ছোটগল্প "রক্তঝরা অভিশপ্ত রাত" - ০২
[ঐতিহাসিক সত্য ঘটনা অবলম্বনে নিচের গল্পটি রচনা করা হয়েছে । এর আগে একাধিক খ্যাতিমান লেখক এই রক্তজল করা সত্য ঘটনা অবলম্বন করে অনেক গুলি গল্প রচনা করে গিয়েছেন । তন্মধ্যে "সিংহ কবলিত যাত্রী ট্রেন", লেখক বীরু চট্টোপাধ্যায়, গল্পটির কিছু কিছু অংশ এখনো মনে আছে । খুব ছোটবেলায় শিশুসাথীর পূজাবার্ষিকীতে গল্পটি পড়েছিলুম।
তবে, আমার আজকের লেখাটি একেবারেই সত্য ঘটনা অবলম্বনে মৌলিক লেখা ]
কপিরাইট ফ্রী ইমেজ সোর্স : Pixabay
ঘ টনার আকস্মিকতায় সবাই একেবারে নিমেষে জমে পাথর । অল্প কিছু মুহূর্ত মাত্র, এর পরে বিশাল এক হুড়োহুড়ি শুরু হলো হঠাৎ ।
রইলো পড়ে ইঞ্জিন তোলার কাজ, রইলো পড়ে চা-বিস্কুট খাওয়া । মুহূর্ত মধ্যে দারুন আতঙ্ক গ্রাস করলো প্রতিটি যাত্রীর মনে । প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে হুড়োহুড়ি পড়ে গেলো সবার মাঝে । কে আগে ট্রেনের কামরায় উঠতে পারে তা নিয়ে শুরু হলো এক ভীষণ প্রতিযোগিতা ।
তথাকথিত সভ্য মানুষ নিমেষে অসভ্য জানোয়ারে পরিণত হলো যেন । শক্ত সমর্থ যুবক পুরুষেরা তাদের চাইতে দুর্বল মেয়ে, শিশু আর বৃদ্ধদের দলিত মথিত করে ট্রেনের কামরায় উঠে ঝটপট দরজা জানালা বন্ধ করা শুরু করলো । এর ফলে অনেক যাত্রী জখম হলো । অনেক যাত্রী ট্রেনের কামরার বাইরে থেকে গেলো । কারণ দারুন আতঙ্কে কামরার ভিতরের যাত্রীরা দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলো ।
যাই হোক, রেলের গার্ডদের তৎপরতায় দ্রুত কামরার বাইরে থাকা যাত্রীদের কামরার মধ্যে ঢোকানো গেলো । ততক্ষন বেশ রাত নেমে গিয়েছে । প্রতিটা কামরায় সে এক মৃত্যুশীতল নিস্তব্ধতা । কথা বলতেও ভয় পাচ্ছে সবাই । শুধু দ্বিতীয় কামরার এক ভদ্রমহিলার বুক ফাটা কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছে । ইনিই তিনি যাঁর ছেলেকে একটু আগে সিংহে নিয়ে গিয়েছে । সন্তানহারা মায়ের সেই ক্রন্দন ধ্বনিতে রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে খান খান হয়ে যাচ্ছে ।
রাত তখন আটটা । এমন সময় বাইরে শোনা গেলো অনেকগুলি সিংহের রক্ত হিম করা গর্জন । একটি দুটি নয় । অনেক গুলি । গোটা একটা পাল ঘিরে ধরেছে বিকল হয়ে যাওয়া ট্রেনটাকে । রক্তের গন্ধ পেয়েছে তারা, একটু আগের মানুষের রক্ত-মাংসের স্বাদে পাগল এরা ।
মেঘ গর্জনের মতো সে বুক হিম করা হুঙ্কারে ট্রেনের কামরার মেয়েদের মধ্যে কেউ কেউ ভয়ে মূর্ছিত হয়ে পড়লো । ঘটনাটি সেই সপ্তদশ শতাব্দীর । ট্রেনের কামরাগুলো আগাগোড়া পুরোটাই কাঠের তৈরী । নেটিভ যাত্রীরা প্রত্যেক কামরাতেই ছিল । আর তাদের সাথে একদল শিকারীও যাচ্ছিলো । যে সময়কার কথা বলছি তখন সমগ্র আফ্রিকার বুকে ছিল সিংহদের ভয়াবহ দৌরাত্ম্য । এক কোটির ওপর ছিল টোটাল সিংহদের সংখ্যা । ব্রিটিশ সরকার তখনকার দিনে একটা সিংহ মারতে পারলে পাঁচ পাউন্ড দিত । মানে বর্তমানে ৫০,০০০ টাকার মতো ।
নেটিভ যাত্রীরা সবাইকে সতর্ক করলো যে জায়গাটি হলো সিংহের আড্ডাস্থল । বিনা প্রয়োজনে যেন কেউ জানালা না খোলেন এবং শিকারীরা একান্তই প্রয়োজন বিনা গুলি না ছোঁড়েন । সবাই তাঁদের কথায় সম্মত হলেন । কারণ নেটিভ যাত্রীরা হলো এই অরণ্যেরই সন্তান । তাদের চাইতে ভালো আর কে জানবে ।
বাইরে আফ্রিকার আদিম জঙ্গলে ধীরে ধীরে গভীর হচ্ছে কাল রাত্রি । ঝিঁ ঝিঁ পোকার একটানা শব্দ ঢেকে দিচ্ছে চাপা সিংহ কণ্ঠের গর্জন, কামরার বাইরে তাদের আস্ফালন আর ফোঁস ফোঁস করে জান্তব শ্বাসের শব্দে । কামরার ভিতরের মানুষগুলোর ওপর স্নায়ুর চাপ উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে । কাঠের পুতুলের মতো বসে প্রত্যেকটা মানুষ । কাল রাত্রি প্রভাতের অপেক্ষায় প্রতিটা মুহূর্ত গুনে চলেছে তারা ।
রাত এগারোটার দিকে সিংহেরা প্রথম আক্রমণ শুরু করলো কামরার দরজা আর জানালার ওপর । কাঠের দরজার ওপর সিংহের নখরাঘাত, আঁচড়ানো, খিমচানো ক্রমশঃ বেড়েই চললো যত রাত গভীর হতে থাকলো । কামরার জানালার শার্শির কাঁচের উপর নাক ঠেসে ধরে লোলুপ দৃষ্টিতে ভিতর পানে তাকিয়ে রইলো অনেকগুলো সিংহ । মুহুর্মুহু তাদের কণ্ঠ চিরে বেরিয়ে আসছে ক্ষুধার্থ জান্তব হুঙ্কার ।
সিংহের যে জ্বলজ্বলে লোলুপ দৃষ্টি অনেক মেয়ে আর বাচ্চারা সইতে না পেরে চেঁচামেচি লাগিয়ে দিলো । আর তাতেই হলো বিপত্তি । মনুষ্যকন্ঠ কানে যাওয়া মাত্রই যেন সিংহদের খিদে বহুগুন বাড়িয়ে তুললো । ভীষণভাবে তারা দরজার উপর সনখ থাবা চালাতে লাগলো । বার বার । সে আঘাতে ট্রেনের কাঠের কামরাগুলি দুলে দুলে উঠতে লাগলো ।
আরেকদল সিংহ লাফিয়ে উঠলো কামরার ছাদের উপর । স্কাই লাইটের জায়গায় থাবার পর থাবা চালিয়ে ভেঙে ফেলতে চাইলো সেগুলো । সর্বনাশ বগির চালগুলো এমনিতেই কাঠের পাতলা পাটাতন দিয়ে তৈরী । বিশালদেহ সিংহের লাফালাফিতেই না ভেঙে পড়ে যায় সেগুলো । কামরার মধ্যে প্রতিটা মানুষ মৃত্যুভয়ে অবশ হয়ে গেলো ।
শুধু ঘাবড়ালো না রেলের গার্ডরা, নেটিভ যাত্রীরা আর শিকারীদল । দ্রুত অনেকগুলো রাইফেলের নল ঘুরে গেলো দরজা, জানালা আর ছাদের স্কাই লাইটের দিকে ।
দ্বিতীয় কামরার একটি দরজা বিশালদেহ এক সিংহের থাবার তীব্র আঘাত সইতে না পেরে ভেঙে পড়লো সশব্দে । মুহূর্তমধ্যে বিশাল এক সিংহের মুখ উঁকি মারলো ভাঙা দরজার ফাঁকে । এক মহিলার ডান হাত কামড়ে ছিড়ে নিলো সেটি । সঙ্গে সঙ্গে গর্জে উঠলো দুটো রাইফেল একযোগে । ভাঙা দরজায় বিশাল মাথা রেখে চির নিদ্রায় শায়িত হলো শ্বাপদ ।
যে মহিলার হাত কামড়ে ছিড়ে নিয়েছে, তীব্র ব্যাথা আর আতঙ্কে হৃদ যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যু হয়েছে তাঁর । রক্তে ভেসে যাচ্ছে কামরার মেঝে মেঝে ।
ট্রেনের একেবারে শেষ কামরার ছাদের স্কাই লাইটের জায়গা ভেঙে ফেললো একটা সিংহ । মুখ বাড়িয়ে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করতে লাগলো । সেদিকে তাকিয়ে যাত্রীরা সব হাউমাউ করে কান্নায় ভেঙে পড়লো । সিংহের লোলুপ দৃষ্টি, ফোঁটায় লালা ঝরে পড়া আর সশব্দ পঁচা মড়ির মতো নিঃশ্বাস প্রশ্বাসে একাধিক মেয়ে মূর্ছিত হয়ে পড়লো ।
পাঁচটি রাইফেলের নল ঘুরে গেলো সেদিকে । এক মুহূর্ত প্রতীক্ষা । এরপর সশব্দে গর্জন করে উঠলো পাঁচ পাঁচটি মারণাস্ত্র । ধুপ করে ভারী কিছু যেন গড়িয়ে পড়লো চালের ওপরে । স্কাই লাইটের ভাঙা ফোঁকরে মুখ গুঁজে পড়ে রইলো সিংহটি । ঘষা কাঁচের মতো নিষ্প্রাণ চোখে নির্নিমেষ চেয়ে রইলো কামরার যাত্রীদের দিকে । হু হু করে তাজা রক্ত বইতে লাগলো কামরার ভিতর । সিংহের রক্ত ।
ভোর হয়ে আসছে । যাত্রীরা কায়মনোবাক্যে ভোরের সূর্যের প্রতীক্ষা করছে । মৃত্যুর প্রহর গুনে চলেছে প্রতিটা মানুষ । স্নায়ুর উপর অসম্ভব চাপ বাড়ছে একটু একটু করে । এমন সময় হঠাৎ, তৃতীয় বগির ছাদ ভেঙে বিশাল এক সিংহ লাফিয়ে নামলো কামরার ভিতর ।
[ক্রমশঃ]
দুপুরবেলার দিকে যখন অফিসে যাচ্ছিলাম , তখন গল্পটি পড়েছিলাম কিন্তু নেটওয়ার্ক ইস্যুর কারণে আমি মন্তব্য করতে পারি নি । ইশ ,ঐ যে মায়ের আর্তনাদ তারপরে সিংহের তৃতীয় কামরায় ঢোকার প্রত্যেকটি লাইন যেন ছিল টানটান উত্তেজনা । হুট করে গল্প এমনভাবে মোড় খেল কি একটা অবস্থা । পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায় রইলাম, কি হলো তৃতীয় কামরায় , জানতে চাই ভাই ।
This post has been upvoted by @italygame witness curation trail
If you like our work and want to support us, please consider to approve our witness
Come and visit Italy Community
Thank You for sharing...
দাদাভাই পুরো গল্পটি খুব মনোযোগ সহকারে পড়লাম। মনে হচ্ছে নিজেই ওই গল্পের একটি চরিত্র হয়ে উঠছি। গল্প পড়তে পড়তেই গল্পের ভিতরে এমনভাবে ঢুকে গেলাম যে,মনে হচ্ছে আমিও সেখানে ছিলাম এবং এসব কিছু আমার চোখের সামনে ঘটছে। সিংহের এমন আক্রমণ নিয়ে আমি কখনোই আর এই ধরনের ভয়ানক কোন গল্প পড়িনি। সত্যি বলতে মনের ভেতর খুব এক্সাইটমেন্ট কাজ করছে এবং খুবই ভালো লেগেছে। আমি গল্পের বাকি অংশের অপেক্ষায় রইলাম দাদাভাই। যতদিন না পুরো গল্পটি পড়বো ততদিন এক্সাইটমেন্ট কাজ করতে থাকবে। অনেক অনেক ধন্যবাদ দাদা ভাই। সত্যিই মন ছুয়ে গেল আজকের পোস্টটি। ভালো থাকবেন এবং অনেক ভালোবাসা রইল আপনার জন্য।
Thank You for sharing Your insights...
দাদা সত্যি আপনার গল্পটি পড়ে আমি নিজেই ভয় পেয়ে গেছিলাম। জানিনা এই গল্পের শেষে কি হবে, আসলে ট্রেনের শেষ কামরায় যখন সিংহটি ঢুকে পড়ল তখন মানুষের হাউ মাউ কান্না, আসলে এটা খুবই ভয়াবহ ছিল। তারপরে শেষের দিকে তৃতীয় বগির ছাদ ভেঙ্গে বিশাল আর একটি সিংহ নামলো কামরার ভিতরে জানি না এখন কি হবে।পরের অংশের জন্য অপেক্ষা রইলাম।
ভাবতেই ভয় লাগছে, অসম্ভব ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি, বাচার আকুতিতে সবাই ছটপট করে উঠছে। কি ভয়াবহ অবস্থা। আমি পড়তে পড়তে মনে হচ্ছে আমার চোখের সামনে সব ভেসে উঠছে। তবে সব শেষে দুঃখ লাগছে সেই মানুষগুলোর জন্য যারা এই পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিল।
বাবাগো ভয়ে আমার গায়ের সব লোম দাঁড়িয়ে গেছে। বারবার মনে হচ্ছিলো ট্রেনের ছাদ, দরজা ভাঙতে পারলেই আমার কাছে এসে পড়বে। কত ভয়ংকরভাবে উপস্থাপন করেছেন দাদা। অসম্ভব ভালো লাগলো সাথে ভয়ও। ভাগ্য ভালো যে শিকারি দল সাথে ছিল তা নয় হলে একজনও বেঁচে থাকতো না। আগামী পর্বে দেখার অপেক্ষা শেষ মেষ কয়জন সিংহের কবলে পরে মারা গেল। প্রতিক্ষা ।
Thank You for sharing...
ভয়ে তো শরীরের লোম খাড়া হয়ে গেছে।
মহিলাটির হাত ছিড়ে নিয়ে গেছে ☹️
আর সবগুলো যাত্রীর জীবন হুমকির মুখে রয়েছে। কি হয় সামনে জানার আগ্রহ বেড়ে চলেছে।
গল্পটা একেবারে লোমহর্ষক ছিল। শরীরে একটা শিহরণ সৃষ্টি হয়ে গেল। অনেক দিনের ক্ষুধার্ত সিংহ যখন মানুষের রক্ত মাংসের স্বাদ পাই সে যে কতটা হিংস্র হতে পারে এটা ভাবনার বাইরে। পরের পর্বের জন্য অপেক্ষায় থাকলাম।।
এই তথ্যটা আমার জানা ছিলো না, আপনার গল্পগুলো এই জন্য পড়তে ভালো লাগে কিন্তু নতুন তথ্য জানার সুযোগ পাওয়া যায়।
অন্য রকম একটা উৎকণ্ঠা আর মনের ব্যাকুলতা নিয়ে দ্রুত পুরো গল্পটা শেষ করলাম, মনে হচ্ছে হৃদয় বড্ড বেশী অস্থৈর্য হয়ে উঠছে পুরো বিষয়টি জানার জন্য, কৌতুহল নিয়ে অপেক্ষায় রইলাম।
Thank You for sharing Your insights...
বিপদের সময়ে পৃথিবীর সব জায়গাতেই প্রথম শিকার হয় মহিলা আর শিশুরা। ভাবতেই অবাক লাগে মাত্র 300 বছরের ব্যবধানে পৃথিবীতে কি অভাবনীয় পরিবর্তন হয়েছে। পশুপাখি আর আদিম প্রকৃতির জায়গা দখল করে নিয়েছে মানুষ। একসময় যেখানে সিংহ মারলে 5 পাউন্ড পুরস্কার পাওয়া যেত এখন সেখানে সিংহ সংরক্ষণের ব্যাপারে সারাক্ষণ নজরদারি করতে হয়। সত্যি বলতে কি এই ধরনের গল্পগুলি আমি এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলি। বলতে গেলে একটা খাঁচার ভিতর এখন সিংহ আর মানুষ। দেখা যাকএরপর কি হয়