পুরাতন হলে সব কিছুরই আগ্রহ কমে যায় ।
আজ - ২১ ই জ্যৈষ্ঠ |১৪৩২ বঙ্গাব্দ, | বর্ষাকাল |
আসসালামু-আলাইকুম। আদাব - নমস্কার। মাতৃভাষা বাংলা ব্লগিং এর একমাত্র কমিউনিটি আমার বাংলা ব্লগ এর ভারতীয় এবং বাংলাদেশী সদস্যগণ, আশা করি সবাই ভাল আছেন।
এই বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয় একটি বাস্তব উদাহরণে। ধরুন, রাজীব নামের একজন যুবক, সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে চাকরি পায়। চাকরির প্রথম দিন সে যারপরনাই উত্তেজিত—নতুন পরিবেশ, নতুন পরিচয়, পরিচ্ছন্ন অফিস রুম, আধুনিক টেকনোলজি, স্মার্ট কলিগ—সবকিছুই তার কাছে স্বপ্নের মতো লাগে। সে নিয়মিত অফিসে যায়, সময় মেনে কাজ করে, বাড়ি ফিরে অভিভাবকদের সাথে উচ্ছ্বাস নিয়ে প্রতিটি ঘটনা ভাগ করে নেয়। কিন্তু ছয় মাস পর চিত্র বদলে যায়। অফিসের সেই চেয়ারে বসে এখন আর তেমন ভালো লাগে না, কাজগুলো কেমন যেন একঘেয়ে মনে হয়, মিটিংগুলো বিরক্তিকর, কলিগদের আচরণকেও এখন সে "নকল" মনে করতে থাকে। যে অফিস একসময় তার কাছে গর্বের ছিল, সেটিই এখন শুধুই বেতন পাওয়ার একটি জায়গা। তার ভেতর থেকে আগ্রহ ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়ে যায়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, অফিসটি কি বদলেছে? কলিগেরা কি আচরণ পাল্টেছে? অফিসের চেয়ার-টেবিল কি পুরোনো হয়ে গেছে? না, বদলেছে রাজীবের অনুভব, মনোযোগ ও আগ্রহ—কারণ সময়ের সাথে যেটি একসময় নতুন ছিল, সেটি এখন ‘পরিচিত’। আর পরিচিত মানেই যেন কম আগ্রহ, কম আবেগ।
এই ঘটনা শুধু চাকরির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। সম্পর্কেও একই সত্য প্রযোজ্য। সম্পর্কের শুরুতে মানুষ একজন আরেকজনের প্রতি খুব আন্তরিক থাকে, প্রতিটি কথায় ভালোবাসা খুঁজে পায়, একে অপরকে চেনার আগ্রহে থাকে সময়ের হিসাব ছাড়া। কিন্তু সেই সম্পর্ক এক, দুই, তিন বছর পার করলে দেখা যায়—তারা আর আগের মতো কথা বলে না, একসাথে সময় কাটায় না, বরং ছোটখাটো ব্যাপারে তর্ক করে, একে অপরকে বুঝতে চায় না। অথচ এই সম্পর্কেই একসময় ভালোবাসা ছিল, যত্ন ছিল, স্বপ্ন ছিল। তাহলে আজ কী হলো? আসলে নতুনত্বের জায়গা নিয়েছে অভ্যস্ততা, আর অভ্যস্ততার জায়গায় এসেছে অবহেলা। আমরা যখন একটি সম্পর্ককে ‘পুরাতন’ বলে ভাবতে শুরু করি, তখন আমরা সেটিকে চর্চা করার প্রয়োজন বোধ করি না। যত্ন বন্ধ হয়ে যায়, এবং যত্ন বন্ধ মানেই আগ্রহের মৃত্যু।
তবে এখানেই আসল বোঝাপড়ার জায়গা—পুরাতন মানেই কি মূল্যহীন? মোটেই না। বরং পুরাতনের মধ্যেই থাকে অভিজ্ঞতা, ইতিহাস, স্থিরতা ও গভীরতা। আমরা যেমন পুরাতন বইয়ের পৃষ্ঠায় অমূল্য গল্প খুঁজে পাই, পুরাতন ডায়েরিতে পাওয়া যায় আমাদের ফেলে আসা দিনের আবেগ, তেমনি পুরাতন সম্পর্কেও পাওয়া যায় একধরনের মানসিক আশ্রয়, নিরাপত্তা, এবং নিশ্চিত ভালোবাসা। পুরাতন বাড়িতে জন্ম হয় স্মৃতির, পুরাতন বন্ধুর সাথে হয় নিঃস্বার্থ সম্পর্ক। এসব পুরাতনের মাঝে থাকে এমন কিছু যা কোনো নতুনেই পূর্ণতা দিতে পারে না। আমাদের সমাজে অনেক বাবা-মা আছেন, যারা সন্তানদের ছোটবেলায় সময় দিয়েছেন, ভালোবাসা দিয়েছেন, অথচ সন্তান বড় হয়ে তাদের পাশে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে—তাদের গল্প, তাদের প্রয়োজন, এমনকি তাদের অস্তিত্ব যেন ধীরে ধীরে গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে। অথচ এই ‘পুরাতন’ মা-বাবাই একদিন সন্তানের জন্য দিন রাত এক করে দিয়েছিলেন।
মানব জীবনের এই মনস্তাত্ত্বিক অভ্যাস আমাদের শেখায়—নতুন কিছু পাওয়ার মধ্যে আনন্দ আছে ঠিকই, কিন্তু পুরাতনের মাঝে লুকিয়ে থাকে এক অনন্য মাধুর্য। সেটি টের পাওয়া যায় তখন, যখন নতুনের চকচকে রঙ ফিকে হয়ে যায়, আর আমরা আবার ফিরে যাই সেই পুরাতনের কাছেই। যেমন—একজন মানুষ জীবনে অনেক নতুন বন্ধু পেলেও, শৈশবের বন্ধুদের কথা ভুলে যেতে পারে না। নতুন নতুন গানের ভিড়ে হারিয়ে গেলেও, কোনো এক একাকী রাতে পুরাতন গানেই চোখে জল আসে। নতুন পোশাক হাজার থাকলেও, পুরাতন শাড়ির ভাঁজে পাওয়া যায় মায়ের স্মৃতি।
তাই বলা যায়, পুরাতন কিছুতে আগ্রহ কমে যাওয়াটা আসলে আমাদের মানসিক প্রশিক্ষণের ঘাটতি। আমরা শিখি কিভাবে নতুন কিছু পেতে হয়, কিন্তু শিখি না কিভাবে পুরাতন কিছু ধরে রাখতে হয়। আমাদের শিক্ষা, সংস্কৃতি, এমনকি মিডিয়াও আমাদের শেখায় নতুন কেনার কথা, পুরাতন ছাড়ার কথা, কিন্তু শেখায় না কিভাবে পুরাতনের মাঝে সৌন্দর্য খুঁজতে হয়। বাস্তবিক অর্থে যদি আমরা মন দিয়ে দেখতাম, তাহলে বুঝতে পারতাম—পুরাতন জিনিস মানেই কেবল পুরনো নয়, বরং অনেক সময় সেটিই হয় জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান উপহার।
তাই “পুরাতন হলে সব কিছুরই আগ্রহ কমে যায়”—এই কথাটিকে আমাদের কেবল মুখস্থ কোনো প্রবাদ হিসেবে না দেখে, বরং গভীরভাবে ভাবা দরকার। আমাদের উচিত, প্রতিটি সম্পর্ক, কাজ বা জিনিসের প্রতি যত্নবান থাকা—সে যত পুরাতনই হোক না কেন। কারণ যে আগ্রহ একসময় আমরা নতুন কিছুতে দেখিয়েছি, সেটি পুরাতনের জন্যও দেখাতে পারলে সম্পর্ক টিকে যায়, জীবন হয়ে ওঠে আরও সুন্দর। পুরাতন মানেই যে আগ্রহ হারানো—এটা একটি মন-নিয়ন্ত্রিত ধোঁকা মাত্র। সচেতন চর্চা, কৃতজ্ঞতা ও বোঝাপড়ার মাধ্যমে পুরাতনও হয়ে উঠতে পারে চিরনতুন।