ডিজিটাল সিস্টেম: সমাধানের বদলে নতুন সমস্যা
বর্তমান বিশ্বে প্রযুক্তির অগ্রগতি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে উন্নয়ন এবং গতি এনেছে। তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার মানুষকে আগের চেয়ে অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ করেছে। কিন্তু বাস্তবতায়, অনেক ক্ষেত্রেই আমরা ডিজিটাল সিস্টেমের ভুল প্রয়োগের কারণে প্রকৃত সমস্যার সমাধান না পেয়ে বরং নতুন সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছি। ডিজিটাল পদ্ধতির সুবিধা থাকার পরেও এর কার্যকারিতা এবং ব্যবস্থাপনার অভাবে অনেক ক্ষেত্রেই জনসাধারণের ভোগান্তি বাড়ছে। একটি সাধারণ উদাহরণ হলো বাংলাদেশের ট্রেনের অনলাইন টিকিট বুকিং ব্যবস্থা। যাত্রার ১০ দিন আগে সকাল ৮টায় টিকিট বুকিং শুরু হয়। কিন্তু তখনই দেখা যায়, বেশিরভাগ সময়েই সার্ভার ‘ডাউন’ বা ‘সার্ভার এরর’। যারা একটু দেরিতে লগইন করেন, তারা টিকিট কেনার আগেই হতাশ হয়ে পড়েন। বিশেষ করে জনপ্রিয় সিট, যেমন এসি সিট বা বার্থ, দ্রুত শেষ হয়ে যায়। ফলে যাত্রীদের জন্য ডিজিটাল এই ব্যবস্থা কোনো সমাধান বয়ে আনে না, বরং একটি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়ায়।
অনলাইন সিস্টেমকে চমৎকার সমাধান মনে করলেও এর সীমাবদ্ধতা আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। উদাহরণ হিসেবে, প্রতিটি জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) দিয়ে সর্বোচ্চ চারটি টিকিট বুকিংয়ের নিয়ম অনেক যাত্রীর জন্য সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বড় পরিবারের ক্ষেত্রে একসঙ্গে ভ্রমণের পরিকল্পনা করা কঠিন হয়ে পড়ে। নতুন এনআইডি ব্যবহার করে টিকিট বুক করতে গেলে সময় ও ঝামেলা আরও বেড়ে যায়।এই ব্যবস্থাটি কালোবাজারি রোধের জন্য চালু করা হলেও এর কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। টিকিট বিক্রির প্রথম মিনিটেই কালোবাজারিরা অনেক টিকিট কিনে ফেলে। এরপর এই টিকিট তারা বেশি দামে সাধারণ যাত্রীদের কাছে বিক্রি করে। রেলওয়ের রিফান্ড পলিসি অনুযায়ী, টিকিট বাতিল করলে ৯০ শতাংশ টাকা ফেরত পাওয়া যায়। ফলে কালোবাজারিদের পক্ষে এটি খুবই লাভজনক হয়ে ওঠে।
টিকিটের চাহিদা এবং সরবরাহের ভারসাম্য রক্ষা করা ডিজিটাল সিস্টেমের একটি মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু টিকিটের চাহিদা অনুযায়ী বগি বাড়ানো বা কমানো একটি কার্যকর সমাধান হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, উৎসবের সময়ে বেশি যাত্রীর জন্য অতিরিক্ত বগি সংযোজন করা গেলে টিকিট সংকট অনেকাংশে কমানো সম্ভব। ডেটা-ড্রাইভেন ডিসিশন বা উপাত্তভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সমাধান করা সম্ভব। তবে এর জন্য প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা এবং দক্ষ ব্যবস্থাপনা।
আমাদের দেশে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, ডিজিটাল সিস্টেম বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সঠিক পরিকল্পনার অভাব রয়েছে। ফলে সমস্যার প্রকৃত সমাধান না হয়ে বরং জোড়াতালির সমাধান দেওয়া হয়। যেমন, ইউনিয়ন ভূমি অফিসের ডিজিটাল সেবা ব্যবস্থাপনায় অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। অনেকে অভিযোগ করেন, আগে শুধু অফিসের কর্মকর্তাদের ‘বিশেষ সুবিধা’ দিতে হতো। এখন সেই সঙ্গে সার্ভারের ‘মেজাজ’ ঠিক রাখতে বিশেষ অর্থ ব্যয় করতে হয়। এর ফলে মানুষের মধ্যে ডিজিটাল সিস্টেমের প্রতি আস্থা কমে যাচ্ছে। এর মূল কারণ হলো সিস্টেম তৈরির সময় এর ব্যবহারকারীদের প্রয়োজন এবং চাহিদা বিবেচনা করা হয়নি।
ডিজিটাল সিস্টেম কোনো জাদুর বাক্স নয়। এটি শুধুমাত্র একটি টুল, যা সঠিকভাবে ব্যবহৃত হলে মানুষের জীবনকে সহজতর করতে পারে। তবে সিস্টেম তৈরির সময় যদি মূল সমস্যার গভীরে যাওয়া না হয়, তাহলে সেটি একটি ‘অস্থায়ী সমাধান’ হিসেবেই থেকে যাবে। ডিজিটাল সিস্টেমকে কার্যকর করার জন্য আমাদের প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা, দক্ষ জনবল এবং সমস্যার মূল কারণগুলো চিহ্নিত করা। উদ্ভাবনী চিন্তা এবং সঠিক নীতিমালা ছাড়া ডিজিটাল সিস্টেম আমাদের সমস্যাগুলোর সমাধান করতে পারবে না। ডিজিটাল সিস্টেমের সঠিক প্রয়োগ এবং কার্যকারিতা নিশ্চিত করা আমাদের সময়ের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। এটি বাস্তবায়নের মাধ্যমে সমস্যাগুলো সমাধান করা সম্ভব, তবে তা শুধু তখনই সম্ভব যখন সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে কাজটি সম্পন্ন করা হবে। নয়তো ডিজিটাল সিস্টেমের নামে আমরা শুধু নতুন সমস্যার জন্ম দিতে থাকব। আমাদের উচিত ডিজিটাল সিস্টেমের কার্যকারিতা পর্যালোচনা করা এবং সমস্যাগুলোর প্রকৃত কারণ চিহ্নিত করে কার্যকর সমাধান খোঁজা। তবেই আমরা ডিজিটাল সিস্টেমের আসল সুবিধা উপভোগ করতে পারব।
দাদা এত সুন্দর বিষয় বস্তু নিয়ে লেখার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। তথ্য প্রযুক্তির অবদানে মানুষের সকল কাজ আগের থেকে অনেক সহজেই হয়ে যাচ্ছে। তবে এই সহজে কাজ করার ফলে অনেক সময় কাজের সঠিক সমাধান না হয়ে, হিতে বিপরীত হয়ে যাচ্ছে। আমাদের কখনো সম্পন্ন প্রযুক্তি নির্ভর হওয়ার দরকার নেই। ডিজিটাল প্রযুক্তি অনেক ক্ষেত্রে সুবিধা আছে তেমন অনেক অসুবিধা আছে।
ভালো লাগলো আপনার লেখাটি পড়ে। ভালো থাকবেন দাদা।
আপনার পোস্টটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং বাস্তবসম্মত। ডিজিটাল সিস্টেমের সুবিধাগুলি সবার জন্যই স্পষ্ট, কিন্তু যদি সঠিক পরিকল্পনা এবং ব্যবস্থাপনা না থাকে, তবে এটি প্রকৃত সমস্যার সমাধান না হয়ে বরং নতুন সমস্যা তৈরি করতে পারে, যেমন আপনি উদাহরণ হিসেবে দিয়েছেন ট্রেনের টিকিট সিস্টেমের ক্ষেত্রে। সঠিকভাবে পরিকল্পিত এবং বাস্তবসম্মত ডিজিটাল সিস্টেম আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বড় ধরনের উন্নতি আনতে পারে, তবে তা সঠিকভাবে প্রয়োগ করা প্রয়োজন। ডিজিটাল সিস্টেমের কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে আমাদের আরও সচেতন থাকতে হবে।