অব্যক্ত যন্ত্রণা।লকডাউনের দিনগুলো পর্ব-৩

in আমার বাংলা ব্লগ3 years ago
রিফাত ক্লান্ত দেহে হলে প্রবেশ করলো। রুমমেট অপূর্ব ওকে দেখে জিজ্ঞেস করল কিরে এত দেরী হল যে? ও কোন উত্তর না দিয়ে গায়ের শার্টটা খুলে ফ্লোরে বিছানো ওর তোষকে শুয়ে পরলো। অপূর্ব আবার ওকে জিজ্ঞেস করল কিরে কথা বলছিস না যে? হঠাৎ অপূর্ব খেয়াল করে দেখল রিফাতের চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরছে। অপূর্ব রিফাতের কাছে গিয়ে ওর পাশে বসলো। বসে রিফাতকে জিজ্ঞেস করল কিরে, কি হয়েছে? কাঁদছিস কেন? হঠাৎ করে রিফাত হাউ মাউ করে কেঁদে উঠলো। বলল আমার শেষ টিউশনিটাও ছুটে গেলো। এখন আমি কি করব? কোন রাস্তা দেখতে পাচ্ছি না। সামনে শুধু অন্ধকার সময়। সামনের মাস থেকে কিভাবে চলবো? কিভাবে গ্রামের বাড়িতে টাকা পাঠাবো? আমার বাবা মা ভাই বোন ওদের কি হবে যদি আমি টাকা না পাঠাই? ওদের তো না খেয়ে থাকতে হবে।

istockphoto-1185422927-612x612.jpg
ছবির সোর্স-লিংক


রিফাত বাবা-মার বড় সন্তান। ওর আরো চারটি ভাই বোন আছে গ্রামে। রিফাত ছোটবেলা থেকেই লেখাপড়ায় অনেক ভাল ছিলো। গ্রামের স্কুল থেকে এসএসসি পাস করে। তারপর স্থানীয় একটি কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করে। তারপর ঢাকা ভার্সিটিতে চান্স পায়। যখনও ঢাকা ভার্সিটিতে চান্স পায় তখন ঢাকা আসার মত টাকা ওর কাছে ছিল না। ওর তেমন কোন কাপড়-চোপড় ও ছিলোনা যা পরে ভদ্র কোন সমাজে যাওয়া যায়।ওর মা তার একমাত্র অলংকার একজোড়া সোনার কানের দুল সেটা বিক্রি করে সেই টাকা দিয়ে রিফাতকে ঢাকা পাঠান। রিফাতের বাবা কৃষি কাজ করে যৎসামান্য আয় করতেন। তা দিয়ে ওদের কোন রকমে দিন চলে যেত। কিন্তু রিফাত ঢাকা ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পর ওর বাবা হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়েন। সে আর কাজ করতে পারেনা। যার ফলে সংসারের পুরো দায়িত্ব রিফাতের ঘাড়ে এসে পড়ে।


তার পরিবারের অবস্থা ভালোভাবেই সে বোঝে। এজন্য সেই ঢাকা আসার পর পরিচিত কিছু লোকের সাথে যোগাযোগ শুরু করে যাতে কিছু একটা করে নিজের খরচ চালাতে পারে। পরিবারের যে তাকে ঢাকা পড়ানোর সামর্থ্য নেই সেটা সে ভালোভাবেই জানে। রিফাত ঢাকা ভার্সিটির গণরুমে থাকে। কিছুদিনের মধ্যেই দুটো টিউশনি যোগাড় করে নিয়েছিলো। টিউশনির টাকা দিয়ে ওর ভালই চলে যাচ্ছিলো। নিজের খরচ বাদে পরিবারের জন্যও বেশকিছু টাকা পাঠাতে পারতো। সে টাকা দিয়ে ওর পরিবার অন্তত তিন বেলা খেতে পারতো। এখন এই করোনার জন্য সব বন্ধ হয়ে গেলো। আজ বেতন আনতে ছাত্রের বাসায় গিয়েছিলো। ছাত্রের মা গত মাসের বেতন ওর হাতে দিয়ে বলল আর আসতে হবে না। তাদের নিজেদের অর্থনৈতিক অবস্থা বেশ খারাপ। করোনার জন্য তাদের ব্যবসা বাণিজ্য বন্ধ যার ফলে তাকে বেতন দেয়ার অবস্থা আর তাদের নেই। একথা শুনে রিফাত টাকাটা নিয়ে মাথা নিচু করে চলে আসে। কি বলবে সে? এর কোন উত্তর তো তার কাছে নেই। আর একটা টিউশনি আগেই ছুটে গিয়েছে। এই একটা দিয়ে কোনরকমে দিন চলে যাচ্ছিলো। এখনতো সেটাও বন্ধ হয়ে গেলো।


লকডাউন এর কারণে সব দোকানপাট বন্ধ যা দু চারটে খোলা আছে তাদেরও ব্যবসা মন্দা যার ফলে কোন দোকানে যে কর্মচারীর কাজ নিবে সে উপায়ও নেই। এদিকে মাস ও প্রায় শেষ। সামনের মাসে রিফাতের নিজের চলার মতো টাকাও নেই। পরিবারকে সে কিভাবে টাকা দেবে? কিন্তু রিফাত জানে যদি সে টাকা না পাঠায় তাহলে তার পরিবার না খেয়ে থাকবে। সেটাতো রিফাত হতে দিতে পারেনা। সে জন্য সারারাত চিন্তা করে পরদিন সকালে উঠে কাজের সন্ধানে রিফাত হল থেকে বের হয়ে যায়। সারাদিন ঘুরে কোথাও কাজ না পেয়ে হলে ফিরে আসছিল রিফাত। এর ভিতর প্রচন্ড পানির পিপাসা পাওয়ায় রাস্তার পাশে একটা চায়ের দোকানে যায় পানি খেতে। সেখানে কয়েকজন রিক্সাওয়ালা বসে চা খাচ্ছিলো আর নিজেদের ভেতর গল্প করছিলো। যে আমাদের তাদের অবস্থা এখন কিছুটা ভালো। কারণ সরকার রিকশা চলাচলের উপর কোন বিধি-নিষেধ আর আরোপ করেনি। যার ফলে মানুষের চলাচলের অন্যতম বাহন হয়ে উঠেছে রিক্সা। আগেতো বাস, সিএনজি, অটোরিক্সা কতকিছু রাস্তায় চলতো। এখন শহরের ভেতর শুধু রিকশা চলছে। রিক্সা ওয়ালারা ভাড়াও বেশি পাচ্ছে আগের থেকে। তাদের কথা শোনার পর সেখান থেকে রিফাত হলে চলে যায়। রাতে রিফাত সিদ্ধান্ত নেয় মাসের বাকি কটা দিন সে চাকরির জন্য চেষ্টা করবে। যদি কোন চাকরি জোগাড় না করতে পারে তাহলে সে রিক্সা চালাবে। তারপর রিফাত প্রতিদিন সকালে উঠে চাকরির উদ্দেশ্যে হল থেকে বের হয়ে যায় এবং সন্ধাবেলায় মন খারাপ করে হলে ফিরে আসে। এভাবে দেখতে দেখতে মাস চলে গেল। আজ মাসের শেষ দিন কাল থেকে রিফাত ঠিক করে রেখেছে সে রিক্সা চালাবে। কারণ তাকে যেভাবেই হোক তার বাড়িতে টাকা পাঠাতে হবে। নইলে যে তার বাবার ওষুধ খাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে। তার মা-বাবা ভাই-বোনের খেয়ে না খেয়ে থাকতে হবে। পরদিন সকালে উঠে রিফাত কাউকে কিছু না বলেই হল থেকে বেরিয়ে যায়। তারপর সে একটা রিকশার গ্যারেজে যায়। গিয়ে তাদেরকে বলে আমি রিক্সা চালাতে চাই, আমাকে কি একটা রিকশা দেয়া যাবে? তারা রিফাতকে দেখে প্রথমে একটু সন্দেহ করে তার বেশভূষা দেখে। পরে রিফাত অনুনয়-বিনয় করার পরে তারা রিফাতকে একটা রিকশা দেয়। দিনে ২০০ টাকা জমা দিতে হবে রিকশার মালিক কে। রিফাত রিক্সা নিয়ে বের হয়ে যায়।রিক্সা নিয়ে বের হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই রিফাত একটি ভাড়া পায়। রিফাত প্যাসেঞ্জারকে রিক্সায় উঠিয়ে তার গন্তব্যে পৌঁছে দেয়। পরে প্যাসেঞ্জার যখন তাকে ভাড়া দেয় তখন সে বেশ খুশি হয়ে ওঠে।


এভাবেই দুপুর পর্যন্ত রিকশা চালায় রিফাত। এর মধ্যে রিফাতের প্রচন্ড ক্ষুধা লাগে। রাস্তার পাশে ভ্রাম্যমাণ একটা ভ্যান থেকে যেখান থেকে সাধারণত রিক্সাওয়ালারা খায় সেখান থেকে দুপুরের খাওয়াটা সেরে নেয় রিফাত। দুপুরের খাওয়া শেষ করে যখন সে রিক্সা নিয়ে আবার রাস্তায় নেমেছে হঠাৎ করে একটা নারীকন্ঠ ডাক দেয় এই রিক্সা যাবেন। রিফাত রিক্সা নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখে ওর ক্লাসমেট সুবর্ণা দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার পাশে। হঠাৎ করে রিফাত সুবর্ণাকে দেখে প্রচন্ড ধাক্কা খায়। ওর বুকের ভেতরটা দুমড়ে-মুচড়ে যেতে থাকে। কারণ কেউ জানে না শুধু রিফাত নিজেই জানে ব্যাপারটা। রিফাত সুবর্ণাকে খুব পছন্দ করে। কিন্তু সুবর্ণাকে এ কথাটা বলার সাহস রিফাতের কখনো হয়নি। সুবর্ণা রিফাতকে দেখে প্রচন্ড অবাক হয়ে যায়। ওর কাছে গিয়ে সুবর্ণা বলে তুমি রিক্সা চালাচ্ছো? রিফাত মাথা নিচু করে সেখান থেকে চলে যায়। ওর দুচোখ বেয়ে অঝোরে অশ্রু ঝরছে। পেছন থেকে সুবর্ণা অবাক চোখে রিফাতের দিকে তাকিয়ে থাকে। (সমাপ্ত)


আশাকরি গল্পটি আপনাদের ভালো লাগবে। আপনাদের ভালো লাগলেই আমার লেখা স্বার্থকতা হবে। পরবর্তীতে অন্য কোন লেখা নিয়ে আপনাদের সাথে দেখা হবে।

Cc- @rme



⬛⬛ধন্যবাদ⬛⬛


@rupok

আমি রূপক। আমি একজন ফুলটাইম স্টিমিয়ান। আমি বিবাহিত। এক সন্তানের জনক। আমি বাঙালি, বাংলাদেশি। আমি আমার দেশকে অনেক ভালোবাসি। আর বাংলা ভাষায় মনের ভাব প্রকাশের সুযোগ পেয়ে আমি এই কমিউনিটির প্রতি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ।

Sort:  
 3 years ago 

আপনি কি গল্পের আগের পর্বগুলো প্রকাশ করেছেন ভাই।
আগের পর্বগুলোর লিংক পোষ্টের নিচে দিলে ভালো হতো।

 3 years ago 

আমি একটি ছোটগল্প সিরিজ লিখছি। এগুলো লকডাউন এর সময় ঘটে যাওয়া মানুষের জীবন থেকে নেয়া। প্রত্যেকটা গল্প আলাদা পটভূমিতে রচিত। আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।

You have been upvoted by @rex-sumon A Country Representative, we are voting with the Steemit Community Curator @steemcurator07 account to support the newcomers coming into steemit.


Follow @steemitblog for the latest update. You can also check out this link which provides the name of the existing community according to specialized subject

There are also various contest is going on in steemit, You just have to enter in this link and then you will find all the contest link, I hope you will also get some interest,

For general information about what is happening on Steem follow @steemitblog.

 3 years ago 

Thanks to @rex-sumon vai for the support.

Coin Marketplace

STEEM 0.20
TRX 0.15
JST 0.030
BTC 65266.27
ETH 2639.14
USDT 1.00
SBD 2.84