বনফুল কে নিয়ে আমার লেখা ছোট একটি গল্প - পর্ব ৮
গল্পে আদিম জৈবপ্রবৃত্তির সর্বগ্রাসী প্রেমক্ষুধার প্রকাশ। অরণ্যচারী শিকারসন্ধানী পুরুষ বিলল্ট যেদিন প্রথম নিকষ কালো-কৃশাঙ্গী কিশোরী বুধনীর সাক্ষাৎ গেয়েছিল সেদিন তাকে বন্য পশুর মতই সে তাড়া করেছিল। ত্রস্ত হরিণীর মত দ্রুতবেগে পলায়ন করে সেদিন বুধনী নিস্তার পেয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিল্টুই তাকে জয় করল। প্রাণসংশয় শক্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সে বুধীকে বিয়ে করেছিল। বিয়ের পর বিল্টু বুধীকে একদণ্ডও ছাড়েনি। কিন্তু পুরুষ ও নারীর আদিম অবিচ্ছেদ্য মিলনে প্রথম বিপর্যয় ঘটালে সন্তানের আবির্ভাব। নববধূ জায়া ও জননীতে দ্বিধাবিভক্ত হল। নারীর অধিকার নিয়ে পুরুষের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়াল তারই ঔরসজাত শিশুসন্তান। বিল্টু শিশুপুত্রকে হত্যা করে ফাঁসি গেল। মৃত্যুর পূর্বক্ষণ পর্যন্ত বুধনীর নাম উচ্চারণ করেই সে অবিশ্রান্ত চিৎকার করেছে। ‘নৃশংস শিশু-হত্যাকারীর প্রতি কারো সহানুভূতি হয়নি'। কিন্তু পুরুষের সর্বগ্রাসী-রাহুর-প্রেমের এই বল্গাহীন আদিম বর্বর রূপটিকে অস্বীকার করলে জীবনসত্যকেই অস্বীকার করা হবে। ‘শ্রীধরের উত্তরাধিকারী' গল্পে জীবনসত্যের আরেক দিকের উন্মেষ। চিরকৃপণ ও শোষণপটু 'মক্ষিচুস' শ্রীধর মিত্তির তার তিলে তিলে সঞ্চিত চার লাখ টাকার সম্পত্তি অকাতরে একটি অনাত্মীয় ও অপরিচিত ব্যক্তিকেই সমর্পণ করে গেল, তার কারণ শ্রীধরের মৃত্যুসংবাদ চরম প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে ঐ একটিমাত্র ব্যক্তিই সাড়া দিয়েছিল।
মানুষ তার সমস্ত অর্থগৃধ্নতা ও চিত্তসংকোচন সত্ত্বেও নিজের অজ্ঞাতসারেই কাঙাল হয়ে সংসারে একটি জিনিসের সন্ধান করছে—সে হচ্ছে মানুষের হৃদয়ের ক্ষেত্রে ভালবাসার একটু স্থান। উত্তরাধিকারের দাবি সেখানেই। ভাল ‘ঐরাবত' গল্পটি প্রাকৃতিক প্রাণধর্মের বিজয়-বৈজয়ন্তী। ইন্দ্রিয়ের সর্বদ্বার রুদ্ধ করে চিত্তনিরোধের পথে প্রাকৃতিক নিয়ম যে অতিক্রম করা যায় না, ব্রহ্মচারী ত্রিগুণানন্দের উদ্ভট জীবনে সেই সত্যই প্রকাশিত হল। তাঁর নিজস্ব পন্থায় সর্ববিধ ‘বখেড়া' মেটাতে গিয়ে গঙ্গার তোড়ে ঐরাবতের মত জীবনস্রোতে তাঁকেও ভেসে যেতে হল। অবদমিত কামনা জাগ্রত হয়ে ক্ষুধার যে আহার দাবি করল তা সংগ্রহ করে তবেই তাঁর জীবনের শেষ বখেড়া মিটল। গল্পশেষে লেখক নারীরূপা সেই প্রকৃতির পায়েই তাঁর প্রণাম নিবেদন করেছেন। জাতীর আঁচল চা ‘অর্জুন মণ্ডল’ গল্পে আছে অতিচারী জীবনের ট্রাজেডির কথা। বিত্ত-নিরোধের পন্থাও যেমন জীবনের অস্বীকৃত, আত্যন্তিক অতিচারও তেমনি প্রকৃতির অনুশাসন লঙ্ঘন। 'অর্জুন মণ্ডল'- এর জীবনসাধনা যতই অ-সাধারণ হোক না কেন, তাও আদর্শপ্রতিষ্ঠার একপ্রকার উন্মাদনা মাত্র। আদর্শবাদী মানুষের মনে তা যতই শ্রদ্ধেয় হোক, সহজ জীবনের পথে তা সর্বদাই অচল ৷ অর্জুন মণ্ডল তাঁর জীবনটিকে সর্বভারসহ এমন একটি বিরাট সিন্দুকে রূপান্তরিত করেছেন যে, চলার পথে তাকে বহন করে নিয়ে যাওয়াই দুঃসাধ্য। জীবনের যাত্রায় সাধারণ সুটকেশ হাতে নিয়ে যখন মানুষ স্বচ্ছন্দে যাতায়াত করছে তখন ঐ বিরাটকায় সিন্দুক নিয়ে অর্জুন মণ্ডল চলাচলের পথের পাশে ব্যর্থ-মনোরথ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। যুগে যুগে অ-সাধারণ মানুষের মহৎ ট্রাজেডির মূলে এই কারণটিই নিহিত আছে; অস্বাভাবিক বলেই তা প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে দণ্ডনীয়। এখানেও বনফুলের প্রণাম জীবন-দেবতার চরণেই নিবেদিত হয়েছে।
This post has been upvoted by @italygame witness curation trail
If you like our work and want to support us, please consider to approve our witness
Come and visit Italy Community
Hi @fxsajol,
my name is @ilnegro and I voted your post using steem-fanbase.com.
Come and visit Italy Community