুরের একটু পরেই ফোন দিয়েছিল বলল তোর প্রেশার মাপার মেশিনটা নিয়ে আয় তো আব্বার অবস্থা আরো অনেকটাই নাজুক, আমি বুঝতে পারতেছি না, তুই যদি এসে একটু দেখতি। এমন অবস্থায় অবশ্য কাউকে না বলা যায় না। খুবই তড়িৎ গতিতে বিপি মেশিনটা নিয়ে, ছুটে গেলাম তাদের বাসায়, বারবার মুখ হা করে নিশ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করছিল হোসেন সাহেব।

তবে তার আত্মীয়-স্বজন বা বাসার লোকজন এমনভাবে ঘিরে ধরে রেখেছে তাকে, তাতে যেন ঘরের ভেতরটাতে ভ্যাপসা গরম ছুটছিল। আমি কোনরকমে তাদের বাসাতে গিয়েই বললাম শুধুমাত্র দুই-একজন ছাড়া বাকি সবাইকে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য। আমার এখনো খুব ভালোভাবে মনে আছে, সেই সময় পাশ থেকে কোন এক মহিলা বলেছিল, এই ছোকরা আবার কি করবে।

হোসেন সাহেবের অবস্থা আসলে এতটাই নাজুক ছিল, তখন আর অ্যাম্বুলেন্স বা হাসপাতালে নিয়ে গিয়েও কোন লাভ হতো না। একদম শেষ সময়, আমি তখনও দেখছিলাম তার হাতগুলো ধরে দেখার জন্য, পালস পাই কিনা। শুধু হা করে শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করছে, তবে পালস খুবই ধীরে ধীরে দিচ্ছিল, এক কথায় খুব একটা বোঝাই যাচ্ছিল না।

আমি, রাসেল ভাই আর রাসেল ভাইয়ের বোন আমার পাশে দাঁড়িয়ে, তাছাড়া সবাই ঘরের বাহিরে। স্টেথোস্কোপ বারবার কানে লাগিয়ে বোঝার চেষ্টা করছিলাম, তার হার্টের অবস্থা। খুবই আস্তে অনেকটা সময় পর পর অল্প অল্প শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল।

এমন একটা মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে আছি, যেটা এখনো ভাবলে গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায়। এভাবে মিনিট সাতেক যাওয়ার পরে আমি বুঝতে পারলাম হোসেন সাহেবের আর কোনো সাড়া শব্দ নেই।

আমি বুঝতে পেরেছি সে আর বেঁচে নেই, তবে এই কথাটা হঠাৎই লোকজনকে বলা যায় না। যেহেতু আবেগঘন ব্যাপার মুহূর্তের সৃষ্টি হবে,তাই সময় নেওয়ার চেষ্টা করছিলাম। তার চোখের মনি গুলো দেখার চেষ্টা করছিলাম, সেগুলোর সামনে দিয়ে হাতের আঙ্গুল নাড়ানোর চেষ্টা করছিলাম, দেখছিলাম তার চোখের মনি এদিক-সেদিক নড়াচড়া করে কিনা। সেখানেও কোন প্রতিক্রিয়া দেখতে পেলাম না। আরো কয়েকবার করে তার হাতের পালস দেখার চেষ্টা করলাম সেটাও পেলাম না। এবার বাধ্য হয়ে তার মুখ ও নাকের কাছে, কান নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। দেখলাম শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়ার প্রতিক্রিয়া আছে কিনা সেখানেও কোন কিছু পেলাম না। বারবার রক্তচাপ দেখার চেষ্টা করলাম এবারও সবকিছুই শূন্য। বুকে স্টেথোস্কোপ লাগিয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম কোন শব্দ পাওয়া যায় কিনা, এবার সেখানেও নিরাশ হলাম।

এভাব যখন আরো দুই তিন মিনিট কেটে গেল, তখন একপ্রকার হোসেন সাহেবের ছেলেমেয়েরা আমাকে বারবার বলছিল ঘটনা কি, তখন আমি তাদের বললাম, আমার সীমিত জ্ঞানে যতটুকু বুঝতে পারছি, তা খুব একটা ভালো ঠেকছে না। আপনারা চাইলে একটা ইসিজি করে দেখতে পারেন। আসলে তারাও দীর্ঘসময় দেশ বিদেশের বিভিন্ন হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি করতে করতে অনেক কিছুই কাছ থেকে দেখেছে মেডিকেল প্রফেশনের,তারাও কম বেশি কিছু হলেও বুঝতে পারছিল।

অতঃপর কান্নার রোল শুরু, আমি খুব ধীরে সেখান থেকে চলে আসলাম। দেখতে দেখতে পাঁচ বছর হয়ে গেল, আজ রাসেল ভাই তার ফেসবুক প্রোফাইলে তার বাবার মৃত্যুবার্ষিকী নিয়ে কিছু কথা লিখেছে আর তখনই আমার সেই সময়টার কথা বারবার মনে পড়ছিল। ওটাই ছিল আমার জীবনের প্রথম কারো ডেথ ক্লিয়ারেন্স করা। যা এখনো আমাকে বেশ ভাবিয়ে তোলে।

Banner-16.png

ডিসকর্ড লিংক
https://discord.gg/VtARrTn6ht


20211003_112202.gif


JOIN WITH US ON DISCORD SERVER

banner-abb4.png

Follow @amarbanglablog for last updates


Support @heroism Initiative by Delegating your Steem Power

250 SP500 SP1000 SP2000 SP5000 SP

Heroism_3rd.png

VOTE @bangla.witness as witness


witness_vote.png

OR

SET @rme as your proxy

witness_proxy_vote.png

Sort:  
 10 months ago 

আসলেই ব্যাপারটা হৃদয়বিদারক।
উপর ওয়ালা তাকে বেহেশত নসিব করুন।
এই পরিস্থিতিটা সত্যিই খুব কঠিন ছিল আপনার জন্য বুঝতেই পারছি।
লোকটি শেষ বয়সে এসে অনেক কষ্ট করেছেন বুঝতে পারলাম। আসলে শেষ বয়সটা কেন যেন এতো কঠিন হয়ে ওঠে আল্লাহ পাক ভালো জানেন।

Posted using SteemPro Mobile

 10 months ago 

হ্যাঁ, ভদ্রলোক শেষ বয়সে এসে বেশ ভালোই কষ্ট পেয়েছিল ক্যান্সার ব্যাধিতে।

 10 months ago 

এমন হৃদয়বিদারক ঘটনা গুলো আসলেই কখনো ভোলা যায় না। হোসেন সাহেবের ব্যাপারে জেনে খুব খারাপ লাগলো। আসলে মানুষের জীবনটা এমনই। একদিন পৃথিবী ছেড়ে সবাইকে চলে যেতে হবে। কিন্তু কিছু কিছু ঘটনা মনের মধ্যে দাগ কেটে থাকে। আসলে যখন ভালো দিন থাকে, তখন আশেপাশে মানুষের অভাব থাকে না। কিন্তু বিপদে পরলে বা গুরুতর অসুস্থ হলে কাউকে খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে হোসেন সাহেবের ডেথ ক্লিয়ারেন্স করাটা আজীবন মনে থাকবে আপনার। যাইহোক পোস্টটি আমাদের সাথে শেয়ার করার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে।

 10 months ago 

এখনো সেই সময়ের কথা ভেবে উঠলে, শরীরের লোম যেন দাঁড়িয়ে যায়।

 10 months ago 

আপনি একদম ঠিক করেছিলেন ভাইয়া সময় নিয়ে,হঠাৎ করেই বেঁচে নেই বললে আবেগঘন মুহূর্ত সৃষ্টি হবে।রাসেল ভাইয়ের ফেসবুক প্রোফাইলে আজকে তার বাবার মৃত্যুর কথা শেয়ার করেছিলেন তাই আপনার এতদিনের কথা আবার মনে পড়েছে।মানুষের জীবন খুবই অনিশ্চিত।পাঁচ বছর আগের কথা হলেও হঠাৎ পোস্টটি দেখতে পেয়ে খারাপ লেগেছে আপনার বিষয়টি।ভালো লাগলো পোস্টটি।ধন্যবাদ ভাইয়া সুন্দর পোস্টটি শেয়ার করার জন্য।

Posted using SteemPro Mobile

 10 months ago 

মেডিকেল প্রফেশনে এটা সবথেকে স্পর্শকাতর বিষয়, কারণ কাউকেই হঠাৎ মৃত বলা যায় না। এখানে অনেক পর্যবেক্ষণের ব্যাপার থাকেই।

Coin Marketplace

STEEM 0.17
TRX 0.13
JST 0.028
BTC 59907.23
ETH 2647.48
USDT 1.00
SBD 2.43