নতুন প্রবীণদের নিয়ে আমার লেখা ছোট একটি গল্প - পর্ব ২৩
ছেলেকে তিনি মানুষ করতে পারেননি। অর্থ রোজগারই সব নয়। সৎপথে করতে হয়। ছেলেকে তিনি সেই শিক্ষা দিতে পারেননি। আর আজ তার এই একটা ভুলের মাশুল দিবে তার ছোটো নাতনী নিজের জীবন দিয়ে! ঠিক তখনই তার মনে পড়ল নাতনীর বলা কথাগুলো। না জানি তার ছেলের এই অসৎ ব্যাবসার জন্য কত মানুষকে তাদের জীবন দিতে হয়েছে! সত্যি! আল্লাহ কখনো ন্যায়বিচার করতে ছাড়েন না। প্রত্যেক মানুষ তার কৃতকর্মের ফল দুনিয়াতেই পেয়ে যায় ৷ ঘুমন্ত নাতিকে পাশ কাটিয়ে শৈল বেগম তার ঘরে থেকে বেরিয়ে এলেন। তার খুব অস্থির লাগছে। এভাবে তিনি ঘুমাতে পারবেন না। ঘর থেকে বেরিয়ে কী করবেন তাও জানেন না। কেবল জানেন তার দম বন্ধ হয়ে আসছে এই বাড়ির পরিবেশে। শৈল বেগম সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলেন। কিন্তু এসে দেখলেন বসার ঘরে আলো জ্বলছে। সাদাব সাহেব গালে হাত দিয়ে একা একা সেখানে বসে আছেন। শৈল বেগমের চোখে তখনও পানি।
ছেলেকে ওই অবস্থায় দেখে তার মনে তখন মিশ্র প্রতিক্রিয়া হল । কীরে ঘুমোতে যাস নে ? না মা। ঘুম আসে না। মেয়েটার যে কী হবে! খুব চিন্তে হয় নারে? হয়ই তো মা । আল্লাহ তাকে কীসের শাস্তে দেচ্চে বল দেখিনি? সাদাব সাহেব অবাক হয়ে মায়ের মুখের দিকে তাকালেন। তার নীরবতা দেখে শৈল বেগম ধরা গলায় বললেন, ধম্মের কল বাতেসে নড়ে রে, বাপ! সাদাব সাহেব চুপ করে রইলেন। আজ অনেক অনেক বছর পর তিনি বুঝতে পারলেন জীবনে কী করেছেন। হয়তো আর একটা শেষ সুযোগ পেলে যেভাবে হোক এর প্রায়শ্চিত্ত তিনি করে যেতেন। কিন্তু এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে । শেষ সুযোগ পাওয়ার শেষ সময়ও তার জীবন থেকে চলে গেছে। সহস্রাব্দীকে হাজার চেষ্টা করেও হাসপাতালে ভর্তি করা গেল না । তার প্রথম কথা, চিকিৎসা করে সে সুস্থ হবে না কখনোই। তাহলে ভর্তি হয়ে কী হবে? তার যুক্তি ফেলে দেয়ার মতো না। তার দ্বিতীয় কথা, বাবার ওই কালো
না দাদীমা, আমি অভিমান করে কিছু বলছি না। বারো বছরের ওই বাচ্চাটা তো বাবার বিক্রি করা জাল ওষুধ খেয়ে মরে এই বদ দুনিয়া থেকে বেঁচে গেছে। এবার আমি মরে বাঁচবো । চুপ কর চুপ কর দেদেভাই । আমি চুপ করলেই কি আর আল্লাহ চুপ করে থাকবে? তিনি ঠিক তার বিচার করবেন। মানুষের আদালত বাবার বিচার করতে পারেনি। আরো কত শত মানুষের জীবন উনি নিয়েছে এই ব্যবসায়! আল্লাহর আদালত ঠিক উনার বিচার করেছে! এসব তুই কী বলছিস দেদেভাই! ঠিক বলছি দাদীমা।
পাপ বাপকেও ছাড়ে না। আমার বাপের পাপ আমাকে ছাড়েনি।... সহস্রাব্দীর আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু তখনই তার প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট শুরু হল। কথা বলতে গিয়ে তার গলা দিয়ে স্বর বের হল না। কেবল হাঁপাতে লাগল। দাদীমার ডাকাডাকিতে মা তাড়াতাড়ি ইঞ্জেকশন নিয়ে ছুটে এলেন। ইঞ্জেকশন দেয়ার সাথে সাথে গভীর ঘুম নেমে এল সহস্রাব্দীর চোখে । ঘুমে ঝাপসা হয়ে আসা চোখে সে দেখল দাদীমার চোখে পানি। সে তার জীবনে দাদীমাকে কখনো কাঁদতে দেখেনি। বিয়ের পর শতাব্দী বুবুকে বিদায় দেয়ার সময়ও না। এতই শক্ত মন তার দাদীমার। সেই দাদীমার চোখে পানি ঘুমের ঘোরে আবোল তাবোল দেখা ছাড়া আর কিছুই না। সহস্রাব্দী গভীর ঘুমে ঢলে পড়ল । শৈল বেগম তার ঘরে বসে চোখের পানি ফেলতে লাগলেন। পঁচিশ বছর আগে তার স্বামী মারা যাওয়ার পর তিনি শেষ কেঁদেছিলেন। তারপর আর কখনো কেউ তাকে কাঁদতে দেখেনি। তার নাতনীর শেষ রিপোর্টগুলো আসার পরও তিনি কাঁদেননি। নিজের মনকে এই বলে বুঝিয়েছিলেন যে মৃত্যু তো সবার কপালেই লেখা আছে। আল্লাহ শুধু তার ছোট নাতনীকে একটু আগেই নিয়ে যেতে চাইছেন। কিন্তু সে যতদিন বেঁচে আছে তার প্রতিটা দিন তিনি সুন্দর করে তুলবেন। এই ভেবে এতদিন শক্ত ছিলেন। কিন্তু আজ নাতনীর সাথে কথা বলার পর তার চোখের পানি কিছুতেই বাধ মানছে না। সত্যিই কি তাহলে আল্লাহ এইভাবেই বাবার কর্মফল নিষ্পাপ মেয়ের উপর দেখাচ্ছেন?
You've got a free upvote from witness fuli.
Peace & Love!