"বাংলা কবিতা: যদি আর বাঁশী না বাজে -কাজী নজরুল ইসলাম"

বন্ধুগণ !
আপনারা যে সওগাত আজ হাতে তুলে দিলেন আমি তা মাথায় তুলে নিলুম,
আমার সকল তনু-মন-প্রাণ আজ বীণার মতো বেজে উঠেছে তাতে শুধু একটি মাত্র সুর ধ্বণিত হয়ে উঠছে আমি ধণ্য হলুম! আমি ধণ্য হলুম!
আমায় অভিনন্দিত আপনারা সেদিনই করেছেন যেদিন আমার লেখা আপনাদের ভালো লেগেছে,
বিংশ শতাব্দীর অসম্ভবের সম্ভাবনার যুগে আমি জন্ম গ্রহণ করেছি এরই অভিযান সেনাদলের তুর‌য বাদকের একজন আমি, এই হোক আমার সবচেয়ে বড় পরিচয়।
আমি এই দেশে এই সমাজে জন্মেছি বলেই শুধু এই দেশের এই সমাজের নই, “আমি সকল দেশের সকল মানুষের ;
কবি চায়না দান, কবি চায় অন্জলি কবি চায় প্রীতি । কবিতা আর দেবতা সুন্দরের প্রকাশ, সুন্দরকে স্বীকার করতে হয় যা সুন্দর তা-ই দিয়ে , সুন্দরের ধ্যান তার স্তবগানই আমার ধর্ম , তবু বলছি আমি শুধু সুন্দরের হাতে বীণা পায়ে পদ্মফুলই দেখিনি তার চোখে চোথ ভরা জলও দেখেছি। শ্মশানের পথে , গোরস্তানের পথে তাকে ক্ষুধা ধীর্ন মূর্তিতে ব্যথিত পায়ে চলে যেতে দেখেছি , যুদ্ধ ভূমিতে তাকে দেখেছি, কারাগারের অন্ধকূপে তাকে দেখেছি, ফাসির মঞ্চে তাকে দেখেছি।
আমাকে বিদ্রোহী বলে খামকা লোকের মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছেন কেউ কেউ । এই নিরীহ জাতটাকে আঁচড়ে কামড়ে তেড়ে নিয়ে বেড়াবার ইচ্ছা আমার কোনদিনই নেই, আমি বিদ্রোহ করেছি বিদ্রোহের গান গেয়েছি অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অত্যাচারের বিরুদ্ধে; যা মিথ্যা কলুষিত পুরাতন পঁচা সেই মিথ্যা সনাতনের বিরুদ্ধে, ধর্মের নামে ভন্ডামী ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে।
কেউ বলেন আমার বাণী যবন কেউ বলেন কাফের আমি বলি ও দুটোর কোনটাই নই, আমি কেবলমাত্র হিন্দু মুসলমানকে এক জায়গায় ধরে এনে হ্যান্ডসেক করাবাার চেষ্টা করেছি, গালাগালিকে গলাগলিতে পরিনত করার চেষ্টা করেছি।
সেই হাতে হাত মেলানে যদি হাতাহাতির চেয়ে অশোভনীয় হয়ে থাকে তাহলে ওরা আপনিই আলাদা হয়ে যাবে, আমার গাঁটছড়ার বাধন কাটতে তাদের কোন বেগ পেতে হবেনা । কেননা একজনের হাতে আছে লাঠি আর একজনের আস্তিনে আছে চুরি , হিন্দু মুসলমানে দিন রাত হানাহানি জাতিতে -জাতিতে বিদ্বেষ , ‍যুদ্ধ-বিগ্রহ ; মানুষের জীবনে একদিকে কঠোর দারিদ্র- ঋন- অভার অন্যদিকে লোভী অসুরের যক্ষের ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা পাষাণ স্তুপের মতো জমা হয়ে আছে , এই অসাম্য ভেদ জ্ঞান দূর করতেই আমি এসেছিলাম। আমার কাব্যে সংগীতে কর্ম জীবনে অভেদ সুন্দর সাম্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম।
আমি যশ চায়না খ্যাতি চায়না প্রতিষ্ঠা চায়না নেতৃত্ব চায়না, জীবন আমার যত দুঃখময়ই হোক আনন্দের গান বেদনার গান গেয়ে যাবো আমি, দিয়ে যাবো নিজেকে নিঃশেষ করে সকলের মাজে বিলিয়ে, সকলের বাচার মাঝে থাকবো আমি বেঁচে , এই আমার ব্রত, এই আমার সাধনা , এই আমার তপস্যা।
রবীন্দ্রনাথ আমায় প্রায় বলতেন-দেখ উন্মাদ তোার জীবনে শেলীর মতো কীটস এর মতো খুব বড় একটা ট্র্যাজেডি আছে তই প্রস্তুত হ। জীবনে সেই ট্র্যাজেডি দেখবার জন্য আমি কতোদিন অকারণে অন্যের জীবনকে অশ্রুর বরষায় আচ্ছন্ন করে দিয়েছ কিন্তু আমারই জীবন রয়ে গেল বিশুষ্ক মরুভূমির মতো দগ্ধ, মেঘের উধের্ব শূণ্যের মতো কেবল হাসি , কেবল গান , কেবল বিদ্রোহ।
আমার বেশ মনে পড়ছে এ্কদিন আমার জীবনের মহা অনুভূতির কথা , আমার ছেলে মারা গেছে, আমার মন তীব্র পুত্রশোকে যখন ভেঙ্গে পড়ছে ঠিক সেদিনই সে সময় আমার বাড়ীতে হাসনাহেনা ফুঠেছে, আমি প্রাণ ভরে সেই হাসনাহেনার গন্ধ উপভোগ করেছিলাম । আমার কাব্য আামার গান আমার জীবনের অভিজ্ঞতার মধ্য হতে জন্ম নিয়েছে, ‍যদি কোনদিন আপনাদের প্রেমের প্রবল টানে আমাকে আামার একাকীত্বের পরম শূণ্য থেকে অসময়ে নামতে হয় তাহলে সেদিন আমায় মনে করবেননা আমি সেই নজরুল, সেই নজরুল অনেকদিন আগে মৃত্যুর খিড়কি দুয়াার দিয়ে পালিয়ে গেছে।
মনে করবেন পূর্ণত্বের তৃষ্ণা নিয়ে যে একটি অশান্ত তরুন এই ধরায় এসেছিলো অপূর্ণতার বেদনায় তারই বিগত আত্মা যেন স্বপ্নে আপনাদের মাঝে কেঁদে গেলো ।
যদি আর বাঁশী না বাজে ! আমি কবি বলে বলছিনে , আমি আপনাদের ভালোবাসা পেয়েছিলাম সেই অধিকারে বলছি আমায় আপনারা ক্ষমা করবেন আমায় ভূলে যাবেন , বিশ্বাস করুন আমি কবি হতে আসিনি , আমি নেতা হতে আসিনি , আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম প্রেম পেতে এসেছিলাম , সেই প্রেম পেলামনা বলে আমি এই প্রেমহীন-নিরস পৃথিবী থেকে নীরব অভিমানে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলাম।
যেদিন আমি চলে যাবো সেদিন হয়তোবা বড় বড় সভা হবে ,কতো প্রশংসা কতো কবিতা বেরুবে হয়তো আমার নামে , দেশপ্রেমিক, ত্যাগী , বীর , বিদ্রোহী বিশেষনের পর বিশেষন টেবিল ভেঙ্গে ফেলবে তাপ্পড় মেরে বক্তার পর বক্তা ।
এই অসুন্দরের শ্রদ্ধা নিবেদনের শ্রাদ্ধ দিনে বন্ধু তুমি যেন যেয়োনা , ‍ যদি পারো চুপটি করে বসে আমার অলিখিত জীবনের কোন একটি কথা স্মরণ কোরো । তোমার ঘরের আঙিনায় বা আশে পাশে ‍যদি একটি ঝরা পায়ে পেষা ফুল পাও সেইটিকে বুকে চেপে বোলো বন্ধু আমি তোমায় পেয়েছি ।
তোমাদের পানে চাহিয়া বন্ধু আার আমি জাগিবনা , কোলাহল করি সারা দিন ও মান কারও ধ্যান ভাঙ্গিবনা , নিশ্চল নিশ্চুপ আপনার মনে পুড়িব একাকি গন্ধ বিধূর ধুপ।
(সমাপ্তি)