নতুন প্রবীণদের নিয়ে আমার লেখা ছোট একটি গল্প - পর্ব ২০
মনটাকে শান্ত করল উৎপল । জীবন এত সস্তা না। তাকে বেঁচে থাকতে হবে। তাকে ভালো থাকতে হবে। অমিত ঠিকই বলেছে। সে এখানে বসে কষ্ট পেলে সহস্রাব্দী ওখানে বসে সুস্থ হয়ে যাবে না। ভাগ্যে যা লেখা আছে তা হবেই। কেউ তা খণ্ডাতে পারবে না। উৎপল ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল সহস্রাব্দীকে ইতোমধ্যে প্রায় শ'খানেক মেসেজ পাঠানো হয়ে গেছে। সেদিকে তাকিয়ে একটা শূন্য হাসি দিয়ে উৎপল বলে উঠল, আমি আর তোমার জন্য উতলা হয়ে তোমাকে বিরক্ত করব না এক হাজার বছর। আমি আর কখনো তোমার সামনেও যাবো না। কারণ তুমি নিজেই সেটা চাও না। তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমি কিছু করবো না। আমি জানি তুমিও আমাকে ভালোবাসো কেবল মুখ ফুটে কখনো বলতে পারোনি। আমি আর কখনো তোমার কাছাকাছি যাওয়ার জন্য জোরাজুরি করব না, এক হাজার বছর। উৎপলের চোখ থেকে এক ফোটা পানি এসে পড়ল ফোনের উপর। উৎপল সেদিকে তাকিয়ে বলল, আমি তোমাকে দূর থেকে ভালোবাসবো এক হাজার বছর ।
আমি দূর থেকেই ভালোবাসবো । সহস্রাব্দীর শরীর দিন দিন আরো ভেঙে যাচ্ছে। বাড়ির সবাই তাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে চেয়েছিল কিন্তু সে কিছুতেই রাজী হয়নি। সহস্রাব্দী মুখে কাউকে বলেনি কিন্তু মনে মনে সে চায় তার শেষ নিঃশ্বাস যেন বাড়িতেই পড়ে। সে এখন আছে সেই শেষ নিঃশ্বাসের অপেক্ষায় । কোনো এক সকালে যে তার আর ঘুম থেকে উঠা হবে না সবাই জানে ৷ কিন্তু সেই সকালটা কবে তা কেউ জানে না। একটা একটা দিন করে বেঁচে থাকা খুব কষ্টের। আর এই প্রত্যেকটা দিন সৃষ্টিকর্তার তরফ থেকে তার জন্য উপহার স্বরূপ । তাই যতদিন সে বেঁচে আছে সে যেন সত্যিকার অর্থেই বেঁচে আছে । আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকার মতো । সহস্রাব্দী তাই আগের চেয়ে অনেক বেশি দুর্বল হয়ে পড়লেও পড়াশোনা, কলেজ, পরীক্ষা থেকে এক পাও পিছপা হল না। তার টেস্ট পরীক্ষার বেশিদিন বাকি নেই। সে ঠিক করেছে সে টেস্ট পরীক্ষাটা দিবে। যদি আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখে আরো কিছুদিন তাহলে এইচএসসিটাও দিবে। একটা একটা দিন করে বেঁচে থাকার মাঝে একদিনও সে হেলায় হারাবে না ।
বেয়ান হয় বেয়ান। রক্তের কেউ হয় না। প্রেমিকা হয় না। তুই একা তাকে ভালোবাসার কথা বলেছিস। সে একবারও বলেনি। এরকম একটা মেয়ের রোগে এত কষ্ট পাচ্ছিস তুই? উৎপল তখন নিরুপায় হয়ে বলল, আচ্ছা' অমিত তুই তো তারেক ভাইয়ের বিয়েতে গিয়ে মেয়েটাকে সামনে থেকে দেখেছিলি। মেয়েটার এত বড়ো অসুখ করল, তোর ওর জন্য একটুও মন কাঁদছে না? শোন জীবনে কম বিয়েবাড়িতে তো যাইনি। এখন প্রত্যেক বিয়েতে গিয়ে যদি একজন করে রোগীর সাথে দেখা হয় আর তাদের চিন্তায় আমাকে অধির হতে হয় তবে মুশকিল না? উৎপল আর কিছু না বলে মাথায় হাত দিয়ে খাটে বসে পড়ল। অমিত এবার রুমে জড়ো হওয়া সব ছেলেদের দিকে তাকিয়ে বলল, তোরা তো কেউ অন্তত ওকে বুঝা! ছেলেরা একজন আরেকজনের দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল ।
তারা অনেকক্ষণ ধরেই দুই বন্ধুর কথা কাটাকাটি শুনে চলেছে। কিন্তু নিজেরা একটাও কথা বলেনি। তাই হঠাৎ করে এখন কী বলবে তাই ভেবে পেল না । অমিত অপারগ হয়ে উৎপলের কাছে গিয়ে বসল। তারপর নরম গলায় বলল, দেখ উৎপল আমি এর আগে কখনো কোনো কাজে তোকে বাঁধা দিয়েছি? যখন যা করেছিস আমি তাতেই সায় দিয়েছি। কিন্তু আজ আমার কথাটা শোন, ভালো ভাই আমার। তুই মেয়েটাকে ভুলে যা। বলেই সে রুম থেকে বেরিয়ে বারান্দায় চলে গেল। আস্তে আস্তে অন্যান্য রুমের ছেলেরাও নিজেদের রুমে চলে গেল। অমিত বারান্দার রেলিং ধরে এক দৃষ্টিতে রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। একসময় সে নিজের মনে বলে উঠল, আমি তোর মনের অবস্থাটা বুঝতে পারছি উৎপল। আমাকে ভুল বুঝিস না। আমি যে বন্ধু হয়ে বন্ধুর কষ্ট দেখতে পারছি না । উৎপল রুমে একা বসে আছে। পাশের দুটো খাটের ছেলে দুজনও এখন রুমে নেই। উৎপল মাথায় হাত দিয়ে বসে অনেক কিছু চিন্তা করতে লাগল । হঠাৎ উপরে ছাদের দিকে তার চোখ পড়তেই তার নজর গেল ফ্যানের দিকে। তখনই তার মনে হল, সহস্রাব্দীর পথ যদি সেও বেছে নিতে পারতো!